প্র। যোগীরা কি কি ব্যাপার দেখাইতে পারেন, তাহার কোন দৃষ্টান্ত দিতে পারেন কি?
উ। অন্যান্য বিজ্ঞানের চর্চা করিতে হইলে তাহার উপর যতটা বিশ্বাসের প্রয়োজন হয়, যোগী তাঁহার যোগ-বিদ্যার উপর তাহা অপেক্ষা অধিক বিশ্বাস করিতে বলেন না। কোন বিষয় গ্রহণ করিয়া তাহা পরীক্ষা করিবার জন্য ভদ্রলোকে যতটুকু বিশ্বাস করিয়া থাকে, যোগী তাহা অপেক্ষা অধিক বিশ্বাস করিতে বলেন না। যোগীরা আদর্শ অতি উচ্চ। মনের শক্তি দ্বারা যে-সব ব্যাপার সাধিত হইতে পারে, তাহাদের মধ্যে নিম্মতর বিষয়গুলি আমি দেখিয়াছি, সুতরাং উচ্চতর ব্যাপারগুলি যে হইতে পারে, এ-বিষয়ে অবিশ্বাস করিবার অধিকার আমার নাই। যোগীর আদর্শ—সর্বজ্ঞতা ও সর্বশক্তিমত্তার সহায়তায় শাশ্বত শান্তি ও প্রেমের অধিকারী হওয়া। আমি একজন যোগীকে জানি, তাঁহাকে গোখুরা সাপে কামড়াইয়াছিল, দংশনমাত্র তিনি অচৈতন্য হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেলেন, সন্ধ্যার সময় তাঁহার আবার চৈতন্য হয়। যখন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘কি হইয়াছিল?’ তিনি বলিলেন, ‘আমার প্রিয়তমের নিকট হইতে দূত আসিয়াছিল।’ এই যোগীর সমুদয় ঘৃণা, ক্রোধ ও হিংসার ভাব একেবারে দগ্ধ হইয়া গিয়াছে। কিছুতেই তাঁহাকে প্রতিক্রিয়ায় প্রবৃত্ত করিতে পারে না। তিনি সর্বদা অনন্ত প্রেমস্বরূপ হইয়া রহিয়াছেন, প্রেমের শক্তিতে তিনি সর্বশক্তিমান্। এইরূপ ব্যক্তিই যথার্থ যোগী। আর এইসব অলৌকিক শক্তির প্রকাশ গৌণমাত্র। ঐগুলি লাভ করা যোগীর প্রকৃত লক্ষ্য নহে। যোগীরা বলেন, যোগী ব্যতীত আর সকলেই দাসবৎ—খাদ্যের দাস, বায়ুর দাস, নিজ স্ত্রীর দাস, নিজ পুত্রকন্যার দাস, টাকার দাস, স্বদেশীয়দের দাস, নামযশের দাস, এবং এই জগতের সহস্র সহস্র বিষয়ের দাস! যে ব্যক্তি এ-সকল বন্ধনের কোন বন্ধনে আবদ্ধ নন, তিনিই যথার্থ মানুষ, যথার্থ যোগী।
‘ইহৈব তৈর্জিতঃ সর্গো ষেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ।
নির্দোষং হি সমং ব্রহ্ম তস্মাদ্ব্রহ্মণি তে স্থিতাঃ।।’১
———-
১ গীতা, ৫/১৯
এখানেই তাঁহারা সংসারকে জয় করিয়াছেন, যাঁহাদের মন সাম্যভাবে অবস্থিত। যেহেতু ব্রহ্ম নির্দোষ ও সমভাবাপন্ন, সেই হেতু তাঁহারা ব্রহ্মে অবস্থিত।
প্র:যোগীরা কি জাতিভেদকে একটা বিশেষ প্রয়োজনীয় বিষয় বলিয়া স্বীকার করিয়া থাকেন?
উ। না; জাতিবিভাগ অপরিণত মনের শিক্ষালয় মাত্র।
প্র। এই অতিচেতন ভাবের (সমাধিতত্ত্বের) সহিত ভারতের গ্রীষ্মের কি কোন সম্বন্ধ নাই?
উ। কোন সম্বন্ধ আছে বলিয়া তো আমার বোধ হয় না। কারণ, সমুদ্র-পৃষ্ঠের পনর হাজার ফিট উপরে প্রায় মেরুপ্রদেশের আবহাওয়ায় হিমালয় পর্বতে এই যোগবিদ্যার উদ্ভব হইয়াছিল।
প্র। ঠাণ্ডা জলবায়ুতে কি যোগবিষয়ে সিদ্ধিলাভ করা সম্ভব?
উ। খুব সম্ভব, এবং জগতের মধ্যে ইহা যেমন কার্যে পরিণত করা সম্ভব, তেমন আর কিছুই নয়। আমরা বলি, আপনারা—আপনাদের মধ্যে প্রত্যেকেই—জন্ম হইতেই বৈদান্তিক। জীবনের প্রতিমুহূর্তেই আপনারা জাগতিক সকল বস্তুর সহিত নিজেদের একত্ব ঘোষণা করিতেছেন। যখনই আপনাদের হৃদয় সমগ্র জগতের কল্যাণের দিকে ধাবিত হয়, তখনই আপনারা অজ্ঞাতসারে প্রকৃত বেদান্তবাদী। আপনারা নীতিপরায়ণ, কিন্তু কেন নীতিপরায়ণ, তাহা জানেন না। বেদান্ত-দর্শনই নীতিতত্ত্বের বিশ্লেষণ করিয়া মানুষকে জ্ঞানতঃ নীতিপরায়ণ হইতে শিখাইয়াছে। বেদান্ত সকল ধর্মের সার।
প্র। আপনি কি বলেন যে, আমাদের—পাশ্চাত্য জাতিদের ভিতর এমন একটা অসামাজিক ভাব আছে, যাহা আমাদিগকে এত বহুত্ববাদী (pluralistic)করিয়াছে, আর প্রাচ্য দেশীয় লোক কি আমাদের অপেক্ষা অধিকতর সহানুভূতিসম্পন্ন?
উ। আমার মতে পাশ্চাত্য জাতি অধিকতর নিষ্ঠুরস্বভাব, আর প্রাচ্য-দেশীয় ব্যক্তিগণ সর্বভূতের প্রতি অধিকতর করুণাসম্পন্ন। কিন্তু তাহার কারণ শুধু এই যে, আপনাদের সভ্যতা খুব আধুনিক। কোন স্বভাবকে দয়াবৃত্তির প্রভাবে আনিতে কিছু সময়ের আবশ্যক। আপনাদের শক্তি যথেষ্ট, কিন্তু শক্তি-সংগ্রহ যে পরিমাণে চলিয়াছে, সেই পরিমাণে হৃদয়ের শিক্ষা চলে নাই, বিশেষতঃ মনঃসংযমের শক্তিও খুব অল্প পরিমাণেই অনুশীলন করা হইয়াছে। আপনাদিগকে সাধু ও ধীরপ্রকৃতি করিতে অনেক সময় লাগিবে। কিন্তু ভারতের প্রত্যেক রক্তবিন্দুতে এই ভাব প্রবাহিত। যদি আমি ভারতের কোন গ্রামে গিয়া সেখানকার লোককে রাজনীতি শিখাইতে চাই, তাহারা বুঝিবে না; কিন্তু যদি তাহাদিগকে বেদান্ত উপদেশ করি, তাহারা অমনি বলিবে ,হাঁ স্বামিন্ ,এখন আপনার কথা বুঝিতেছি- আপনি ঠিক বলিতেছেন।’ আজ পর্যন্ত ভারতের সর্বত্র সেই বৈরাগ্য বা অনাসক্তির ভাব দেখিতে পাওয়া যায়। আমরা এখন খুবই পতিত, কিন্তু এখনও বৈরাগ্যের প্রভাব এত অধিক বিদ্যমান যে, রাজারাজড়া পর্যন্ত রাজ্য ত্যাগ করিয়া বিনা সম্বলে দেশের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ান।
কোন কোন স্থানে সাধারন গ্রাম্য বালিকাও চরকায় সূতা কাটিতে কাটিতে বলিয়া থাকে : আমাকে দ্বৈতবাদের কথা বলিও না; আমার চরকা ‘সোহহং, সোহহং—আমি সেই ব্রহ্ম, আমিই সেই ব্রহ্ম’ বলিতেছে। এইসব লোকের সহিত গিয়া কথা বলুন, এবং জিজ্ঞাসা করুন : তাহারা এইরূপ বলিয়া থাকে, অথচ ঐ পাথরটাকে প্রণাম করে কেন? তাহারা বলিবে, ‘আপনারা ধর্ম বলিতে শুধু মতবাদ বুঝিয়া থাকেন, কিন্তু আমরা ধর্ম বলিতে বুঝি—প্রত্যক্ষ অনুভূতি।’ তাহাদের মধ্যে কেহ হয়তো বলিয়া উঠিবে, ‘আমি তখনই যথার্থ বেদান্তবাদী হইব, যখন আমার সম্মুখ হইতে সমগ্র জগৎ অন্তর্হিত হইবে এবং আমি সত্যদর্শন করিব। যতদিন না তাহা হইতেছে, ততদিন আমার সহিত সাধারণ অজ্ঞ ব্যক্তির কোন প্রভেদ নাই। সেই জন্যই আমি এইসব প্রস্তরমূর্তির উপাসনা করিতেছি, মন্দিরে যাইতেছি, যাহাতে আমার প্রত্যক্ষানুভূতি হয়। আমি বেদান্ত শ্রবণ করিয়াছি বটে, কিন্তু আমি সেই বেদান্তপ্রতিপাদ্য আত্মতত্ত্বকে দেখিতে—প্রত্যক্ষ অনুভব করিতে ইচ্ছা করি’।
‘বাগ্বৈখরী শব্দঝরী শাস্ত্রব্যাখ্যানকৌশলম্।
বৈদুষ্যং বিদুষাং তদ্বদ্ভুক্তয়ে ন তু মুক্তয়ে।।’১
———-