৫. পৃথিবীর ধর্মগ্রন্থগুলির মধ্যে একমাত্র বেদই ঘোষণা করেন, বেদাধ্যয়নও গৌণ। সেই বিদ্যাই পরা বিদ্যা, যাহা দ্বারা আমরা অক্ষর বা ব্রহ্মকে উপলব্ধি করি।১ সেই বিদ্যা শুধু পাঠ নয়, শুধু বিশ্বাস বা বিচার নয়, পরন্তু অতীন্দ্রিয় অনুভূতি বা সমাধি।
———-
১ মুণ্ডক উপ., ১/১/৫
৬. মায়ার কারণ কি?—গত তিন হাজার বৎসর ধরিয়া এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসিত হইতেছে। ইহার একমাত্র উত্তর : যখন যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রশ্নটি উত্থাপিত হইবে, তখনই আমরা ইহার উত্তর দিব। প্রশ্নটি স্ববিরোধী। আমাদের বক্তব্য এই যে, পরব্রহ্ম যেন আপেক্ষিক জগৎ হইয়াছেন। সেই নিত্যমুক্ত ব্রহ্ম শুধু মায়াতে যেন কার্যকারণে বদ্ধ হইয়াছেন। যখন স্বীকার করা হইয়াছে যে, ব্রহ্ম নিত্যমুক্ত, তখনই মানিয়া লইতে হইবে—পরব্রহ্মে কোন-কিছু ক্রিয়াব্যাপার হইতে পারে না। ব্রহ্ম কারণাতীত। ইহার অর্থ—ব্রহ্ম-ব্যতিরিক্ত কোন কিছু ব্রহ্মের উপর ক্রিয়া করিতে পারে না। প্রথমতঃ ব্রহ্ম যদি কারণাতীত হন, তবে কোন কিছুই তাঁহার উপর ক্রিয়া করিতে পারে না। নিত্যমুক্ত ব্রহ্মে দেশ কাল নিমিত্ত থাকিতে পারে না। ইহা মানিয়া লইলে প্রশ্নটি দাঁড়াইবে: যাহার কোন কারণ নাই, তাহার কারণ কি? তাহা কিভাবে এইরূপে পরিবর্তিত হইল? কার্যকারণের জগতেই তোমার এই প্রশ্ন সম্ভব। তুমি কিন্তু পরব্রহ্ম বিষয়ে এই প্রশ্ন করিতে চাহিতেছ। কেবল যখন পরব্রহ্ম কার্যকারণাত্বক জগতে রূপান্তরিত হন এবং দেশ-কাল-নিমিত্তের আবির্ভাব হয়, তখনই এই প্রশ্ন করা যাইতে পারে। আমরা এই মাত্র বলিতে পারি যে, অবিদ্যাই ভ্রম সৃষ্টি করে। এই প্রশ্ন অসম্ভব। ব্রহ্মের উপ কোন কিছুর ক্রিয়া সম্ভব নয়।
না, কোন কারণ ছিল না। আমরা জানি না বা আমরা অজ্ঞ, তাহা নয়, ব্রহ্ম জ্ঞানের বাহিরে; এবং তাঁহাকে জ্ঞানের রাজ্যে আনা যাইতে পারে না ‘আমি জানি না’—এই শব্দগুলি দুই অর্থে ব্যবহার করিতে পারি। একভাবে ইহাদের অর্থ এই যে, আমরা জ্ঞানের নিম্নে আছি, অন্যভাবে ইহাদের অর্থ—এই বস্তু জ্ঞানের উপরে অবস্থিত। রঞ্জনরশ্মি এখন সুবিদিত। ইহার কারণ সম্বন্ধে দ্বিমত আছে, কিন্তু আমরা নিশ্চয়ই একদিন ইহার কারণ জানিতে পারিব। রঞ্জনরশ্মি সম্বন্ধে আমরা বলিতে পারি যে, উহার কারণ আমরা জানি না। কিন্তু ব্রহ্ম-বিষয়ে আমরা জনিতে পারি না। রঞ্জনরশ্মির ক্ষেত্রে আমরা জানি না। যদিও উহা জ্ঞানের অন্তর্গত; শুধু এখন পর্যন্ত আমরা জানি না। কিন্তু ব্রহ্ম পরোক্ষ-জ্ঞানের এত ঊর্ধ্বে যে, তিনি কখনও জ্ঞেয় হইতে পারেন না। কি উপায়ে জ্ঞাতা জ্ঞেয় হইতে পারে?১ তুমি সতত স্বয়ংপূর্ণ, এবং নিজেকে বিষয়ীভূত করিতে পার না। অমৃতত্ব প্রমাণ করিবার জন্য এই যুক্তিটি আমাদের দার্শনিকেরা ব্যবহার করিতেন : যদি আমি চিন্তা করিতে চেষ্টা করি যে, আমি শায়িত মৃতদেহ, তাহা হইলে আমাকে কি কল্পনা করিতে হইবে? আমিই দাঁড়াইয়া নিজেকেই দেখিতেছি—দেখিতেছি, একটা মৃতদেহ পড়িয়া রহিয়াছে। অতএব আমি নিজেকে আমার দর্শনের বিষয়ীভূত করিতে পারি না।
———-
১ বৃহদারণ্যক উপ., ২/১৪; ১/১৫
৭. ক্রমবিকাশ : স্থূল বিকাশে—আকাশ এবং প্রাণের অভিক্ষেপ ও উহাদের সূক্ষ্ম অবস্থায় প্রত্যাবর্তন-ব্যাপারে—ভারতীয় চিন্তা ও আধুনিক বিজ্ঞানে অনেকাংশে সাদৃশ্য আছে ,আধুনিক বিজ্ঞান অভিব্যক্তি সম্বন্ধে স্বকীয় মত আছে, যোগীদেরও আছে। কিন্তু আমার মনে হয়, যোগীদের অভিব্যক্তি-ব্যাখ্যা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। ‘প্রকৃতির আপূরণের দ্বারা এক প্রজাতি অন্য প্রজাতিতে পরিণত হয়।’১ মূল ভাবটি এই যে, আমরা এক প্রজাতি হইতে অপর এক প্রজাতিতে পরিণত হইতেছি এবং মানুষই শ্রেষ্ঠ প্রজাতি। চাষী যেমন ভূসিঞ্চন করে—এই উপমার দ্বারা পতঞ্জলি প্রকৃতির আপূরণ ব্যাখ্যা করিয়াছেন।২ আমাদের শিক্ষা ও প্রগতির একমাত্র অর্থ হইতেছে অন্তরায়গুলি অপসারিত করা, তাহা হইলে স্বভাবতই ঈশ্বরত্ব বিকশিত হইবে। ইহা দ্বারা জীবন-সংগ্রামের মতবাদ খণ্ডিত হয়। জীবনের দুঃখকর অভিজ্ঞতাগুলি পথেই অনুভূত হয়, এবং ঐগুলি নিঃশেষে অপসারিত করা যায়। ক্রমবিকাশের জন্য অভিজ্ঞতাগুলির প্রয়োজন হয় না। ঐগুলি না থাকিলেও আমাদের অগ্রগতি হইবে। বস্তুর স্বভাবই হইল বিকশিত হওয়া। গতিবেগ বা প্রেরণা (momentum) বাহিরের বস্তু নয়, উহা কিন্তু ভিতর হইতে আসে। প্রত্যেক জীবাত্মা পূর্ব হইতেই কুণ্ডলীকৃত সর্বজনীন অভিজ্ঞতার সমষ্টি এবং এই-সব অভিজ্ঞতার মধ্যে যেগুলি প্রকাশের অনুকুল পথ পাইবে, সেগুলিই বাহির হইয়া আসিবে।
সুতরাং বাহিরের বস্তুগুলি আমাদের জন্য শুধু প্রয়োজনীয় আবেষ্টনী করিয়া দিতে পারে। যে-সকল প্রতিযোগিতা, সংগ্রাম এবং অশুভ আমরা দেখিতেছি, সেগুলি ক্রমসঙ্কোচের ফল বা কারণ নয়। সেগুলি জীবনের পথে আসিয়া থাকে। সেগুলি না থাকিলেও মানুষ অগ্রসর হইবে এবং ঈশ্বররূপে বিকশিত হইবে, কারণ ঈশ্বরের স্বভাবই বাহির হইয়া আসা ও নিজেকে বিকাশ করা। প্রতিযোগিতার ভয়াবহ ভাবের পরিবর্তে এই ভাবটি আমার অত্যন্ত আশাপ্রদ বলিয়া মনে হয়। যতই ইতিহাস পাঠ করি, ততই মনে হয়, প্রতিযোগিতার ভাবটি ভুল। কেহ কেহ বলে যে, মানুষ যদি মানুষের সহিত যুদ্ধ না করিত, তাহা হইলে সে উন্নতি করিতে পারিত না। আমিও অনুরূপ চিন্তা করিতাম। কিন্তু এখন দেখি যে, প্রত্যেকটি যুদ্ধ মানুষের উন্নতি ত্বরান্বিত না করিয়া পঞ্চাশ বৎসর পিছাইয়া দিয়াছে।