১ বিবেকাচূড়ামণি, ৬০—শঙ্করাচার্য
অনর্গল সদ্বাক্যযোজনা, শাস্ত্রব্যাখ্যা করিবার বিভিন্ন কৌশল—এ-সব কেবল পণ্ডিতদের আমোদের জন্য, উহার দ্বারা মুক্তিলাভের কোন সম্ভাবনা নাই।
যদি আমরা ব্রহ্মসাক্ষাৎকার করিতে পারি, তবেই মুক্তিলাভ করিব।
প্র। আধ্যাত্মিক বিষয়ে সর্বসাধারণের এই স্বাধীনতার সহিত জাতিভাদপস্বীকারের কি সামঞ্জস্য আছে?
উ। কখনই নাই। লোকে বলিয়া থাকে, জাতিভেদ থাকা উচিত নয়। এমন কি যাহারা বিভিন্ন জাতিভুক্ত তাহারাও বলে, জাতিবিভাগ একটা খুব উঁচুদরের জিনিস নয়। কিন্তু তাহারা সঙ্গে সঙ্গে ইহাও বলে যে, আমাদের ইহা অপেক্ষা ভাল অন্য কোন জিনিস দাও, আমরা ইহা ছাড়িয়া দিব তাহারা বলে, তোমরা ইহার বদলে আমাদিগকে কি দিবে? জাতিভেদ কোথায় নাই? তোমরাও তো তোমাদের দেশে ক্রমাগত এইরূপ একটা জাতিবিভাগ গড়িবার চেষ্টা করিতেছে। কোন ব্যক্তি কিছু অর্থ সংগ্রহ করিতে পারিলেই বলিয়া বসে, কয়েক শত ধনীর মধ্যে আমিও একজন। আমরাই কেবল একটা স্থায়ী জাতিবিভাগ গৃঠন করিতে সমর্থ হইয়াছি। অপরে উহার জন্য চেষ্টা করিতেছে, কিন্ত সফল হইতেছে না। আমাদের সমাজে অবশ্য যথেষ্ট কুসংস্কার ও মন্দ জিনিস আছে। আপনাদের দেশের কুসংস্কার ও মন্দ জিনিসগুলি আমাদের দেশে চালাইয়া দিতে পারিলেই কি সব ঠিক হইয়া যাইবে? জাতিভেদ আছে বলিয়াই এই ত্রিশ কোটি লোক এখনও খাইবার এক টুকরা রুটি পাইতেছে। অবশ্য রীতিনীতি হিসাবে ইহা যে অসম্পূর্ণ, তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। কিন্তু এই জাতিবিভাগ না থাকিলে আপনারা পড়িবার জন্য একখানি সংস্কৃত বইও পাইতেন না। এই জাতিবিভাগের দ্বারা এমন একটি দৃঢ় প্রাচীরের সৃষ্টি হইয়াছিল যে, উহার উপর বহিরাক্রমণের শত প্রকার তরঙ্গাঘাত আসিয়া পড়িয়াছে, অথচ কোনমতেই উহাকে ভাঙিতে পারে নাই। এখনও সেই প্রয়োজন দূর হয় নাই, সেজন্য জাতিভেদ এখনও রহিয়াছে। সাত শত বর্ষ পূর্বে যেরূপ জাতিবিভাগ ছিল,এখন আর সেরূপ নাই। যতই উহার উপর আঘাত লাগিয়াছে, ততই উহা দৃঢ়তর আকার ধারণ করিয়াছে। এটি কি লক্ষ্য করিয়াছেন যে, একমাত্র ভারতই কখন পররাষ্ট্র-বিজয়ে নিজ দেশের বাহিরে যায় নাই? মহামতি সম্রাট্ অশোক বিশেষ করিয়া বলিয়া গিয়াছেন যে, তাঁহার উত্তরাধিকারীরা কেহ যেন পররাষ্ট্র-বিজয়ের চেষ্টা না করে। যদি অপর জাতি আমাদের নিকট শিক্ষক পাঠাইতে চায় পাঠাক, কিন্তু তাহারা যেন আমাদের বাস্তবিক সাহায্য করে, আমাদের জাতীয় সম্পত্তিরূপ ধর্মভাবের অনিষ্ট সাধন না করে। এইসব বিভিন্ন জাতি হিন্দুজাতিকে জয় করিতে আসিল কেন? হিন্দুরা কি অপর জাতির কোন অনিষ্ট করিয়াছিল? তাহারা যতটুকু সাধ্য জগতের উপকারই করিয়াছিল। তাহারা জগৎকে বিজ্ঞান দর্শন ও ধর্ম শিখাইয়াছিল এবং পৃথিবীর অনেক অসভ্য জাতিকে সভ্য করিয়াছিল। কিন্তু তাহারা প্রতিদানে পাইয়াছিল শুধু হত্যা, অত্যাচার ও ‘অবিশ্বাসী বদমাশ’—এই আখ্যা। বর্তমানকালেও পাশ্চাত্য ব্যক্তিদের লিখিত ভারত সমন্ধে গ্রন্থাবলী এবং ভারত ভ্রমনকারীদের লিখিত গল্পগুলি পড়ুন; কোন্ অনিষ্টের প্রতিশোধ লইবার জন্য ভারতবাদীদের এখনও এইরূপ কটুবাক্য বর্ষণ করা হইয়া থাকে?
[প্র। সভ্যতা সম্বন্ধে বৈদান্তিক ধারণা কিরূপ?]
উ। আপনারা দার্শনিক, আপনাদের মতে অবশ্য একতোড়া টাকা থাকা-না-থাকা লইয়া মানুষে মানুষে কখনও প্রভেদ হইতে পারে না। এইসব কলকারখানা ও জড়বিজ্ঞানের মূল্য কি? উহাদের একটি মাত্র ফল এই যে, উহারা জ্ঞান বিস্তার করিয়া থাকে। আপনারা অভাব বা দারিদ্র-সমস্যা পূরণ করিতে পারেন নাই, বরং অভাবের মাত্রা আরও বাড়াইয়াছেন। কলকব্জায় কখন দারিদ্র্য-সমস্যার সমাধান হইতে পারে না। উহাদের দ্বারা কেবল সংগ্রামই বাড়িয়া যায়, প্রতিযোগিতাই তীব্রতর হইয়া থাকে। জড় প্রকৃতির কি স্বতন্ত্র কোন মূল্য আছে? কোন ব্যক্তি যদি তারের মধ্য দিয়া তড়িৎপ্রবাহ চালাইতে পারে, আপনারা অমনি তাহার স্মৃতিচিহ্ন স্থাপন করিতে উদ্যোগী হন কেন? প্রকৃতি কি লক্ষ লক্ষ বার এই ব্যাপারে সাধন করিতেছে না? প্রকৃতিতে কি পূর্ব হইতেই এ-সব বিদ্যমান নাই? উহা পাইলে আপনার বিশেষ কি লাভ হইল? উহা তো পূর্ব হইতেই সেখানে রহিয়াছে। উহার একমাত্র মূল্য এই যে, উহা আমাদের উন্নতি সাধন করে। এই জগৎটা একটি ব্যায়মাগারের মতো; এখানে জীবাত্মা কর্ম দ্বারা উৎকর্ষ সাধন করিতেছে, এবং এই উৎকর্ষ-সাধনের ফলেই আমরা দেবতা হই। সুতরাং কোন্ বিষয় ভগবানের কতটা প্রকাশ তাহা জানিয়াই প্রত্যেক বিষয়ের মূল্য বা সারবত্তা নির্ধারণ করিতে হইবে। মানুষের মধ্যে ঈশ্বরত্বের এইরূপ প্রকাশই সভ্যতা।
প্র। বৌদ্ধদের কি কোন জাতিবিভাগ আছে?
উ। বৌদ্ধদের কখনই বড় বিশেষ জাতিবভাগ ছিল না, এবং ভারতে বৌদ্ধসংখ্যা অতি অল্প। বুদ্ধ একজন সমাজসংস্কারক ছিলেন। তথাপি আমি বৌদ্ধ দেশসমূহে দেখিয়াছি, সেখানে জাতিবিভাগ সৃষ্টি করিবার জন্য প্রবল চেষ্টা হইয়াছে, কিন্তু ঐ চেষ্টা সফল হয় নাই। বৌদ্ধদের জাতিবিভাগ কার্যতঃ কিছুই নয়, কিন্তু তাহারা মনে মনে নিজেদের উচ্চ জাতি বলিয়া গর্ব করিয়া থাকে।
বুদ্ধ অন্যতম বেদান্তবাদী সন্ন্যাসী ছিলেন। তিনি একটি নূতন সম্প্রদায় স্থাপন করিয়াছিলেন ,যেমন আজকালও অনেক নূতন সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকে। যে-সব ভাব এখন বৌদ্ধধর্ম বলিয়া অভিহিত, সেগুলি তাঁহার নিজের নয়। সেগুলি অতি প্রাচীন। তিনি একজন মহাপুরুষ ছিলেন, এবং ভাবগুলির মধ্যে শক্তি সঞ্চার করিয়াছিলেন। বৌদ্ধধর্মের নূতনত্ব উহার সামাজিক ভাগ। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়েরাই চিরদিন আমাদের আচার্যের আসন অধিকার করিয়া আসিয়াছেন; অধিকাংশ উপনিষদ্ই ক্ষত্রিয়গণের লেখা এবং বেদের কর্মকাণ্ড ব্রাহ্মণদের কীর্তি। সমগ্র ভারতে আমাদের যে-সকল বড় বড় আচার্য হইয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেকেই ক্ষত্রিয় ছিলেন; তাঁহাদের উপদেশও উদার ও সর্বজনীন, কিন্তু দুইজন ছাড়া ব্রাহ্মণ আচার্যগণের মধ্যে সকলেই অনুদারভাবাপন্ন। ভগবানের অবতার বলিয়া পূজিত রাম, কৃষ্ণ ও বুদ্ধ—ইঁহারা সকলেই ক্ষত্রিয় ছিলেন।