বিদ্যাধনযশোধর্মান্ যতমান উপার্জয়েৎ
ব্যসনঞ্চাসতাং সঙ্গং মিথ্যা দ্রোহং পরিত্যজেৎ।।১
-গৃহস্থ যত্নপূর্বক বিদ্যা, ধন, যশ, ধর্ম উপার্জন করিবেন এবং ব্যসন (দ্যূত-ক্রীড়াদি),অসৎসঙ্গ, মিথ্যাবাক্য ও হিংসা, অনিষ্টাচরণ বা শত্রুতা পরিত্যাগ করিবেন।
অনেক সময় লোকে নিজেদের সাধ্যাতীত কার্য প্রবৃত্ত হয় এবং তাহার ফল এই হয় যে, উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য অপরকে প্রতারণা করিয়া থাকে। আবার
অবস্থানুগতাশ্চেষ্টা সময়ানুগতাঃ ক্রিয়াঃ।
তস্মাদবস্থাং সময়ং বীক্ষ্য কর্ম সমাচরেৎ।।২
-চেষ্টা অবস্থার অনুগত এবং ক্রিয়া সময়ের অনুগত। অতএব অবস্থা ও সময় অনুসারেই কর্ম করিবে। সকল বিষয়েই ‘সময়’-এর দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে হইবে। এক সময় যাহা বিফল হইল, আর এক সময়ে হয়তো তাহাতে প্রচুর সাফল্য লাভ হইল।
সত্যং মৃদু প্রিয়ং ধীরো বাক্যং হিতকরং বদেৎ।
আত্মোৎকর্ষন্তথা নিন্দাং পরেষাং পরিবর্জয়েৎ।।৩
-ধীর গৃহস্থ ব্যক্তি সত্য মৃদু প্রিয় ও হিতকর বাক্য বলিবেন। তিনি নিজের যশ খ্যাপন করিবেন না এবং পরনিন্দা পরিত্যাগ করিবেন।
জলাশয়াশ্চ বৃক্ষাশ্চ বিশ্রামগৃহমধ্বনি।
সেতুঃ প্রতিষ্ঠিতো যেন তেন লোকত্রয়ং জিতম্।।৪
-যে ব্যক্তি জলাশয়-খনন, বৃক্ষরোপণ, পথিমধ্যে বিশ্রাম-গৃহ ও সেতু নির্মাণ করিয়া সাধারণের জন্য উৎসর্গ করেন, তিনি ত্রিভুবন জয় করিয়া থাকেন। বড় বড় যোগিগণ যে পদ প্রাপ্ত হন, তিনিও এই-সকল কর্ম করিয়া সেই পদলাভের দিকেই অগ্রসর হইতে থাকেন।
১ ঐ,৮।৫৮ ২ ঐ,৮।৫৯ ৩ ঐ,৮।৬২ ৪ ঐ,৮।৬৩
ইহাই কর্মযোগের এক অংশ-গৃহস্থের কর্তব্য ও কাজকর্ম। উক্ত তন্ত্রগ্রন্থেই আর কিছু পরে অপর একটি শ্লোক দৃষ্ট হয়:
ন বিভেতি রণাদ্ যো বৈ সংগ্রামেহপ্যপরাঙ্মুখঃ।
ধর্মযুদ্ধে মৃতো বাপি তেন লোকত্রয়ং জিতম্।।১
-যিনি যুদ্ধে ভয় পান না, যিনি সংগ্রামে অপরাঙ্মুখ বা যিনি ধর্মযুদ্ধে মৃত হন, তিনি ত্রিভুবন জয় করেন। যদি স্বদেশের বা স্বধর্মের জন্য যুদ্ধ করিয়া গৃহস্থের মৃত্যু হয়-যোগিগণ ধ্যানের দ্বারা যে পদ লাভ করেন, তিনিও সেই পদ লাভ করিয়া থাকেন। ইহাতে স্পষ্ট দেখাইতেছে যে, একজনের পক্ষে যাহা কর্তব্য, অপরের পক্ষে তাহা কর্তব্য নয়; পরন্তু শাস্ত্র কোনটিকেই হীন বা উন্নত বলিতেছেন না। বিভিন্ন দেশ-কাল-পাত্রে বিভিন্ন কর্তব্য রহিয়াছে এবং আমরা যে অবস্থায় রহিয়াছি, আমাদিগকে তদুপযোগী কর্তব্য পালন করিতে হইবে।
এই সমুদয় আলোচনা হইতে এই একটি ভাব পাওয়া যাইতেছে যে, দুর্বলতামাত্রই সর্বথা ঘৃণ্য ও পরিত্যজ্য। আমাদের দর্শন, ধর্ম বা কর্মের ভিতর-আমাদের সমুদয় শাস্ত্রীয় শিক্ষার ভিতর-এই বিশেষ ভাবটি আমি খুব পছন্দ করি। যদি তোমরা বেদ পাঠ কর, দেখিবে-তাহাতে ‘অভয়’ শব্দটি বার বার উক্ত হইয়াছে। কোন কিছুকেই ভয় করিও না-ভয় দুর্বলতার চিহ্ন। এই দুর্বলতাই মানুষকে ভগবানের পথ হইতে বিচ্যুত করিয়া নানা পাপ-কর্মে টানিয়া লয়। সুতরাং জগতের ঘৃণা ও উপহসের দিকে আদৌ লক্ষ না রাখিয়া অকুতোভয়ে নিজ কর্তব্য করিয়া যাইতে হইবে।
যদি কেহ সংসার হইতে দূরে থাকিয়া ঈশ্বরের উপাসনা করিতে যান, তাঁহার এরূপ ভাবা উচিত নয় যে, যাঁহারা সংসারে থাকিয়া জগতের হিত-চেষ্টা করিতেছেন, তাঁহারা ঈশ্বরের উপাসনা করিতেছেন না; আবার যাঁহারা স্ত্রী-পুত্রাদির জন্য সংসারে রহিয়াছেন, তাঁহারা যেন সংসারত্যাগীদিগকে নীচ ভবঘুরে মনে না করেন। নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই মহান্। এই বিষয়টি আমি একটি গল্প দ্বারা বুঝাইব।
কোন দেশে এক রাজা ছিলেন। তাঁহার রাজ্যে সমাগত সকল সাধু-সন্ন্যাসীকেই তিনি জিজ্ঞাসা করিতেন, ‘যে সংসার ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাস গ্রহণ করে সে বড়, না যে গৃহে থাকিয়া গৃহস্থের সমুদয় কর্তব্য করিয়া যায় সে-ই বড়?’ অনেক বিজ্ঞ লোক এই সমস্যা মীমাংসা করিবার চেষ্টা করিলেন। কেহ কেহ বলিলেন, ‘সন্ন্যাসী বড়’। রাজা এই বাক্যের প্রমাণ চাহিলেন। যখন তাঁহারা প্রমাণ দিতে অক্ষম হইলেন, তখন রাজা তাঁহাদিগকে বিবাহ করিয়া গৃহস্থ হইবার আদেশ দিলেন। আবার অনেকে আসিয়া বলিলেন, ‘স্বধর্মপরায়ণ গৃহস্থই বড়’। রাজা তাঁহাদের নিকটও প্রমাণ চাহিলেন। যখন তাঁহারা প্রমাণ দিতে পারিলেন না, তখন তাঁহাদিগকেও তিনি গৃহস্থ করিয়া নিজ রাজ্যে বাস করাইলেন।
১ ঐ,৮।৬৭
অবশেষে আসিলেন এক যুবা সন্ন্যাসী; রাজা তাঁহাকেও ঐরূপ প্রশ্ন করাতে সন্ন্যাসী বলিলেন, ‘হে রাজন্, নিজ নিজ কর্মক্ষত্রে প্রত্যেকেই বড়।’ রাজা বলিলেন, ‘এ-কথা প্রমাণ করুন।’ সন্ন্যাসী বলিলেন, ‘হাঁ, আমি প্রমাণ করিব; তবে আসুন, কিছুদিন আপনাকে আমার মতো থাকিতে হইবে, তবেই যাহা বলিয়াছি, তাহা আপনার নিকট প্রমাণ করিতে পারিব।’ রাজা সন্মত হইলেন এবং সন্ন্যসীর অনুগামী হইয়া রাজ্যের পর রাজ্য অতিক্রম করিয়া আর এক বড় রাজ্যে উপস্থিত হইলেন। সেই রাজ্যের রাজধানীতে তখন এক মহাসমারোহ-ব্যাপার চলিতেছিল। রাজা ও সন্ন্যসী ঢাক ও অন্যান্য নানাপ্রকার বাদ্যধ্বনি এবং ঘোষণাকারীদের চিৎকার শুনিতে পাইলেন। পথে লোকেরা সুসজ্জিত হইয়া কাতারে কাতারে দাঁড়াইয়া আছে-আর ঢেঁটরা পেটা হইতেছে। রাজা ও সন্ন্যসী দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন, ব্যাপারটা কি। ঘোষণাকারী চিৎকার করিয়া বলিতেছিল, ‘এই দেশের রাজকন্যা স্বয়ংবরা হইবেন।’