৩৩. মায়ার আবরণের মধ্য দিয়ে দৃষ্ট পরব্রহ্মই ব্যক্তিভাবাপন্ন ঈশ্বর। যখন পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা আমরা তাঁহাকে ধরিতে চাই, তখনই তাঁহাকে ব্যক্তিভাবাপন্ন সাকাররূপে দেখিতে পাই। কিন্তু ভাবটি এই যে, আত্মাকে কখনই জ্ঞানের বিষয় করা যায় না। জ্ঞাতা কিভাবে নিজেকে জানিতে পারে? কিন্তু আত্মা যেন একটি ছায়া প্রক্ষেপ করিতে পারেন—এই ছায়া-পাতকেই জ্ঞানের বিষয়ীকরণ(objectification) বলা যাইতে পারে। এই ছায়া-সত্তার চরম প্রকাশ পরমাত্মার নিজেকে নিজের জ্ঞানের বিষয় করার চেষ্টাই ব্যক্তিভাবাপন্ন সাকার ঈশ্বর। আত্মাই শাশ্বত জ্ঞাতা (subject)। আমরা সর্বদাই আত্মাকে জ্ঞানের বিষয়ীভূত করিবার জন্য সংগ্রাম করিতেছি। আর এই সংগ্রামের ফলস্বরূপ এই বিশ্বজগৎ, এবং যাহাকে আমরা জড়বস্তু ও অন্য অনেক নামে অভিহিত করি—এই সবের উৎপত্তি হইয়াছে। কিন্তু এইগুলি সব দুর্বল প্রচেষ্টার ফল; আমাদের পক্ষে সম্ভব আত্মার সর্বোচ্চ প্রকাশ ব্যক্তিভাবাপন্ন সাকার ঈশ্বর। এই বিষয়ীকরণ আমাদের স্বরূপ-প্রকাশেরই এক প্রচেষ্টা। সাংখ্যমতে প্রকৃতিই পুরুষকে এই-সকল বিষয় দেখাইতেছে, এবং যখন পুরুষের যথার্থ অভিজ্ঞতা লাভ হয়, তখনই সে তাহার স্বরূপ বুঝিতে পারিবে। অদ্বৈত বেদান্তমতে আত্মা নিজেকে প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিতেছেন। বহু সাধনার পর আত্মা দেখেন যে, জ্ঞাতা (বিষয়ী=subject) সর্বদা জ্ঞাতামাত্রই থাকিবেন এবং তখনই অনাসক্তি আরম্ভ হয় এবং আত্মা মুক্ত হন।
কোন ব্যক্তি যখন সেই পূর্ণ অবস্থা লাভ করেন, তখন তিনি ব্যক্তিভাবাপন্ন ঈশ্বর-স্বরূপ হন। ‘আমি ও আমার পিতা এক।’ তিনি জানেন যে, ব্রহ্মের সহিত তিনি এক এবং সাকার ঈশ্বরের ন্যায় নিজেকে অভিক্ষেপ করেন। মহিমান্বিত রাজাও যেমন মাঝে মাঝে পুতুল লইয়া খেলা করেন, তেমনি তিনিও খেলা করেন।
৩৪. কতকগুলি কল্পনা মানুষের বাকী বন্ধনগুলি ছিন্ন করিতে সাহায্য করে। গোটা বিশ্বটাই একটা কল্পনা। কিন্তু একধরনের কল্পনা অন্য ধরণের কল্পনারাশির অবসান ঘটাইতে পারে, যাহারা আমাদের বলে যে, জগতে পাপ আছে, দুঃখ ও মৃত্যু আছে, তাহারা ভয়ঙ্কর। অপর দল বলেন—তুমি পবিত্র, ঈশ্বর সত্য, জগতে কোন দুঃখ নাই—এই ভাবগুলি শুভ এবং অপরের বন্ধন দূর করিতে সাহায্য করে। মানব মনের উচ্চতম কল্পনা-ব্যক্তি ভাবাপণ্ন ঈশ্বর ভাবই শৃঙ্খলের সবকয়টি শিকলি ভাঙিয়া ফেলিতে পারে।
৩৫. পরম আনন্দের মুহূর্ত আমাদের জীবনে কখন কখন আসিয়া উপস্থিত হয়, তখন আমরা আনন্দ ছাড়া কোন কিছুই চাই না, কোন-কিছু দিই না, কোন-কিছু বুঝিও না। সে-ভাব কাটিয়া যায়, আবার বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের বৈচিত্র্য চোখের সামনে আবর্তিত দেখিতে পাই। কিন্তু আমরা জানি, ইহা সব-কিছুর আধাররূপে অবস্থিত ঈশ্বর-সত্তার উপর বিরচিত বিচিত্র কারুকার্য।
বেদান্ত শিক্ষা দেয়—এখানে এইক্ষণেই নির্বাণ লাভ করা যায়; এ-অবস্থা প্রাপ্তির জন্য আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হইবে না। নির্বাণ আত্মস্বরূপের উপলব্ধি—এক মুহূর্তের জন্য যদি কেউ একবার এ তত্ত্ব উপলব্ধি করিতে পারে, তবে সে আর ব্যক্তিত্বের মরীচিকার দ্বারা বিভ্রান্ত হইবে না। চক্ষু থাকিলে আপাতপ্রতীয়মান জগৎ দেখিতেই হইবে। কিন্তু জগৎটা যে কি,. সর্বক্ষণই আমরা জানি; আমরা ইহার প্রকৃত স্বরূপকে ধরিতে পারিয়াছি। (মায়ার) পর্দাই অপরিণামী আত্মাকে ঢাকিয়া রাখিয়াছে। পর্দা সরিয়া যাইলেই অন্তরালবর্তী আত্মাকে দেখিতে পাইব। যাহা কিছু পরিবর্তন, তাহা পর্দাতেই। মহাপুরুষদের অন্তরে এই আবরণ খুবই পাতলা, সত্য তাহার মধ্য দিয়া প্রায় স্পষ্ট ও উজ্জলভাবে দেখা যায়। আর পাপীর মধ্যে এই আবরণ বেশ পুরু, ইহার অন্তরালে যে আত্মা আছেন, তাহা দেখাই যায় না। যখন পর্দা সম্পূর্ণরূপে অপসারিত হয়, তখন বুঝিতে পারি যে, পর্দা সেভাবে কোন কালেই ছিল না, এবং আমরা আত্মাই ছিলাম, তাছাড়া আর কিছুই ছিলাম না; তখন ঐ আবরণের কথাও আমরা ভুলিয়া যাই।
৩৬. জীবনের দুইটি বিশিষ্ট ধারা এই : প্রথমতঃ যে-মানুষ তাহার প্রকৃত স্বরূপকে জানিয়াছে, সে কখনই জাগতিক বস্তু দ্বারা বিচলিত হইবে না;দ্বিতীয়তঃ কেবল সেই ব্যক্তিই জগতের কল্যান করিতে পারে; সেই কেবল অপরের হিত করিবার প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিয়াছে, কারণ কেবল একটি(আত্মা)ই আছেন। ইহাকে ‘অহংভাব’ বলা চলে না, কারণ তাহাতে ভেদবুদ্ধি আসিবে। ইহা কেবল অহংশূন্যতা। বিশ্বাত্মার (সমষ্টি-)বোধই তখন থাকিবে, ব্যক্তিকেন্দ্রিক (ব্যষ্টি-)ভাব নয়। প্রেম ও সহানুভূতি প্রতি ক্ষেত্রে এই বিশ্বাত্মভাবই প্রমাণ করে। ‘নাহং, তুঁহু’—আমি নই, তুমি। অপরকে সাহায্য করি, কারণ আমি তাহাতে এবং সে আমাতে—এভাবেই এই তত্ত্বটি দার্শনিক ভাষায় প্রকাশ করা যায়। প্রকৃত বেদান্তবাদীই কোনরূপ মর্ম-পীড়া বোধ না করিয়া অপরের জন্য নিজ জীবন বলি দিতে পারেন; কারণ তিনি জানেন, তাঁহার মৃত্যু নাই। যে পর্যন্ত পৃথিবীতে একটি কীট জীবিত থাকিবে, সে পর্যন্ত তিনিও থাকিবেন; যতক্ষণ একটি মুখও আহার গ্রহণ করে, ততক্ষণ তিনিও আহার করেন। সুতরাং তিনি লোককল্যানে কাজ করিয়া যান, শরীরের যত্ন লইবার আধুনিক ভাবের দ্বারা তিনি কোনরূপ বাধা প্রাপ্ত হন না। সাধক যখন আত্মত্যাগের এই স্তরে উন্নীত হন, তখন তিনি সকল নৈতিক নিয়মের ঊর্ধ্বে—সকল বিধি-নিষেধের ঊর্ধ্বে চলিয়া যান। ‘তিনি বিদ্যাবিনয়-সম্পন্ন ব্রাহ্মণে গাভীতে কুকুরে এবং অতি দুঃখপূর্ণ স্থানে শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ গাভী কুকুর বা দুঃখপূর্ণ স্থান দেখেন না, পরন্তু সকলের মধ্যেই ঈশ্বরকে প্রকাশিত দেখিতে পান। তিনিই একমাত্র সুখী, যিনি এ জীবনেই এই সাম্যভাব লাভ করিয়াছেন; তিনি স্বর্গাদি লোক (সংসার) জয় করিয়াছেন। ঈশ্বর পবিত্র, সুতরাং বলা হয়—এ-ধরনের পুরুষ ঈশ্বরেই জীবন যাপন করিতেছেন।১ যীশু বলিয়াছেন, ‘এব্রাহামের পূর্বে আমি ছিলাম।’ ইহার অর্থ এই যে, ইঁহারা নিত্যমুক্ত আত্মা। অতীত কর্মফলে বাধ্য হইয়া ন্যাজারেথের যীশু মানবদেহ ধারণ করেন নাই, পরন্তু লোককল্যানের জন্যই করিয়াছেন। মানুষ মুক্ত হইলে স্তব্ধ বা জড়বৎ হইয়া যায় না, বরং অন্যান্য প্রাণী অপেক্ষা বেশী ক্রিয়াশীল হয়, কারণ অপর সকলে শুধু বাধ্য হইয়া কাজ করে, মুক্ত পুরুষই কেবল স্বাধীনভাবে কর্ম করেন।