২৯. ইচ্ছাশক্তি : বৌদ্ধধর্ম এই ব্যাবহারিক জগৎ চায় না। এই মতে ব্যাবহারিক জগতেই তৃষ্ণা (বাসনা) বিদ্যমান, এবং এই তৃষ্ণাই এ-সকল সৃষ্টি করিতেছে। আধুনিক বৈদান্তিকগণ এ-কথা একেবারেই স্বীকার করেন না। আমরা বলি, কিছু একটা আছে, যাহা ইচ্ছা(বাসনা)রূপে প্রতিভাত হইতেছে। বাসনা সৃষ্ট পদার্থ—যৌগিক; মৌলিক নয়। বাহ্য বিষয় না থাকিলে কোন বাসনার সৃষ্টি হইতে পারে না। সুতরাং আমরা বুঝিতে পারি যে, বাসনাই জগৎ সৃষ্টি করিয়াছে—এইমতটি একেবারেই অসম্ভব। কেমন করিয়া তাহা হইবে? বাহ্য বিষয়ের প্রেরণা ব্যতীত তুমি কি কখনও ইচ্ছা বা বাসনার অস্তিত্ব বোধ করিয়াছ? প্রেরণা ব্যতীত অথবা অধুনিক দার্শনিক পরিভাষায় স্নায়বিক উত্তেজনা ব্যতীত কোন বাসনার উদ্রেক হয় না। ইচ্ছা বা বাসনা মস্তিষ্কের একপ্রাকার প্রতিক্রিয়া মাত্র—সাংখ্য-দার্শনিকদের মতে ইহা ‘বুদ্ধি’। এই প্রতিক্রিয়া ক্রিয়া-সাপেক্ষ এবং ক্রিয়া মানিলেই বাহ্য জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করিতে হয়। সুতরাং বহির্জগতের অস্তিত্ব না থাকিলে ইচ্ছাও থাকিতে পারে না; তথাপি তোমাদের মত অনুসারে বাসনাই জগৎ সৃষ্টি করিয়াছে। বাসনা কে সৃষ্টি করে? যেখানে বাসনা, সেখানেই জগৎ। যে প্রেরণা জগৎ সৃষ্টি করিয়াছে, সেই প্রেরণা হইতেই জাত বহু সৃষ্টি-বৈচিত্র্যের অন্যতম বাসনা। কিন্তু দর্শন এখানেই ক্ষান্ত হয় না। বাসনা বা ইচ্ছা একেবারেই ব্যক্তিগত, সুতরাং আমরা শোপেনহাওয়ারের সঙ্গে মোটেই একমত হইতে পারি না। ইচ্ছা একটি যৌগিক সৃষ্টি—অন্তরের ও বাহিরের মিশ্রণে উৎপন্ন। মনে কর কোন লোক জ্ঞানেন্দ্রিয়-বর্জিত হইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে—ফলে তাহার কোন ইচ্ছাই থাকিবে না। ইচ্ছার বিকাশের জন্য প্রথমতঃ বাহিরের কোন বস্তু থাকা চাই। তারপর ভিতর হইতেও মস্তিষ্ক কিছু শক্তি সংগ্রহ করে। সুতরাং ইচ্ছা এই দেওয়ালটি বা অন্যান্য বস্তুর মতোই একটি যৌগিক পদার্থ। এই-সকল জার্মান দার্শনিকের ইচ্ছা-বিষয়ক মতবাদের সহিত আমরা মোটেই একমত নই। ইচ্ছা নিজেই ব্যাবহারিক, সুতরাং কখনই পরম সত্য হইতে পারে না। বাসনা বা ইচ্ছা বহু প্রক্ষেপের অন্যতম। এমন একটা কিছু আছে, যাহা ইচ্ছা নয়, কিন্তু নিজেকে ইচ্ছারূপে প্রকাশ করিতেছে—এ-কথা আমি বুঝিতে পারি। কিন্তু ইচ্ছাই সব-কিছু হইয়া নিজেকে প্রকাশিত করিতেছে—এ-কথা বুঝিতে পারি না, কারণ আমরা তো জগৎ হইতে পৃথক্ কোন ইচ্ছার অস্তিত্বের কল্পনাই করিতে পারি না। যখন সেই মুক্ত সত্তা ইচ্ছারূপে পরিণত হয়, দেশকালনিমিত্তের দ্বারাই তাহা হইয়া থাকে। কাণ্টের ব্যাখ্যা গ্রহণ করিলে দেখিব যে, ইচ্ছা—দেশ কাল ও নিমিত্তের মধ্যেই বর্তমান। তাহা হইলে কেমন করিয়া পরম সত্য হইবে? কালের মধ্যে ছাড়া কেহ ইচ্ছা করিতে পারে না।
৩০. ব্রহ্মই যে একমাত্র সত্য বস্তু—এই সিদ্ধান্ত উপনীত হইবার ইঙ্গিত দিতে পারিলেও তাহা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রতীতির মধ্যে আনিয়া দেখাইতে আমরা পারিব না। উদাহরনস্বরূপ এই একত্ব সকল বস্তুতে এমন কি সাধারণ পদার্থের মধ্যেও অবশ্যই অনুস্যূত আছে। মানববুদ্ধিপ্রসূত সামান্যীকরণ-পদ্ধতিকে উদাহরণস্বরূপ নিতে পারি; যা কিছু বিভিন্নতা, তাহা নাম ও রূপের দ্বারাই হইয়াছে; তথাপি যখনই আমরা এই নাম-রূপকে ধরিতে যাই, পৃথক্ করিয়া বুঝিতে যাই, তখনই দেখি ইহাদের অস্তিত্ব কোথাও নাই। নাম, রূপ কারণকে পৃথক্ভাবে আমরা কখন দেখিতে পাই না। তাই এই জগৎ-প্রপঞ্চ মায়া—ব্রহ্মের সত্তার উপরই নির্ভরশীল একটা কিছু, ব্রহ্ম ব্যতীত তাহার কোন অস্তিত্বই নাই। দৃষ্টান্তরূপে সাগরের তরঙ্গকে লওয়া যাক। যতক্ষণ নির্দিষ্ট পরিমাণ জল তরঙ্গের আকারে থাকে, ততক্ষণই তরঙ্গের অস্তিত্ব থাকিবে। কিন্তু যখনই (জলরাশির ঐ আকার মিলাইয়া যায়, উহা সমুদ্রই হইয়া যায়, তখন আর তরঙ্গ থাকে না। সমগ্র জলরাশি তরঙ্গের আকারের উপর নির্ভরশীল নয়। সাগর সর্বদাই বিদ্যমান, কেবল (মাঝে মাঝে) তরঙ্গের আকৃতি একেবারে শূন্য হইয়া যায়।
৩১. সত্য বস্তু এক। মনই সেই এককে বহুরূপে প্রতিভাত করিতেছে। যখন আমরা বিভিন্নতা অনুভব করি, তখন এক-বোধ থাকে না, এবং যখনই একত্বের উপলব্ধি করি, তখন বিভিন্নতা লোপ পায়। ঠিক যেমন প্রাত্যহিক জীবনে—যখন একত্বের অনুভব কর, তখন বিভিন্নতা অনুভব কর না। তোমরা প্রথমে একত্ব হইতে শুরু কর। ইহা বড় অদ্ভুত ব্যাপার যে, প্রথম প্রথম কোন চীনা একজন আমেরিকাবাসীর সঙ্গে অপর আমেরিকাবাসীর আকৃতিগত কোন পার্থক্য বুঝিতে পারে না; এবং তোমরাও (আমেরিকাবাসীরা) বিভিন্ন চৈনিকের পার্থক্য ধরিতে পার না।
৩২. আমাদের মনই যে পদার্থসকলকে জ্ঞানের বিষয় করিয়া দেয়, তাহা দেখানো যাইতে পারে। যে-সব পদার্থের বিশেষ ধর্ম বা গুণ আছে, সগুলিই জ্ঞাত ও জ্ঞেয় পর্যায়ে পড়ে। যাহার কোন ধর্ম বা গুণ নাই, তাহা অজ্ঞেয়। মনে কর, ‘ক’ নামে কোন অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় বহির্জগৎ বর্তমান। যখন আমি এই বহির্জগতের দিকে তাকাইব, তখনই তাহা হইবে ‘ক’+মন। যখন আমি জগৎকে জানিতে চাই , তখন আমার মনই হইবে জ্ঞানের তিন-চতুর্থাংশ উপাদান। অন্তর্জগৎ হইবে ‘খ’+মন, এবং বহির্জগৎ=’ক’+মন। অন্তর্জগৎ ও বহির্জগতের মধ্যে যাহা কিছু পার্থক্য তাহা মনেরই সৃষ্টি, বাকী যাহা কিছু আছে, তাহা অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়। ইহা জ্ঞানের পরিধিরও বাহিরে এবং যাহা কিছু জ্ঞানের অতীত, তাহার বিভাজন বা পৃথক্করণ অসম্ভব। সুতরাং বাহিরের ‘ক’ ও ভিতরের ‘খ’ একই বস্তু। অতএব সত্যবস্তু এক।