প্র। সম্প্রদায়, অনুষ্ঠান, শাস্ত্র—এ-সকল কি তত্ত্ব-সাক্ষাৎকারের সহায়ক?
উ। তত্ত্ব-সাক্ষাৎকার হইলে মানুষ সব ছাড়িয়া দেয়। বিভিন্ন সম্প্রদায়, অনুষ্ঠান ও শাস্ত্র যতটা সেই অবস্থায় পৌঁছিবার উপায়-স্বরূপ হয়, ততটা উহাদের উপকারিতা আছে। কিন্তু যখন উহাদের দ্বারা ঐ সহায়তা না পাওয়া যাইবে, তখন অবশ্য উহাদিগের পরিবর্তন সাধন করিতে হইবে।
ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্মসঙ্গিনাম্।
যোজয়েৎ সর্বকর্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্।।১
———-
১ গীতা, ৩/২৬
সক্তাঃ কর্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্বন্তি ভারত।
কুর্যাদ্ বিদ্বান্ তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্লোকসংগ্রহম্।।১
—জ্ঞানী ব্যক্তি অজ্ঞানীদের অবস্থার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করিবেন না, আর তাহাদের নিজ নিজ সাধনপ্রণালীতে তাহাদের বিশ্বাস নষ্ট করিবেন না, কিন্তু যথার্থভাবে তাহাদিগকে পরিচালিত করিবেন, এবং তিনি স্বয়ং যে অবস্থায় আছেন সেই অবস্থায় পৌঁছিবার পথ প্রদর্শন করিবেন।
প্র। আমিত্ব ও চারিত্রনীতি—বেদান্ত কিরূপ ব্যাখ্যা করিয়া থাকে?
উ। প্রকৃত আমিত্ব সেই পূর্ণব্রহ্ম—মায়া দ্বারাই উহা পৃথক্ পৃথক্ ব্যক্তির আকার ধারণ করিয়াছে। আপততঃ এইরূপ বোধ হইতেছে মাত্র, প্রকৃত-পক্ষে উহা সদাই সেই পূর্ণব্রহ্মস্বরূপ। প্রকৃতপক্ষে এক সত্তাই বর্তমান—মায়া দ্বারাই উহা বিভিন্ন রূপে প্রতীয়মান হইতেছে। মায়াতেই এইরূপ ভেদবোধ হইয়াছে। কিন্তু এই মায়ার ভিতরেও সর্বদাই সেই একের দিকে ফিরিয়া যাইবার চেষ্টা রহিয়াছে। প্রত্যেক জাতির চারিত্রনীতির ভিতর ঐ চেষ্টাই অভিব্যক্ত হইয়াছে, কারণ ইহা জীবাত্মার প্রকৃতিগত প্রয়োজন। সে ঐরূপ চেষ্টায় ঐ একত্ব লাভ করিতেছে আর একত্বলাভের এই চেষ্টাকেই আমরা চারিত্রনীর্তি-নামে অভিহিত করিয়া থাকি। অতএব আমাদের সর্বদা নীতি-পরায়ণ হওয়া আবশ্যক।
প্র। চারিত্রনীতির অধিকাংশই কি বিভিন্ন ব্যক্তির সম্বন্ধ লইয়াই ব্যাপৃত নয়?
উ। চারিত্রনীতির সবটাই ঐ। পূর্ণব্রহ্ম কখন মায়ার গণ্ডির ভিতর আসিতে পারে না।
প্র। আপনি বলেন, ‘আমি’ই সেই পূর্ণব্রহ্ম; আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে যাইতেছিলাম : এই ‘আমি’র জ্ঞান আছে কি না?
উ। ‘আমি’টা সেই পূর্ণব্রহ্মের প্রকাশস্বরূপ, আর এই ব্যক্ত অবস্থায় তাহাতে যে প্রকাশ-শক্তি কার্য করে, তাহাকেই আমরা ‘জ্ঞান’ বলি। অতএব সেই পূর্ণব্রহ্মের জ্ঞানস্বরূপে ‘জ্ঞান’ শব্দের প্রয়োগ যথাযথ নয় , কারণ পূর্ণবস্থা আপেক্ষিক জ্ঞানের অতীত।
প্র। আপেক্ষিক জ্ঞান কি পূর্ণ জ্ঞানের অন্তর্গত?
উ। হাঁ, একভাবে আপেক্ষিক জ্ঞানকে পূর্ণ জ্ঞানের অন্তর্গত বলিতে পারা যায়। যেমন একটা মোহর ভাঙাইয়া তাহা হইতে পয়সা সিকি দুয়ানি টাকা প্রভৃতি সর্বপ্রকার মুদ্রা প্রস্তুত করিতে পারা যায়, সেইরূপ ঐ পূর্ণ অবস্থা হইতে সর্বপ্রকার জ্ঞান লাভ করা যাইতে পারে। উহা অতিচেতন, জ্ঞানতীত বা পূর্ণ জ্ঞানাবস্থা – সাধারন জ্ঞান অজ্ঞান উভয়ই ইহার অর্ন্তগত। যে, ব্যক্তি ঐ অবস্থা লাভ করে, আমাদের পরিচিত ‘জ্ঞানবস্থা’টিও তাহার সম্যক্রূপে থাকে। যখন সে জ্ঞানের ঐ অপর অবস্থা অর্থাৎ আমাদের সাধারণ জ্ঞানাবস্থার ন্যায় অবস্থা অনুভব করিবার ইচ্ছা করে, তখন তাহাকে একধাপ নামিয়া আসিতে হয়। এই সাধারণ জ্ঞান একটি নিম্নগর অবস্থা—মায়ার ভিতরেই কেবল এইরূপ জ্ঞান হওয়া সম্ভব।
———-
১ গীতা, ৩/২৫
০৩. প্রশ্নের উত্তর ও আলোচনার অংশ
১৮৯৬ খৃঃ ২২শে ও ২৪শে মার্চ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বৈকালীন আসরে প্রশ্নোত্তর হইতে গৃহীত, এবং স্বামীজীর অপ্রকাশিত বক্তৃতা ও আলোচনা হইতেও কিছু সংযোজিত হইয়াছে।
১. যুক্তি-বিচারের সহিত যতটুকু মেলে, ব্যক্তিগতভাবে আমি বেদের ততটুকুই গ্রহন করি।বেদের কোন কোন অংশ স্পষ্টতই পরম্পর বিরোধী। বেদসমূহ পাশ্চাত্য অর্থে প্রত্যাদিষ্ট বলিয়া মনে করা হয় না, উহারা জ্ঞাসমষ্টি বলিয়াই সর্ববিজ্ঞান। এই জ্ঞান কল্পাপরম্ভে আত্মপ্রকাশ করে এবং কল্পশেষে অব্যক্ত হয়। যখন কল্প পুনঃপ্রকাশিত হয়, সেই জ্ঞানও কল্পের সহিত প্রকাশিত হয়। এ পর্যন্ত তত্ত্বটি ঠিক আছে। কিন্তু শুধু বেদ-নামক শাস্ত্র-গ্রন্থগুলিতেই এই সব জ্ঞান আছে—এ-কথা কুতর্কমাত্র। এক স্থলে মনু বলিয়াছেন, বেদের যে-অংশ যুক্তি-বিচারের সহিত মেলে, সেই অংশই বেদ বাকী অংশ নয়। আমাদের দার্শনিকগণ অনেকেই এই মত পোষণ করেন।
২. অদ্বৈত-দর্শনের বিরুদ্ধে যাবতীয় সমালোচনা এই কয়টি কথায় সংক্ষেপে বলা যায় : এই দর্শন ইন্দ্রিয়-ভোগের সহায়ক নয়। আমরা সানন্দে ইহা স্বীকার করি।
৩. বেদান্ত-মতের আরম্ভ প্রচণ্ড দুঃখবাদে এবং সমাপ্তি প্রকৃত আশাবাদে। আমরা ইন্দ্রিয়ের আশাবাদ অস্বীকার করি, কিন্তু অতীন্দ্রিয় সত্যের প্রকৃত আশাবাদ স্বীকার করি। আমরা বিশ্বাস করি যে, প্রকৃত সুখ ইন্দ্রিয়-সম্ভোগে নাই, অতীন্দ্রিয় অবস্থায় আছে; এবং প্রত্যেকের মধ্যেই সেই প্রকৃত সুখ আছে। সংসারে আমরা যে ধরনের আশাবাদ লক্ষ্য করি উহা ইন্দ্রিয়-পথে মানুষকে বিনাশের দিকেই লইয়া যায়।
৪. দর্শনশাস্ত্রে আত্মত্যাগের গুরুত্ব সর্বাধিক। এই ত্যাগের অর্থ যথার্থ স্বরূপকে স্বীকার করা। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকে অস্বীকার করে বলিয়া এই ত্যাগ দুঃখবাদাত্মক ,কিন্তু প্রকৃত জগৎকে গ্রহণ করে বলিয়া ইহা আশাবাদী।