প্রত্যেকেরই কর্তব্য-নিজ নিজ আদর্শ জীবনে পরিণত করিতে চেষ্টা করা। অপর
ব্যক্তির আদর্শ লইয়া তদনুসারে জীবন গঠনের চেষ্টা করা অপেক্ষা ইহাই উন্নতি লাভ করার অপেক্ষাকৃত নিশ্চিত উপায়। অপরের আদর্শ হয়তো জীবনে কখনই পরিণত করা সম্ভব হইবে না। মনে কর-আমরা একটি শিশুকে একেবারে কুড়ি মাইল ভ্রমণ করিতে বাধ্য করিলাম। শিশুটি হয় মরিয়া যাইবে, নয়তো হাজারে একজন বড়জোর ঐ কুড়ি মাইল কোনপ্রকারে হামাগুড়ি দিয়া অবসন্ন ও মৃতপ্রয় হইয়া গন্তব্য স্থলে পৌঁছিবে। সচরাচর আমরা মানুষের সহিত এইরূপ ব্যবহারই করিয়া থাকি। কোন সমাজে সকল নরনারীর মন এক ধরনের নয়, সকলের ধারণাশক্তি বা কর্মশক্তিও একরূপ নয়; তাহাদের আদর্শগুলির কোনটিকেই অবজ্ঞা করিবার অধিকার আমাদের নাই। প্রত্যেকেই নিজ নিজ আদর্শে পৌঁছিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করুক। আমাকে তোমার বা তোমাকে আমার আদর্শের দ্বারা বিচার করা ঠিক নয়। ওক্ বৃক্ষের আদর্শে আপেলের অথবা আপেল বৃক্ষের আদর্শে ওকের বিচার করা উচিত নয়। আপেল বৃক্ষকে বিচার করিতে হইলে আপেলের এবং ওক্ বৃক্ষকে বিচার করিতে হইলে ওকের আদর্শ লইয়াই বিচার করা আবশ্যক।
বহুত্বের মধ্যে একত্বই সৃষ্টির পরিকল্পিত নিয়ম। ব্যক্তিগতভাবে নরনারীর মধ্যে প্রভেদ যতই থাকুক না কেন, পশ্চাতে সেই একত্ব রহিয়াছে। বিভিন্ন চরিত্র এবং বিভিন্ন শ্রেণীর নরনারী সৃষ্টি-নিয়মের স্বাভাবিক বৈচিত্র্য মাত্র। এই কারণে একই আদর্শ দ্বারা সকলকে বিচার করা অথবা সকলের সন্মুখে একই আদর্শ স্থাপন করা উচিত নয়। এইরূপ কর্মপ্রণালী কেবল অস্বাভাবিক সংগ্রাম সৃষ্টি করে। তাহার ফল এই দাঁড়ায় যে, মানুষ নিজেকে ঘৃণা করিতে আরম্ভ করে এবং তাহার ধার্মিক ও সৎ হইবার পক্ষে বিশেষ বাধা উপস্থিত হয়। আমাদের কর্তব্য-প্রত্যেক ব্যক্তিকে তাহার নিজের সর্বোচ্চ আদর্শ অনুসারে চলিবার চেষ্টায় উৎসাহিত করা এবং সঙ্গে সঙ্গে ঐ আদর্শ সত্যের যতটা নিকটবর্তী হয়, তাহার জন্যও চেষ্টা করা।
আমরা দেখিতে পাই, অতি প্রাচীনকাল হইতেই হিন্দু ধর্মনীতিতে এই তত্বটি স্বীকৃত হইয়াছে; তাঁহাদের শাস্ত্রে ও ধর্মনীতি-বিষয়ক পুস্তকে ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস-এই-সকল বিভিন্ন আশ্রমের জন্য বিভিন্ন বিধির নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে।
হিন্দুশাস্ত্রমতে মানব-সাধারণের ধর্ম ব্যতীত প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে বিশেষ বিশেষ কর্তব্য আছে। হিন্দুকে প্রথমে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ছাত্ররূপে জীবন আরম্ভ করিতে হয়, তারপর বিবাহ করিয়া গৃহী হইতে হয়; বৃদ্ধাবস্থায় হিন্দু গৃহস্থাশ্রম হইতে অবসর গ্রহণ করিয়া বানপ্রস্থ অবলম্বন করে এবং সর্বশেষে সংসার ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসী হয়। বিভিন্ন আশ্রম অনুসারে জীবনের প্রত্যেক স্তরে বিভিন্ন কর্তব্য উপদিষ্ট হইয়াছে। এই আশ্রমগুলির মধ্যে কোনটিই অপরটি হইতে বড় নয়। যিনি বিবাহ না করিয়া ধর্মকার্যের জন্য জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন, তাঁহার জীবন যত মহৎ, বিবাহিত ব্যক্তির জীবনও তত
মহৎ। সিংহাসনে আরূঢ় রাজা যেরূপ মহান্ ও গৌরাবান্বিত, রাস্তার ঐ ঝাড়ুদারও সেইরূপ। রাজাকে তাঁহার রাজসিংহাসন হইতে উঠাইয়া ঝাড়ুদারের কাজ করিতে দাও-দেখ তিনি কতটা পারেন। আবার ঝাড়ুদারকে লইয়া সিংহাসনে বসাইয়া দাও-দেখ, সে-ই বা রাজকার্য কিরূপে চালায়। সংসারী অপেক্ষা সংসারত্যগী মহত্তর, এ-কথা বলা বৃথা। সংসার হইতে স্বতন্ত্র থাকিয়া স্বাধীন সহজ জীবনযাপন অপেক্ষা সংসারে থাকিয়া ঈশ্বরের উপাসনা করা অনেক কঠিন কাজ। আজকাল ভারতে পূর্বোক্ত চারিটি আশ্রম কেবল গার্হস্থ্য ও সন্ন্যাস- এই দুইটি আশ্রমে পর্যবসিত হইয়াছে। গৃহস্থ বিবাহ করেন এবং সামাজিক কর্তব্য করিয়া যান; আর সংসারত্যাগীর কর্তব্য-তাঁহার সমুদয় শক্তি কেবল ধর্মের দিকে নিয়োজিত করা; তিনি কেবল ঈশ্বরোপাসনা করিবেন এবং ধর্মশিক্ষা দিবেন।
‘মহানির্বাণ-তন্ত্র’ হইতে এই প্রসঙ্গে কিছু পড়িব। ঐগুলি শুনিলে তোমরা বুঝিবে গৃহস্থ হওয়া এবং গৃহস্থের কর্তব্য যথাযথভাবে প্রতিপালন করা অতি কঠিন।
ব্রহ্মনিষ্ঠো গৃহস্থঃ স্যাৎ ব্রহ্মজ্ঞানপরায়ণঃ।
যদ্যৎ কর্ম প্রকুর্বীত তদ্ ব্রহ্মণি সমর্পয়েৎ।।১
-গৃহস্থ ব্যক্তি ঈশ্বরপরায়ণ হইবেন। ব্রহ্মজ্ঞান লাভই যেন তাঁহার জীবনের চরম লক্ষ্য হয়। তথাপি তাঁহাকে সর্বদা কর্ম করিতে হইবে, তাঁহার নিজের সমুদয় কর্তব্য সাধন করিতে হইবে এবং তিনি যাহাই করিবেন, তাহাই তাঁহাকে ব্রহ্মে সমর্পণ করিতে হইবে।
কর্ম করা অথচ ফলাকাঙ্ক্ষা না করা, লোককে সাহায্য করা অথচ তাহার নিকট হইতে কোনপ্রকার কৃতজ্ঞতার প্রত্যাশা না করা, সৎকর্ম করা অথচ উহাতে নাম-যশ হইল বা না হইল, এ-বিষয়ে একেবারে দৃষ্টি না দেওয়া-এইটিই এ জগতে সর্বাপেক্ষা কঠিন ব্যাপার। জগতের লোক যখন প্রশংসা করে, তখন ঘোর কাপুরুষও সাহসী হয়। সমাজের অনুমোদন ও প্রশংসা পাইলে নির্বোধ ব্যক্তিও বীরোচিত কার্য করিতে পারে, কিন্তু কাহারও স্তুতি-প্রশংসা না চাহিয়া অথবা সেদিকে আদৌ দৃষ্টি না দিয়া সর্বদা সৎকার্য করাই প্রকৃতপক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ স্বার্থত্যাগ।
ন মিথ্যাভাষণং কুর্যাৎ ন চ শাঠ্যং সমাচরেৎ।
দেবতাতিথিপূজাসু গৃহস্থো নিরতো ভবেৎ।।২
-গৃহস্থের প্রধান কর্তব্য জীবিকার্জন, কিন্তু তাঁহাকে বিশেষ লক্ষ্য রাখিতে হইবে, মিথ্যা কথা বলিয়া, প্রতারণা দ্বারা অথবা চুরি করিয়া যেন উহা সংগ্রহ না করেন। আর তাঁহাকে স্মরণ রাখিতে হইবে, তাঁহার জীবন ঈশ্বরের সেবার জন্য, দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের সেবার জন্য।