এখন প্রশ্ন উঠিতেছে যে, পূর্ণতাই পরম তত্ত্ব, এবং সেই পরম কখনও দুই বা তিন হইতে পারে না, উহাতে কোন গুণ বা ব্যক্তিত্ব থাকিতে পারে না। অতএব যখন আত্মা এই পূর্ণ ও পরম অবস্থায় উপনীত হন ,তখন ব্রহ্মের সহিত এক হইয়া যাইবেন এবং একমাত্র ব্রহ্মকেই নিত্য পূর্ণরূপে উপলব্ধি করিবেন। তিনিই আত্মার স্বরূপ-নিরপেক্ষ সত্তা, নিরপেক্ষ জ্ঞান, নিরপেক্ষ আনন্দ-সৎ-চিৎ-আনন্দ-স্বরূপ। আমরা প্রায়ই পড়িয়া থাকি, আত্মার এই অবস্থা-ব্যক্তিত্বের লয়-কাঠ পাথরের
মতো জড়াবস্থা; ইহাতে লেখকদের অনভিজ্ঞতাই প্রকাশ পায়, কারণ যিনি কখনও আঘাতের বেদনা বোধ করেন নাই, তিনি অপরের ক্ষতচিহ্ন দেখিয়া পরিহাস করেন ।
আমি বলিতেছি, এই অবস্থা ঐরূপ কিছু নয়। এই ক্ষুদ্র দেহের চেতনা উপভোগ যদি সুখের হয়, তবে দুইটি দেহের চেতনা উপভোগ আরও বেশী সুখের হইবে। এইরূপে দেহসংখ্যা যতই বাড়িবে, আমার সুখও ততই বাড়িবে। এইরূপে যখন এই নিখিল বিশ্বে আমার আত্মবোধ হইবে, তখনই আমি আনন্দের পরাকাষ্ঠায়-লক্ষ্যে উপনীত হইব।
অতএব এই অনন্ত বিশ্বজনীন ব্যক্তিত্ব লাভ করিতে গেলে এই দুঃখপূর্ণ ক্ষুদ্র দেহাবদ্ধ ব্যক্তিত্ব অবশ্যই ত্যাগ করিতে হইবে। যখন আমি প্রাণস্বরূপ হইয়া যাইব, তখনই মৃত্যু হইতে নিষ্কৃতি পাইব; যখন আনন্দস্বরূপ হইয়া যাইব, তখনই দুঃখ হইতে নিষ্কৃতি পাইব; যখন জ্ঞানস্বরূপ হইয়া যাইব, তখনই ভ্রমের নিবৃত্তি। ইহাই যুক্তিসঙ্গত বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত। বিজ্ঞানের প্রমাণে জানিয়াছি-দেহগত ব্যক্তিত্ব ভ্রান্তিমাত্র। প্রকৃতপক্ষে আমার শরীর এই নিরবচ্ছিন্ন জড়সমুদ্রে অবিরাম পরিবর্তিত হইতেছে; সুতরাং আমার চৈতন্যাংশ সম্বন্ধে এই অদ্বৈত (একত্ব)-জ্ঞানেই কেবল যক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত।
একত্বের আবিষ্কার ব্যতীত বিজ্ঞান আর কিছুই নয়; এবং যখনই কোন বিজ্ঞান সেই পূর্ণ একত্বে উপনীত হয়, তখন উহার অগ্রগতি থামিয়া যাইবেই, কারণ ঐ বিজ্ঞান তাহার লক্ষ্যে উপনীত হইয়াছে। যথা-রসায়নশাস্ত্র যদি এমন একটি মূল পদার্থ আবিষ্কার করে, যাহা হইতে অন্যান্য সকল পদার্থ প্রস্তুত করা যাইতে পারে, তাহা হইলে উহা চরম উন্নতি লাভ করিল। পদার্থবিদ্যা যদি এমন একটি শক্তি আবিষ্কার করিতে পারে, অন্যান্য শক্তি যাহার রূপান্তর মাত্র, তাহা হইলে ঐ বিজ্ঞানের কার্য শেষ হইল। ধর্মবিজ্ঞানও তখনই পূর্ণতা লাভ করিয়াছে,যখন তাঁহাকে আবিষ্কার করিয়াছে, যিনি এই মৃত্যুময় জগতে একমাত্র জীবণস্বরূপ, যিনি নিত্যপরিবর্তনশীল জগতের একমাত্র অচল অটল ভিত্তি, যিনি একমাত্র পরমাত্মা-অন্যান্য অত্মা যাঁহার ভ্রমাত্মক প্রকাশ। এইরূপে বহুবাদ, দ্বৈতবাদ প্রভৃতির ভিতর দিয়া শেষে অদ্বৈতবাদে উপনীত হইলে ধর্মবিজ্ঞান আর অগ্রসর হইতে পারে না। ইহাই সর্বপ্রকার জ্ঞান বা বিজ্ঞানের চরম লক্ষ্য।
সকল বিজ্ঞানকেই অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হইবে। আজকাল বৈজ্ঞানিকগণ ‘সৃষ্টি না বলিয়া ‘বিকাশ’ শব্দ ব্যবহার করিতেছেন। হিন্দু যুগ যুগ ধরিয়া যে-ভাব হৃদয়ে পোষণ করিয়া আসিতেছে, সেই ভাব আধুনিক বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তের নূতনতর আলোকে আরও জোরালো ভাষায় প্রচারিত হইবার উপক্রম দেখিয়া তাহার হৃদয়ে আনন্দের সঞ্চার হইতেছে।
এখন দর্শনের উচ্চ শিখর হইতে অবরোহণ করিয়া অজ্ঞলোকদের ধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করি। প্রথমেই বলিয়া রাখি যে, ভারতবর্ষে বহু-ঈশ্বরবাদ নাই। প্রতি
দেবালয়ের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া যদি কেহ শ্রবণ করে, তাহা হইলে শুনিতে পাইবে, পূজক দেববিগ্রহে ঈশ্বরের সমুদয় গুণ, এমন কি সর্বব্যাপিত্ব পর্যন্ত আরোপ করিতেছে। ইহা বহু-ঈশ্বরবাদ নয়, বা ইহাকে কোন দেব-বিশষের প্রাধান্যবাদ বলিলেও প্রকৃত ব্যাপার ব্যাখ্যাত হইবে না। গোলাপকে যে-কোন অন্য নামই দাও না কেন, তাহার সুগন্ধ সমানই থাকিবে। সংজ্ঞা বা নাম দিলেই ব্যাখ্যা করা হয় না।
মনে পড়ে বাল্যকালে একদা এক খ্রীষ্টান পাদ্রীকে ভারতে এক ভিড়ের মধ্যে বক্তৃতা করিতে শুনিয়াছিলাম। নানাবিধ মধুর কথা বলিতে বলিতে তিনি বলিয়া উঠিলেন, ‘আমি যদি তোমাদের বিগ্রহ-পুতুলকে এই লাঠি দ্বারা আঘাত করি, তবে উহা আমার কি করিতে পারে?’ জনতার মধ্য হইতে একজন বলিল, ‘আমি যদি তোমার ভগবানকে গালাগালি দিই, তিনিই বা আমার কি করিতে পারেন?’ পাদ্রী উত্তর দিলেন, ‘মৃত্যুর পর তোমার শাস্তি হইবে।’ সেই ব্যক্তিও বলিল, ‘তুমি মরিলে পর আমার দেবতাও তোমাকে শাস্তি দিবেন।’
ফলেই বৃক্ষের পরিচয়। যখন দেখি যে যাঁহাদিগকে পৌত্তলিক বলা হয়, তাঁহাদের মধ্যে এমন সব মানুষ আছেন, যাঁহাদের মতো নীতিজ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা ও প্রেম কখনও কোথাও দেখি নাই, তখন মনে এই প্রশ্ন উদিত হয় : পাপ হইতে কি কখনও পবিত্রতা জন্মিতে পারে?
কুসংস্কার মানুষের শত্রু বটে, কিন্তু ধর্মান্ধতা আরও খারাপ। খ্রীষ্টানরা কেন গির্জায় যান? ক্রুশই বা এত পবিত্র কেন? প্রার্থনার সময় কেন আকাশের দিকে তাকানো হয়? ক্যাথলিকদের গির্জায় এত মূর্তি রহিয়াছে কেন? প্রোষ্টান্টেদের মনে প্রার্থনাকালে এত ভাবময় রূপের আর্বিভাব হয় কেন ? হে আমার ভ্রাতৃবৃন্দ, নিঃশ্বাস গ্রহণ না করিয়া জীবনধারণ করা যেমন অসম্ভব, চিন্তাকালে মনোময় রূপ বিশেষের সাহায্য না লওয়াও আমাদের পক্ষে সেইরূপ অসম্ভব। ভাবানুষঙ্গনিয়মানূসারে জড়মূর্তি দেখিলে মানসিক ভাববিশেষের উদ্দীপন হয়, বিপরীতক্রমে মনে ভাববিশেষের উদ্দীপন হইলে তদনুরূপ মূর্তিবিশেষও মনে উদিত হয়। এইজন্য হিন্দু উপাসনার সময়ে বাহ্য প্রতীক ব্যবহার করে। সে বলিবে, তাহার উপাস্য দেবতায় মন স্থির করিতে প্রতীক সাহায্য করে। সে তোমাদেরই মতো জানে, প্রতিমা ঈশ্বর নয়, সর্বব্যাপী নয়। আচ্ছা বলতো, ‘সর্বব্যাপী’ বলিতে অধিকাংশ মানুষ-প্রকৃতপক্ষে সারা পৃথিবীর মানুষ কি বুঝিয়া থাকে? ইহা একটি শব্দমাত্র-একটি প্রতীক। ঈশ্বরের কি বিস্তৃতি আছে? তা যদি থাকে, তবে ‘সর্বব্যাপী’ শব্দটি আবৃত্তি করিলে আমাদের মনে বড়জোর বিস্তৃত আকাশ অথবা মহাশূন্যের কথাই উদিত হয়, এই পর্যন্ত।