এইরূপে বেদ ঘোষণা করিতেছেন- কতকগুলি ক্ষমাহীন নিয়মাবলীর ভয়াবহ সমাবেশ নয় বা কার্য-কারণের কারাবন্ধন আমাদের নিয়ন্তা নয়; কিন্তু এই-সকল নিয়মের ঊর্ধ্বে প্রত্যেক পরমাণু ও শক্তির মধ্যে এক বিরাট পুরুষ অনুস্যূত রহিয়াছেন,
১ শ্বেতাশ্ব উপ, ২।৫
যাঁহার আদেশে বায়ু প্রবাহিত হইতেছে, অগ্নি প্রজ্বলিত হইতেছে, মেঘ বারিবর্ষণ করিতেছে এবং মৃত্যু জগতে পরিভ্রমণ করিতেছে।’১
তাঁহার স্বরূপ কি? তিনি সর্বব্যাপী, শুদ্ধ, নিরাকার, সর্বশক্তিমান্-সকলের উপরেই তাঁহার করুণা। ‘তুমি আমাদের পিতা, তুমি আমাদের মাতা, তুমি আমাদের পরম প্রেমাস্পদ সখা বন্ধু, তুমি সমস্ত শক্তির মূল, তুমি আমাদের শক্তি দাও, তুমি বিশ্বজগতের ভার ধারণ করিয়া আছ; এই ক্ষুদ্র জীবনের ভার বহন করিতে আমায় সাহায্য কর’-বৈদিক ঋষিগন এইরূপ গানই গাহিয়াছেনল। আমরা কিভাবে তাঁহাকে পূজা করিব?-প্রীতি ভালবাসা দিয়া। প্রেমাস্পদরূপে-ঐহিক ও পারত্রিক সমুদয় প্রিয় বস্তু অপেক্ষা প্রিয়তররূপে তাঁহাকে পূজা করিতে হইবে।
শুদ্ধ প্রেম সম্বন্ধে বেদ এইরূপ শিক্ষা দিয়াছেন। এখন দেখা যাক্ হিন্দুগণ পৃথিবীতে ঈশ্বরের অবতার বলিয়া যাঁহাকে বিশ্বাস করেন, সেই শ্রীকৃষ্ণ কিভাবে এই প্রেমতত্ত্ব পরিপূর্ণ করিযা প্রচার করিয়াছেন।
তিনি শিক্ষা দিয়াছেন : মানুষ পদ্মপত্রের মতো সংসারে বাস করিবে। পদ্মপত্র জলে থাকে, কিন্তু তাহাতে জল লাগে না; মানুষ তেমনি এই সংসারে থাকিবে, ঈশ্বরে হৃদয সমর্পণ করিয়া হাতে কাজ করিবে।
ইহলোকে ও পরলোকে পুরস্কারের প্রত্যাশায় ঈশ্বরকে ভালোবাসা ভাল; কিন্তু ভালোবাসার জন্যই তাঁহাকে ভালবাসা আরও ভাল। তাইতো এই প্রার্থনা : প্রভু! আমি তোমার নিকট ধন, সন্তান বা বিদ্যা চাই না। যদি তোমার ইচ্ছা হয়, আমি শত বিপদের মধ্য দিয়া যাইব; কিন্তু আমার শুধু এই ইচ্ছা পূর্ণ করিও, কোন পুরস্কারের আশায় নয়, নিঃস্বার্থভাবে শুধু ভালবাসার জন্যই যেন তোমাকে ভালবাসিতে পারি।
শ্রীকৃষ্ণের এক শিষ্য তৎকালীন ভারতের সম্রাট্ শত্রু কর্তৃক সিংহাসনচ্যুত হইয়া রানীর সহিত হিমালয়ের অরণ্যে আশ্রয় লইয়াছিলেন। সেখানে রানী একদিন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি সর্বাপেক্ষা ধার্মিক ব্যক্তি, আপনাকে কেন এত কষ্টযন্ত্রণা ভোগ করিতে হইতেছে?’ যুধিষ্ঠির উত্তর দেন, ‘প্রিয়ে, দেখ দেখ, হিমালয়ের দিকে চা্হিয়া দেখ, আহা! কেমন সুন্দর ও মহান্! আমি হিমালয় বড় ভালবাসি। পর্বত আমাকে কিছুই দেয় না, তথাপি সুন্দর ও মহান্ বস্তুকে ভালবাসাই আমার স্বভাব, তাই আমি হিমালয়কে ভালবাসি। ঈশ্বরকেও আমি ঠিক এই জন্য ভালবাসি। তিনি নিখিল সৌন্দর্য ও মহত্ত্বের মূল, তিনিই ভালবাসার একমাত্র পাত্র। তাঁহাকে ভালবাসা আমার স্বভাব, তাই আমি ভালবাসি। আমি কোন কিছুর জন্য প্রার্থনা করি না, আমি তাঁহার নিকট কিছুই চাই না, তাঁহার যেখানে ইচ্ছা আমাকে তিনি সেখানে রাখুন, সর্ব অবস্থাতেই আমি তাঁহাকে ভালবাসিব। আমি ভালবাসার জন্য তাঁহাকে ভালবাসি। আমি ভালবাসার ব্যবসা করি না।’
১ কঠ উপ, ২।৩।৩
বেদ শিক্ষা দেন : আত্মা ব্রক্ষ্মস্বরূপ, কেবল জড় পঞ্চভূতে বদ্ধ হইয়া আছেন; এই বন্ধনের শৃঙ্খল চূর্ণ হইলেই আত্মা পূর্ণত্ব উপলব্ধি করেন। অতএব এই পরিত্রাণের অবস্থা বুঝাইবার জন্য ঋষিদের ব্যবহূত শব্দ ‘মুক্তি’! মুক্তি, মুক্তি-অপূর্ণতা হইতে মুক্তি-মৃত্যু ও দুঃখ হইতে মুক্তি।
ঈশ্বরের কৃপা হইলেই এই বন্ধন ঘুচিয়া যাইতে পারে এবং পবিত্র-হূদয় মানুষের উপরই তাঁহার কৃপা হয়। অতএব পবিত্রতাই তাঁহার কৃপালাভের উপায়। কিভাবে তাঁহার করুণা কাজ করে? শুদ্ধ বা পবিত্র হূদয়েই তিনি নিজেকে প্রকাশিত করেন। নির্মল বিশুদ্ধ মানুষ ইহজীবনেই ঈশ্বরের দর্শনলাভ করেন। ‘তখনই-কেবল তখনই হূদয়ের সকল কুটিলতা সরল হইয়া যায়, সকল সন্দেহ বিদূরিত হয়।’ মানুষ তখন আর ভয়ঙ্কর কার্যকারণ নিযমের ক্রীড়াকন্দুক নয়। ইহাই হিন্দুধর্মের মর্মস্থল, ইহাই হিন্দুধর্মের প্রাণস্বরূপ। হিন্দু কেবল মতবাদ ও শাস্ত্রবিচার লইয়া থাকিতে চায় না; সাধারণ ইন্দ্রিয়ানুভূতির পারে যদি অতীন্দ্রিয় সত্তা কিছু থাকে, হিন্দু সাক্ষাৎভাবে তাহার সন্মুখীন হইতে চায়। যদি তাহার মধ্যে আত্মা বলিয়া কিছু থাকে, যাহা আদৌ জড় নয়,-যদি করুণাময় বিশ্বব্যাপী পরমাত্মা থাকেন, হিন্দু সোজা তাঁহার কাছে যাইবে, অবশ্যই তাঁহাকে দর্শন করিবে। তবেই তাহার সকল সন্দেহ দূর হইবে। অতএব আত্মা ও ঈশ্বর সম্বন্ধে সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ দিতে গিয়া জ্ঞানী হিন্দু বলেন, ‘আমি আত্মাকে দর্শন করিয়াছি, ঈশ্বরকে দর্শন করিয়াছি।’ সিদ্ধি বা পূর্ণত্বের ইহাই একমাত্র নিদর্শন। কোন মতবাদ অথবা বদ্ধমূল ধারণায় বিশ্বাস করার চেষ্টাতেই হিন্দুধর্ম নিহিত নয়; অপরোক্ষানুভূতিই উহার মূলমন্ত্র, শুধু বিশ্বাস করা নয়, আদর্শস্বরূপ হইয়া যাওয়াই-উহা জীবনে পরিণত করাই ধর্ম।
এখন দেখা যাইতেছে, ক্রমাগত সংগ্রাম ও সাধনা দ্বারা সিদ্ধিলাভ করা-দিব্যভাবে ভাবান্বিত হইয়া ঈশ্বরের সান্নিধ্যে যাওয়া ও তাঁহার দর্শনলাভ করিয়া সেই ‘স্বর্গস্থ পিতা`র মতো পূর্ণ হওয়াই হিন্দুর ধর্ম।
পূর্ণ হইলে মানুষের কি অবস্থা হয়? তিনি অনন্ত আনন্দময় জীবন যাপন করেন। আনন্দের একমাত্র উৎস ঈশ্বরকে লাভ করিয়া তিনি পরমানন্দের অধিকারী হন, এবং ঈশ্বরের সহিত সেই আনন্দ উপভোগ করেন-সকল হিন্দু এ-বিষয়ে একমত। ভারতের সকল সম্প্রদায়ের ইহা সাধারণ ধর্ম।