আমরা যেখানে হইতে আরম্ভ করিয়াছিলাম অর্থাৎ আমাদের আত্মাতেই বৃত্তপথে ঘুরিয়া আসি এবং দেখিতে পাই—যাঁহার জন্য আমরা সমুদয় জগতে অন্বেষণ করিতেছিলাম, যাঁহার জন্য আমরা মন্দির গির্জা প্রভৃতিতে কাতর হইয়া প্রার্থনা এবং অশ্রুবিসর্জন করিতেছিলাম, যাঁহাকে আমরা সুদূর আকাশে মেঘরাশি দ্বারা আবৃত অব্যক্ত রহস্যময় বলিয়া মনে করিতেছিলাম, তিনি আমাদের নিকট হইতেও নিকটতম, প্রাণের প্রাণ ; তিনিই আমার দেহ, তিনিই আমার আত্মা। ‘তুমিই আমি—আমিই তুমি।’ ইহাই তোমার স্বরূপ—ইহাকে প্রকাশ কর। তোমাকে পবিত্র হইতে হইবে না—তুমি পবিত্র-স্বরূপই আছ। তোমাকে পূর্ণ হইতে হইবে না—তুমি পূর্ণস্বরূপই আছ। সমুদয় প্রকৃতিই জবনিকার ন্যায় তাহার অন্তরালে সত্যকে ঢাকিয়া রাখিয়াছেন। তুমি যা কোন সৎচিন্তা বা সৎকার্য কর, তাহা যেন শুধু আবরণকে ধীরে ধীরে ছিন্ন করিতেছে, আর প্রকৃতির সেই অন্তরালে শুদ্ধস্বরূপ অনন্ত ঈশ্বর প্রকাশিত হইতেছেন।
ইহাই মানুষের সমগ্র ইতিহাস। আবরণ ক্রমশঃ সূক্ষতর হইতে থাকে, তখন প্রকৃতির অন্তরালে আলোক নিজ স্বভাববশতই ক্রমশঃ অধিক পরিমানে দীপ্ত হইতে থাকেন, কারণ তাঁহার স্বভাবই এইভাবে দীপ্তি পাওয়া। তাঁহাকে জানা যায় না, আমরা তাঁহাকে জানিতে বৃথাই চেষ্টা করি। যদি তিনি জ্ঞেয় হইতেন, তাহা হইলে তাঁহার স্বভাবের বিলোপ হইত, কারণ তিনি নিত্য-জ্ঞাতা। জ্ঞান তো সসীম ; কোন বস্তুর জ্ঞানলাভ করিতে হইলে উহাকে জ্ঞেয়বস্তুরূপে-বিষয়রূপে চিন্তা করিতে হইবে। তিনি তো সকল বস্তুর জ্ঞাতা-স্বরূপ, সকল বিষয়ের বিষয়িস্বরূপ, এই বিশ্ব-ব্রম্ভাণ্ডের সাক্ষিস্বরূপ, তোমারই আত্মাস্বরূপ। বিষয় জ্ঞান যেন একটি নিম্নতর অবস্থা—একটা অধঃপতন। আমারই সেই আত্মা, আত্মা আবার জানিব কিরূপে? প্রত্যেক ব্যক্তি সেই আত্মা এবং সকলেই বিভিন্ন উপায়ে ঐ আত্মাকে জীবনে প্রকাশিত করিতে চেষ্টা করিতেছে ; তাহা না হইলে এই নীতি-পদ্ধতি কোথা হইতে আসিল? সমুদয় নীতিপ্রনালীর তাৎপর্য কি? সকল নীতিপ্রনালীতে একটি মূল ভাবই ভিন্ন ভিন্ন আকারে প্রকাশিত হইয়াছে, ভাবটি অপরের উপকার করা মানবজাতির সকল সৎকর্মের মূল উদ্দেশ্য—মানুষ জীব জন্তু সকলের প্রতি দয়া। কিন্তু এ সবই
‘আমিই জগৎ, এই জগৎ এক অখণ্ডস্বরূপ’—এই চিরন্তন সত্যের বিভিন্ন ভাবমাত্র। তাহা না হইলে অপরের হিত করিবার যুক্তি কি? কেন আমি অপরের উপকার করিব? কিসে আমাকে অপরের উপকার করিতে বাধ্য করে? সর্বত্র সমদর্শনজনিত সহানুভূতির ভাব হইতেই এরূপ হইয়া থাকে। অতি কঠোর অন্তঃকরণও কখন কখন অপরের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হইয়া থাকে। এমন কি এই আপাতপ্রতীয়মান ‘অহং’ প্রকৃতপক্ষে ভ্রমমাত্র, এই ভ্রমাত্মক ‘অহং’-এ আসক্ত থাকা অতি নীচ কার্য—যে ব্যক্তি এই-সকল কথা শুনিলে ভয় পায়, সেই ব্যক্তিই তোমাকে বলিবে, সম্পূর্ণ আত্মত্যাগই সকল নীতির ভিত্তি। কিন্তু পূর্ণ আত্মত্যাগ হইলে কি অবশিষ্ট থাকে? আত্মত্যাগ অর্থে এই আপাতপ্রতীয়মান ‘অহং’-এর ত্যাগ, সর্বপ্রকার স্বার্থপরতা-বর্জন। এই অহঙ্কার ও মমতা পূর্ব কুসংস্কারের ফলস্বরূপ, আর যতই এই ‘অহং’ ত্যাগ হইতে থাকে, ততই আত্মা নিত্যস্বরূপে নিজ পূর্ণ মহিমায় প্রকাশিত হন। ইহাই প্রকৃত আত্মত্যাগ, ইহাই সমুদয় নীতিশিক্ষার ভিত্তিস্বরূপ—কেন্দ্রস্বরূপ। মানুষ উহা জানুক আর নাই জানুক, সমুদয় জগৎ সেই দিকে ধীরে ধীরে চলিয়াছে, অল্পাধিক পরিমানে তাহাই অভ্যাস করিতেছে। কেবল অধিকাংশ লোক উহা অজ্ঞাতসারে করিয়া থাকে। তাহারা উহা জ্ঞাতসারে করুক। এই ‘আমি’ ও ‘আমার’ প্রকৃত আত্মা নহে—ইহা জানিয়া তাহারা এই ত্যাগ আচরন করুক। এই ব্যাবহারিক জীব সীমাবদ্ধ। এখন যাহাকে মানুষ বলা যাইতেছে, সে সেই জগতের অতীত অনন্ত সত্তার সামান্য আভাস মাত্র, সেই সর্বস্বরূপ অনন্ত অগ্নির একটি স্ফুলিঙ্গমাত্র। কিন্তু সেই অনন্তই তাহার প্রকৃত স্বরূপ।
এই জ্ঞানের ফল—এই জ্ঞানের উপকারিতা কি? আজকাল সব বিষয়ই এই ফল—এই উপকার দেখিয়াই পরিমান করা হয়। অর্থাৎ মোট কথা এই—উহাতে কত টাকা, কত আনা, কত পয়সা হয়। লোকের এইরূপ জিজ্ঞাসা করিবার কি অধিকার আছে? সত্য কি উপকার বা অর্থের মাপকাঠি লইয়া বিচারিত হইবে? মনে কর, উহাতে কোন উপকার নাই, উহা কি কম সত্য হইয়া যাইবে? উপকার বা প্রয়োজন সত্যের নির্ণায়ক হইতে পারে না।১ যাহা হউক, এই জ্ঞানে মহৎ উপকার এবং প্রয়োজন আছে।
১ Bentham’s Utilitarianism and James’ Pragmatism
আমরা দেখিতেছি সকলেই সুখের অন্বেষণ করিতেছে, কিন্তু অধিকাংশ লোক নশ্বর মিথ্যা বস্তুতে উহা অন্বেষণ করিয়া থাকে। ইন্দ্রিয়ে কেহ কখনও সুখ পায় নাই। সুখ কেবল আত্মাতেই পাওয়া যায়। অতএব এই আত্মাতে সুখলাভ করাই মানুষের সর্বাপেক্ষা প্রয়োজন। আর এককথা এই যে, অবিদ্যাই সকল দুঃখের প্রসূতি এবং মূল অজ্ঞান এই যে, আমরা মনে করি সেই অনন্ত স্বরূপ যিনি, তিনি আপনাকে সান্ত মনে করিয়া কাঁদিতেছেন ; সমস্ত অজ্ঞানের মূলভিত্তি এই যে, অবিনাশী নিত্যশুদ্ধ পূর্ণ আত্মা হইয়াও আমরা ভাবি যে, আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেহমাত্র ; ইহাই সমুদয় স্বার্থপরতার মূল। যখনই আমি নিজেকে একটি ক্ষুদ্র দেহ বলিয়া মনে করি, তখনই—জগতের অন্যান্য শরীরের সুখদুঃখের দিকে না চাহিয়া আমি দেহটিকে রক্ষা করিতে এবং উহার সৌন্দর্য সম্পাদন করিতে ইচ্ছা করি। তখন তুমি আমি ভিন্ন হইয়া যাই। যখনই এই ভেদজ্ঞান দেখা দেয়-তখনই উহা সর্ব-প্রকার অমঙ্গেলর দ্বার খুলিয়া দেয় এবং সর্বপ্রকার দুঃখ সৃষ্টি করে। সুতরাং পূর্বোক্ত জ্ঞানলাভে এই উপকার হইবে যে, যদি বর্তমান কালের মনুষ্য জাতির খুব সামান্য অংশও স্বার্থপরতা সঙ্কীর্ণতা ক্ষুদ্রত্ব ত্যাগ করিতে পারে, তবে কালই এই জগৎ স্বর্গে পরিনত হইবে ; নানাবিধ যন্ত্র এবং বাহ্য জগৎ-সম্বন্ধীয় জ্ঞানের উন্নতিতে কখনও হইবে না। যেমন অগ্নিতে ঘৃত নিক্ষেপ করিলে অগ্নিশিখা আরও বর্ধিত হয়, তেমনি এগুলি দুঃখই বৃদ্ধি করে। আত্মজ্ঞান ব্যতীত যাবতীয় জড়ের জ্ঞান অগ্নিতে ঘৃতাহুতি মাত্র। জড়বিজ্ঞান—স্বার্থপর লোকের হাতে পরস্ব কাড়িয়া লইবার এবং পরার্থে জীবন উৎসর্গ না করিয়া অপরকে শোষণ করিবার আর একটি যন্ত্র তুলিয়া দেয় মাত্র।