পাপ বা খারাপ সম্পর্কে আমাদের কোন মতবাদ নেই। আমরা ইহাকে ‘অজ্ঞান’ বলি।
১৯. মানুষের সঙ্গে সমুদয় ব্যবহার ও সমগ্র নীতিশাস্ত্র—সবই জাগতিক ব্যাপার। সত্য বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে বলা যায় : তাঁহার সম্বন্ধে আমরা বলি, তিনি সৎস্বরূপ চিৎস্বরূপ আনন্দস্বরূপ; ঈশ্বরের উপর অজ্ঞান আরোপ করার কথা চিন্তাই করিব না। চিন্তা বা বাক্য দ্বারা প্রকাশ করিবার সকল প্রয়াসই সেই পরব্রহ্মকে জাগতিক করিয়া ফেলে। ইহাতে ব্রহ্মভাবের বৈশিষ্ট্য নষ্ট হইয়া যায়।
২০. একটি কথা মনে রাখিতে হইবে, ইন্দ্রিয়-জগৎ সম্বন্ধে ঐ ভাবের কথা জোর করিয়া বলা চলে না। কারণ তুমি যদি ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্যে থাকিয়া বলো যে তুমিই ঈশ্বর, তবে অন্যায় কর্ম হইতে কে তোমাকে নিবৃত্ত করিবে? সুতরাং তোমার দেবত্ববিষয়ক দৃঢ় ঘোষণা কেবল পারমার্থিক জগতেই খাটে। আমিই যদি ঈশ্বর হই তবে তো আমি ইন্দ্রিয়-প্রবৃত্তির বহু ঊর্ধ্বে। সুতরাং কোন অন্যায় কাজ আমি করিতে পারি না। নৈতিকতা অবশ্য মানুষর লক্ষ্য নয়, তবে ইহাই ঐ মুক্তভাব লাভ করিবার উপায় মাত্র। বেদান্ত-মতে ‘যোগ’ মানুষের এই দেবত্ব (ব্রহ্মত্ব) অনুভব করিবার একটি উপায় মাত্র। বেদান্ত বলেন, অন্তর্নিহিত মুক্তভাব উপলব্ধি করিলেই ঐ দেবত্বও অনুভব করা যায়। যাহা কিছু বাধা দেয়, সব দূরীভূত হয়। ধার্মিক আচরণ ও নীতিশাস্ত্র প্রভৃতি—যে যাহার আসন যথা স্থানে করিয়া লইবে।
২১. বেদান্ত সাধনার স্থান আছে, ভয়ের স্থান নাই। সব ভয় তখনই চলিয়া যাইবে, যখন তুমি তোমার স্বরূপ দৃঢ়রূপে ঘোষণা করিবে। যদি নিজেকে বদ্ধ বলিয়া মনে কর, বদ্ধই হইয়া থাকিবে; আর মুক্ত বলিয়া মনে করিলে মুক্ত হইয়া যাইবে।
২২. মায়িক জগতে আমরা মুক্তির যে ভাব অনুভব করি, তাহা আভাস মাত্র—যথার্থ মুক্ত নয়।
২৩. বাস্তবিক পক্ষে—জড়, মন ও আত্মায় কোন ভেদ নাই। ঐগুলি সেই একই বস্তুকে অনুভূতি করার বিভিন্ন দিক মাত্র। পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় দ্বারা দেখিলে এই জগৎকেই জড় বস্তু বলিয়া মনে হয়; দুষ্ট লোকের কাছে জগৎটা নরক—সৎ লোকের কাছে স্বর্গ, আর জ্ঞানীর কাছে ইহা ঈশ্বরূপে অনুভূত হয়।
২৪. বেদান্ত মানুষের যুক্তি-বিচার অনেকখানি স্বীকার করে—যদিও এই মতে বুদ্ধি অপেক্ষা উচ্চতর আরও কিছু আছে; কিন্তু বুদ্ধির মধ্য দিয়াই সেখানে পৌঁছিবার পথ।
২৫. মনের চিন্তগুলি (চিত্তবৃত্তি) থামাইতে পারিলে আমরা বুঝিতে পারিব, আমরা চিন্তার পারে। ‘নেতি নেতি’ করিয়া আমরা এ অবস্থায় পৌঁছিতে পারি। ‘নেতি নেতি’ বিচারের দ্বারা ব্যাবহারিক জগৎ লোপ পাইলে যাহা থাকে, তাহাই আমাদের যথার্থ স্বরূপ। যথার্থ স্বরূপ কখনই ব্যক্ত করা যায় না—প্রকাশ করা যায় না, কারণ প্রকাশ করিতে গেলেই তো আবার ইচ্ছার উৎপত্তি হইবে।
২৬. এটি ঠিক যে, আমরা (চিন্তার) একটি প্রণালী সৃষ্টি করি, কিন্তু কোন প্রণালীই যে পূর্ণ নয়, তাহা স্বীকার করিতেই হইবে, কারণ সত্য অবশ্যই সকল প্রণালীর অতীত বস্তু। ইহার সহিত অন্যাণ্য প্রনালীর তুলনা করিতে আমরা প্রস্তুত এবং আলোচনায় এ-কথাও প্রমাণ করা যাইবে যে, এই প্রণালীই সর্বাপেক্ষা যুক্তিসম্মত; তথাপি এ প্রণালীটি পূর্ণ নয়, কারণ বিচার কখনই পূর্ণ নয়। যাহা হউক, এই জ্ঞানযোগই মানবীয় অনুভূতির মধ্যে সর্বাপেক্ষা যুক্তিসম্মত উপায়।
এ-কথা কিছুটা সত্য যে, কোন পদ্ধতি নিজের ভিত্তি সুদৃঢ় করিবার জন্য প্রসারশীল হইবেই। কোন চিন্তাপ্রণালী বেদান্তের মতো এত বেশী বিস্তার লাভ করে নাই। আজও ব্যক্তিগত সংস্পর্শের মাধ্যমেই শিক্ষালাভ অত্যন্ত কার্যকর হইয়া থাকে। বহু গ্রন্থপাঠ করিলেই প্রকৃত মানুষ হয় না। যাঁহারা সত্যিকারের মানুষ ছিলেন, তাঁহারা ব্যক্তিগত সংস্পর্শ পাইয়াই বড় হইয়াছিলেন। প্রকৃত মানুষের সংখ্যা সত্যই অত্যন্ত কম, কিন্তু তাঁহাদের সংখ্যা বাড়িবে। তথাপি এ-কথা কেহ বিশ্বাস করিতে পারে না যে, এমন একদিন আসিবে, যখন আমরা সকলেই দার্শনিক হইয়া যাইব। এ-কথা আমরা বিশ্বাস করি না যে, এমন এক সময় আসিবে,যখন পৃথিবীতে শুধু সুখই থাকিবে, কোন দুঃখ থাকিবে না।
২৭. বেদান্ত-দর্শনই বৌদ্ধধর্মের ও ভারতের অন্যান্য দর্শনগুলির ভিত্তি। কিন্ত অদ্বৈত-দর্শনের আধুনিক সম্প্রদায় বলিতে যাহা বুঝায়, তাঁহারা বৌদ্ধদের অনেকগুলি সিদ্ধান্তই গ্রহণ করিয়াছেন। অবশ্য হিন্দুগণ—অর্থাৎ গোঁড়া হিন্দুগণ কখনই তাহা স্বীকার করিবে না, কারণ তাহাদের কাছে বৌদ্ধেরা বিরুদ্ধবাদী। কিন্তু সমগ্র অদ্বৈতবাদ সম্প্রসারিত করিয়া বিরুদ্ধবাদীদেরও ইহার অন্তর্ভুক্ত করিবার একটা প্রচেষ্টা সচেতনভাবেই চলিয়াছে।
২৮. বৌদ্ধধর্মের সহিত বেদান্তের কোন বিরোধ নাই। সকল মতের সমন্বয়-সাধনই বেদান্তের ভাব। উত্তরদিকের (মহাযান) বৌদ্ধগণের সহিত আমাদের মোটেই কোন বিরোধ নাই। কিন্তু ব্রহ্মদেশ, শ্যাম ও দক্ষিণাংশের (হীনযান) বৌদ্ধগণের মতে এই ব্যাবহারিক জগৎ সত্যই আছে এবং তাঁহারা জিজ্ঞাসা করেন : এই জগতের পিছনে পারমার্থিক জগৎ সৃষ্টি করিবার আমাদের কি অধিকার আছে? এ-বিষয়ে বেদান্তের উত্তর এই যে, বিবৃতিটি ভ্র্মাত্মক। কারণ বেদান্ত কখনই বিবাদ করিয়া বলে না যে, একটি পারমার্থিক জগৎ ও একটি ব্যাবহারিক জগৎ বিদ্যমান। বেদান্তের মতে সত্য এক, তাহাকে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে দিয়া ব্যাবহারিক জগৎ বলিয়া মনে হয়, কিন্তু এটি প্রকৃতপক্ষে সর্বদাই পারমার্থিক। যে রজ্জু দেখে , সে সর্প দেখে না। হয় রজ্জু, নয় সর্প, কিন্তু একই সময়ে কখনই দুইটি নয়। সুতরাং আমরা দুইটি জগতের অস্তিত্ব মানি—আমাদের মতবাদ সম্পর্কে বৌদ্ধদের এই বিবৃতি একেবারেই অমূলক। যদি তাহারা চায়, তাহাদের বলিবার অধিকার আছে, জগৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য; কিন্তু তাই বলিয়া অপরের ইহাকে পারমার্থিক বলিবার কোন অধিকার নাই—এরূপ বিবাদ করিবার অধিকার তাহাদের নাই।