———-
১ জাত্যন্তরপরিণামঃ প্রকৃত্যাপূরাৎ।—যোগসুত্র, কৈবল্যপাদ, ২
২ নিমিত্তম প্রয়োজকং প্রকৃতীনাং বরণভেদস্তু ততঃ ক্ষেত্রিকবৎ।—ঐ, ৩
৮. প্রতিটি জীব একটি বৃত্ত। বৃত্তের কেন্দ্র শরীরেই অবস্থিত এবং কার্য-শক্তি সেখানেই প্রকাশিত। তুমি সর্বত্র বিদ্যমান, যদিও তুমি বোধ কর—তুমি শুধু একটি বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত। সেই কেন্দ্রটি জড়কণাগুলি সংগ্রহ করিয়া নিজেকে প্রকাশ করিবার জন্য একটি যন্ত্র নির্মাণ করিয়াছে। যাহার মাধ্যমে আত্মা নিজেকে প্রকাশ করিতেছে, তাহাকেই শরীর বলে। তুমি সর্বত্র বিরাজমান। যখন একটি দেহ বা যন্ত্র তোমার উদ্দেশ্য সাধন করিতে পারে না, তখন কেন্দ্রটি সরিয়া গিয়া অন্য সূক্ষ্ম বা স্থূল জড়কণা সংগ্রহ করে এবং সেগুলির মাধ্যমে কাজ করে। এই হইল জীব বা মানুষ। আর ঈশ্বর কি? ঈশ্বর একটি বৃত্ত, যাহার পরিধির সীমা নাই এবং কেন্দ্র সর্বত্র। সেই বৃত্তের প্রত্যেক বিন্দু জীবন্ত, সচেতন, সক্রিয় এবং সমভাবে কর্ম করিতেছে। আমাদের সীমাবদ্ধ জীবাত্মাসমূহের কেবল একটি বিন্দু চেতনাময় এবং সেই বিন্দুটি সম্মুখে ও পশ্চাতে আন্দোলিত হয়।
আত্মা একটি বৃত্ত, যাহার পরিধি সীমাহীন, কিন্তু কেন্দ্র কোন একটি দেহে অবস্থিত। মৃত্যু শুধু এই কেন্দ্রের সামান্য পরিবর্তন। ঈশ্বর একটি বৃত্ত , যাহার পরিধির সীমা নাই এবং কেন্দ্র সর্বত্র অবস্থিত। আমরা যখন সীমাবদ্ধ দেহের এই কেন্দ্র হইতে বাহিরে আসিতে পারিব, তখনই আমাদের যথার্থ স্বরূপ—ঈশ্বরকে উপলব্ধি করিতে পারিব।
৯. প্রত্যেক আত্মায় দেবত্ব অন্তর্নিহিত। বাহ্য-ও অন্তঃ-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত করিয়া এই অন্তর্নিহিত দেবত্বের বিকাশ সাধন করাই জীবনের লক্ষ্য। কর্ম, ভক্তি, যোগ ও জ্ঞান—ইহাদের যে-কোন একটি অবলম্বন করিয়া অথবা একাধিক বা সকলগুলির সাহায্যে এই দেবত্ব বিকাশ কর এবং মুক্ত হও। ইহাই তো ধর্মের আদি অন্ত। মতবাদ, বদ্ধ ধারণা, আচার-অনুষ্ঠান, শাস্ত্র-মন্দির বা পদ্ধতি ধর্মের গৌণ অঙ্গমাত্র।
১০. ধর্মবিষয়ক কোন বিশেষ মতে বিশ্বাস না থাকাই জ্ঞান, কিন্তু এ-কথার অর্থ ইহা নয় যে, জ্ঞান কোন ধর্মমতকে ঘৃণা করে। জ্ঞানের দ্বারা বোঝায় যে, ধর্মমতের ঊর্ধ্বে এক অবস্থা লাভ করা গিয়াছে। জ্ঞানী(যথার্থ দার্শনিক) কোন কিছুই ধ্বংস করিতে চান না, বরং সকলকেই সাহায্য করিতে চেষ্টা করেন। নদী যেমন তাহাদের জলধারা সাগরে বহন করিয়া লইয়া যায় এবং সেখানে সব এক হইয়া যায়, তেমনি সকল ধর্মমতের গতি জ্ঞানের অভিমুখে এবং সেখানেই এক হইয়া যায়।
জ্ঞানযোগ সংসার ত্যাগ করিতে শিক্ষা দেয়, কিন্তু তাই বলিয়া পরাজিত মনোভাব লইয়া সংসার ছাড়িতে বলে না। ত্যাগের প্রকৃত পরীক্ষা—সংসারে থাকিয়াও সংসারের না হওয়া।
১১. বেদানী বলেন : মানুষের জন্ম নাই, মৃত্যুও নাই; মানুষ স্বর্গেও যায় না। আত্মার সম্পর্কে পুনর্জন্ম-প্রসঙ্গ প্রকৃতপক্ষে যেন একটি পৌরানিক কাহিনী। একখানি পুস্তকের পৃষ্ঠা উল্টানোর উদাহরণ দেওয়া হয়। পুস্তকের বিষয়বস্তুরই ক্রমবিকাশ হয়, মানুষের নয়। আত্মা সর্বত্র বিদ্যমান, সুতরাং তাহার আবার আসা-যাওয়া কোথায়? এই জন্ম-মৃত্যু প্রকৃতির অন্তর্গত পরিবর্তন মাত্র। এগুলিকে আমরা নিজেদের পরিবর্তন বলিয়া ভুল করি।
১২. পুনর্জন্ম প্রকৃতির ক্রমবিকাশ এবং অন্তর্নিহিত দেবত্বের অভিব্যক্তি।
১৩. বেদান্ত বলেন : অতীতের ভিত্তির উপরই এই জীবন গঠিত হইয়াছে এবং যখনই আমাদের সমগ্র অতীতকে দেখিতে পাইব, তখনই আমরা মুক্ত হইব। শৈশব হইতেই মুমুক্ষুত্ব বা মুক্ত হইৱার ইচ্ছা ধর্মভাবের আকার ধারণ করে। কয়েক বৎসরের মধ্যে যেন সকল তত্ত্ব স্পষ্ট হইয়া যায়। এই দেহ ত্যাগ করিয়া এবং পরিবর্তী জীবনের জন্য অপেক্ষামাণ জীবাত্মা—প্রাকৃতিক জগতেই বাস করে।
১৪. মুক্ত মানুষের কাছে এই জীবন-সংগ্রামের মূল্য কখনও ছিল না। কিন্তু আমাদের কাছে ইহার অর্থ আছে, কারণ নাম এবং রূপই তো জগৎ সৃষ্টি করে
১৫. প্রথম হইতেই সকল জ্ঞান আমাদের মধ্যে সঞ্চিত থাকে—এই কথার ব্যতিক্রম কিভাবে হইতে পারে, আমি তো বুঝিতে পারি না। যদি তুমি এবং আমি সাগরের ছোট ছোট তরঙ্গ হই, তবে সেই সাগরই তো অলক্ষ্যে সকলের পিছনে রহিয়াছে।
১৬. এই কয়টি কথায় আত্মাকে বর্ণনা করিতে পারি : এই আত্মাকে তরবারি ছেদন করিতে পার না, বর্শা ভেদ করিতে পারে না, আগুন দগ্ধ করিতে পারে না, জলও তাঁহাকে দ্রবীভূত করিতে পারে না। আত্মা অবিনাশী ও সর্বত্র বিদ্যমান, সুতরাং আত্মার জন্য শোক করিও না।
১৭. যদি কেহ খুব খারাপ হইয়া থাকে, আমরা বিশ্বাস করি, সে ভবিষ্যতে আবার ভাল হইবে। মূল তত্ত্ব এই—সকল শাশ্বত মুক্তির জন্য সংগ্রাম করিতে হইবে। মুক্তিলাভের ইচ্ছা দ্বারা প্রণোদিত হইয়া আমাদের মুক্ত হইবার বাসনা ব্যতীত অন্য সব বাসনাই ভ্রান্তিজনক। বেদান্ত-মতে প্রত্যেক সৎকর্মই মানুষের সেই মুক্তভাবের প্রকাশ।
পৃথিবীতে এমন একটা সময় আসিবে, যখন সব অশুভ অন্তর্হিত হইবে—এ-কথা আমি বিশ্বাস করি না। তাহা কেমন করিয়া হইবে? নদী বহিয়া চলিয়াছে—একদিকে জলরাশি চলিয়া যাইতেছে, অপর দিকে আবার জলরাশি আসিয়া উপস্থিত হইতেছে।
১৮. বেদান্ত বলেন : তুমি স্বরূপতঃ শুদ্ধ ও পূর্ণ; শুভ ও অশুভের অতীত একটি অবস্থা আছে, সেটিই তোমার স্বভাব। এই অবস্থা শুভ অপেক্ষাও উচ্চতর। ভাল—মন্দ অপেক্ষা অল্প-বিচ্যুত অবস্থা মাত্র।