যখন যোগী এই বিবেকজ্ঞান লাভ করেন, তখন তাঁহার নিকট পূর্ব অধ্যায়ে কথিত শক্তিগুলি আসিবে, কিন্তু প্রকৃত যোগী এগুলি পরিত্যাগ করিয়া থাকেন। তখন তিনি এক বিশেষ আলোক দেখিতে পান-তিনি ধর্মমেঘ-নামক এক আশ্চর্য জ্ঞানের অধিকারী হন। ইতিহাস যে-সকল ধর্মগুরুর কথা বর্ণনা করিয়াছে, তাঁহারা সকলেই এই ধর্মমেঘ-সমাধি লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহারা নিজেদের ভিতরেই জ্ঞানের বিশাল ভিত্তি খুঁজিয়া পাইয়াছিলেন। সত্য তাঁহাদের নিকট বাস্তবরূপে প্রকাশিত হইয়াছিল। পূর্বোক্ত শক্তিসমূহের অভিমান ত্যাগ করাতে শান্তি, বিনয় ও পূর্ণ পবিত্রতা তাঁহাদের স্বভাবগত হইয়া গিয়াছিল।
১ পাঠান্তর-কৈবল্যপ্রাগ্ভারং।-তখন অর্থ হইবে, মনে বিবেকজ্ঞান গভীর হয়, এবং উহা কৈবল্যের অভিমুখে ধাবিত হয়।
ততঃ ক্লেশকর্মনিবৃত্তিঃ ।।২৯।।
-তাহা হইতে ক্লেশ ও কর্মের নিবৃত্তি হয়।
যখন এই ধর্মমেঘ-সমাধি হয়, তখন আর পতনের আশঙ্কা নাই, কিছুতেই আর তাঁহাকে নিম্নদিকে টানিয়া লইয়া যাইতে পারে না, আর তাঁহার কোন দুঃখকষ্ট থাকে না।
তদা সর্বাবরণমলাপেতস্য জ্ঞানস্যানন্ত্যাজ্ঞয়মল্পম্ ।।৩০।।
-তখন সর্বপ্রকার আবরণ ও অশুদ্ধি-শূন্য হওয়ায় জ্ঞান অনন্ত হইয়া যায়, সুতরাং জ্ঞেয়ও অল্প হইয়া পড়ে।
জ্ঞান তো ভিতরেই রহিয়াছে, উহার আবরণ সরিয়া গিয়াছে। কোন বৌদ্ধশাস্ত্র ‘বুদ্ধ’ (ইহা একটি অবস্থার সূচক) শব্দের লক্ষণ করিয়াছেন-অনন্ত আকাশের ন্যায় অনন্ত জ্ঞান। যীশু ঐ অবস্থা লাভ করিয়া ‘খ্রীষ্ট’ হইয়াছিলেন। তোমরা সকলেই ঐ অবস্থা লাভ করিবে। তখন জ্ঞান অনন্ত হইয়া যাইবে, সুতরাং জ্ঞেয় অল্প হইয়া যাইবে। সর্বপ্রকার জ্ঞেয়বস্তু-সমন্বিত সমগ্র জগৎ পুরুষের নিকট যেন শূন্যে পরিণত হয়। সাধারণ মানুষ নিজেকে অতি ক্ষুদ্র মনে করে, কারণ তাহার নিকট জ্ঞেয় বস্তু অনন্ত বলিয়া বোধ হয়।
ততঃ কৃতার্থানাং পরিণামক্রমসমাপ্তির্গুণানাম্ ।।৩১।।
-যখন গুণগুলির কার্য শেষ হইয়া যায়, তখন গুণগুলির পর পর যে ভিন্ন ভিন্ন পরিণাম তাহাও শেষ হইয়া যায়।
তখন গুণগুলির এই-সব বিবিধ পরিণাম-এক জাতি হইতে অপর জাতিতে পরিণত-সব একেবারে শেষ হইয়া যায়।
ক্ষণপ্রতিযোগী পরিণামাপরান্তনির্গ্রাহ্যঃ ক্রমঃ ।।৩২।।
-যে পরিণাম ক্ষণ অর্থাৎ মুহূর্তসম্বন্ধ লইয়া অবস্থিত ও যাহাকে একটি শ্রেণীর অপর প্রান্তে (শেষে) যাইয়া বুঝিতে পারা যায়, তাহার নাম ক্রম।
পতঞ্জলি এখানে ‘ক্রম’-শব্দের সংজ্ঞা দিতেছেন। যে পরিণামগুলি মুহূর্তকালসম্বন্ধে সম্বন্ধ, ‘ক্রম’ শব্দ দ্বারা সেগুলিকে বুঝাইতেছে। আমি চিন্তা করিতেছি, ইহারই মধ্যে কতক মুহূর্ত চলিয়া গেল। এই প্রতি মুহূর্তেই ভাবের পরিবর্তন হইয়াছে, কিন্তু আমরা ঐ পরিণামগুলিকে একটি শ্রেণীর অন্তে (অর্থাৎ অনেক পরিণামশ্রেণীর পর) ধরিতে পারি। ইহাকে ‘ক্রম’ বলে। কিন্তু যে-মন সর্বব্যাপী হইয়া গিয়াছে, তাহার পক্ষে আর ‘ক্রম’ নাই। তাহার পক্ষে সবই বর্তমান হইয়া গিয়াছে। কেবল এই বর্তমানই তাহার নিকট উপস্থিত আছে, ভূত ও ভবিষ্যৎ তাহার জ্ঞান হইতে একেবারে চলিয়া গিয়াছে। তখন সেই মন কালকে জয় করে, আর সমুদয় জ্ঞানই তাহার নিকট মুহূর্তের মধ্যে উদ্ভাসিত হয়। সবই তাহার নিকট বিদ্যুতের মতো এক ঝলকে প্রকাশ পায়।
পুরুষার্থশূন্যানাং গূণানাং প্রতিপ্রসবঃ কৈবল্যং
স্বরূপপ্রতিষ্ঠা বা চিতিশক্তেরিতি ।।৩৩।।
-গুণসকলে যখন পুরুষের আর কোন প্রয়োজন থাকে না, তখন তাহাদের প্রতিলোমক্রমে লয়কে ‘কৈবল্য’ বলে, অথবা উহাকে চিৎশক্তির (চৈতন্যশক্তির) স্বরূপপ্রতিষ্ঠা বলিতে পারা যায়।
প্রকৃতির কার্য ফুরাইল। আমাদের পরম কল্যাণময়ী ধাত্রী প্রকৃতি ইচ্ছা করিয়া যে নিঃস্বার্থ কার্য নিজ স্কন্ধে লইয়াছিলেন, তাহা ফুরাইল। তিনি যেন আত্মবিস্মৃত জীবাত্মার হাত ধরিয়া তাঁহাকে জগতে যত প্রকার ভোগ আছে, ধীরে ধীরে সব ভোগ করাইলেন; যত প্রকার প্রকৃতির অভিব্যক্তি-বিকার আছে, সব দেখাইলেন। ক্রমশঃ তাঁহাকে নানাবিধ শরীরের মধ্য দিয়া উচ্চ হইতে উচ্চতর সোপানে লইয়া যাইতে লাগিলেন, শেষে আত্মা নিজ হারানো মহিমা ফিরিয়া পাইলেন, নিজ স্বরূপ পুনরায় তাঁহার স্মৃতিপথে উদিত হইল। তখন সেই করুণাময়ী জননী যে পথে আসিয়াছিলেন, সেই পথেই ফিরিয়া গেলেন এবং যাহারা এই পদচিহ্নহীন জীবনের মরুতে পথ হারাইয়াছে, তাহাদিগকে আবার পথ দেখাইতে প্রবৃত্ত হইলেন। এইভাবে তিনি অনাদি অনন্ত কাল কার্য করিয়া চলিয়াছেন। এইরূপে সুখদুঃখের মধ্য দিয়া, ভালমন্দের মধ্য দিয়া জীবাত্মাগণ অনন্ত স্রোতে প্রবাহিত হইয়া সিদ্ধি ও আত্মসাক্ষাৎকাররূপ সমুদ্রের দিকে চলিয়াছেন।
যাঁহারা নিজেদের স্বরূপ উপলদ্ধি করিয়াছেন, তাঁহাদের জয় হউক! তাঁহারা আমাদের সকলকে আশীর্বাদ করুন!
০৭. পরিশিষ্ট
০৫. পরিশিষ্ট
যোগবিষয়ে অন্যান্য শাস্ত্রে উল্লেখ :
১. শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ্
দ্বিতীয় অধ্যায়
অগ্নির্যত্রাভিমথ্যতে বায়ুর্যত্রাধিরুধ্যতে।
সোমো যত্রাতিরিচ্যতে তত্র সঞ্জায়তে মনঃ ।।৬।।
-যেখানে অগ্নিকে মথন করা হয়, যেখানে বায়ুকে রোধ করা হয় এবং যেখানে অপর্যাপ্ত সোমরস প্রবাহিত হয়, সেখানে (সিদ্ধ) মনের উৎপত্তি হইয়া থাকে।
ত্রিরুন্নতং স্থাপ্য সমং শরীরং
হৃদীন্দ্রিয়াণি মনসা সন্নিবেশ্য।
ব্রহ্মোড়ুপেন প্রতরেত বিদ্বান্
স্রোতাংসি সর্বাণি ভয়াবহানি ।।৮।।