১ কোন কোন গ্রন্থে এইখানে আরেকটি সূত্র আছে। এই সূত্রটি বৃত্তিকার ভোজদেব গ্রহণ করেন নাই, কিন্তু ব্যাসভাষ্যে আছে:
ন চৈকচিত্ততন্ত্রং বস্তু তদপ্রমাণকং তদা কিং স্যাৎ।।
(দৃশ্য) বস্তু একটি মাত্র চিত্তের অধীন নয়, কারণ যখন সেই চিত্তের প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের অবিষয় হইবে (যখন ঐ চিত্ত বিষয়ান্তরে মগ্ন বা সুষুপ্তি বা সমাধিতে লীন হইবে), তখন ঐ বস্তুর কি হইবে?-তখন কি উহার কোন অস্তিত্ব থাকিবে না?
ন তৎ স্বাভাসং দৃশ্যত্বাৎ ।।১৮।।
-মন দৃশ্য (পদার্থ) বলিয়া স্বয়ংপ্রকাশ নয়।
প্রকৃতির সর্বত্রই প্রচন্ড শক্তির বিকাশ দেখা যায়, কিন্তু প্রকৃতি স্বপ্রকাশ নয়, স্বভাবতঃ চৈতন্যস্বরূপ নয়। কেবল পুরুষই স্বপ্রকাশ, তাঁহার জ্যোতিতেই প্রত্যেক বস্তু উদ্ভাসিত হইতেছে। তাঁহারই শক্তি জড় ও অন্যান্য শক্তির মধ্য দিয়া সঞ্চারিত হইতেছে।
একসময়ে চোভয়ানবধারণম্ ।।১৯।।
-এক সময়ে দুইটি বস্তুকে বুঝিতে পারে না বলিয়া মন স্বপ্রকাশ নয়।
মন যদি স্বপ্রকাশ হইত, তবে একই সময়ে উহা নিজেকে ও উহার প্রকাশ্য
বস্তুগুলিকে অনুভব করিতে পারিত; মন তো তাহা পারে না। যদি এক বস্তুতে গভীর মনোযোগ প্রদান কর, তবে আর অন্য বস্তুতে মন এক সময়ে নিজেকে ও বিষয়কে অনুভব করিতে পারে না বলিয়া উহা স্বপ্রকাশ নয়, পুরুষই স্বপ্রকাশ।
চিত্তান্তরদৃশ্যত্বে বুদ্ধি বুদ্ধেরতিপ্রসঙ্গঃ স্মৃতিসঙ্করশ্চ ।।২০।।
-যদি কল্পনা করা যায় যে, আর এক চিত্ত ঐ চিত্তকে প্রকাশ করে, তবে এইরূপ কল্পনার অন্ত থাকিবে না এবং স্মৃতির গোলমাল হইয়া যাইবে।
মনে কর-আর একটি মন রহিয়াছে, উহা এই সাধারণ মনটিকে অনুভব করিতেছে, তাহা হইলে আবার এমন একটি মনের আবশ্যক, যাহা আবার ঐ মনটিকে অনুভব করিবে, সুতরাং কোথাও ইহার শেষ পাওয়া যাইবে না। ইহাতে স্মৃতিরও গোলমাল উপস্থিত হইবে, কারণ স্মৃতির কোন নির্দিষ্ট ভান্ডার থাকিবে না।।
চিতেরপ্রতিসংক্রমায়াস্তদাকারাপত্তৌ স্ববুদ্ধিসম্বেদনম্ ।।২১।।
-চিতি (পুরুষের শক্তি) অপরিণামী (পরিবর্তিত হয় না, অপরের দিকে সঞ্চারিত হয় না); যখন মন চিতিশক্তির আকার গ্রহণ করে, তখনই উহা জ্ঞানময় হয়।
জ্ঞান যে পুরুষের গুণ নয়, ইহা স্পষ্টতর ভাবে বুঝাইবার জন্য পতঞ্জলি এই কথা বলিলেন। মন যখন পুরুষের নিকট আসে, তখন যেন পুরুষ মনের উপর প্রতিফলিত হন আর মন সাময়িকভাবে জ্ঞানবান্ হয়, আর বোধ হয় যেন মনই পুরুষ।
দ্রষ্টৃ-দৃশ্যোপরক্তং চিত্তং সর্বার্থম্ ।।২২।।
-মন যখন দ্রষ্টা ও দৃশ্য উভয়দ্বারা উপরক্ত (রঞ্জিত) হয়, তখন উহা সর্বপ্রকার অর্থকেই প্রকাশ করে।
একদিকে দৃশ্য অর্থাৎ বাহ্য জগৎ মনের উপর প্রতিবিম্বিত হইতেছে, অপর দিকে দ্রষ্টা অর্থাৎ পুরুষ উহার উপর প্রতিবিম্বিত হইতেছেন; এইভাবেই মনে সর্বপ্রকার জ্ঞানলাভের শক্তি আসে।
তদসংখ্যেয়বাসনাভিশ্চিত্রমপি পরার্থং সংহত্যকারিত্বাৎ ।।২৩।।
-সেই মন অসংখ্য বাসনাদ্বারা চিত্রিত হইলেও সংহত পদার্থ বলিয়া পরের অর্থাৎ পুরুষের জন্য কার্য করে।
মন নানাপ্রকার পদার্থের সংহতি; সুতরাং উহা নিজের জন্য কার্য করিতে পারে না। এই জগতে যত সংহত পদার্থ আছে, সকলেরই প্রয়োজন অপর বস্তুতে-এমন কোন তৃতীয় বস্তুতে-যাহার জন্য সেই পদার্থ এইরূপে সংযুক্ত হইয়াছে। সুতরাং নানাপ্রকার বস্তুর সংযোগে উৎপন্ন মনও পুরুষের জন্য।
বিশেষদর্শিন আত্মাভাব-ভাবনা-বিনিবৃত্তিঃ ।।২৪।।
-বিশেষদর্শী অর্থাৎ বিবেকী পুরুষের পক্ষে মনে আত্মভাব নিবৃত্ত হইয়া যায়।
বিবেকবলে যোগী জানিতে পারেন, পুরুষ মন নন।
তদা বিবেকনিম্নং কৈবল্যপ্রাগ্ভাবং১চিত্তম্ ।।২৫।।
-তখন চিত্ত বিবেকপ্রবণ হইয়া কৈবল্যের পূর্বাবস্থা লাভ করে।
এইরূপ যোগাভ্যাসের দ্বারা বিবেকশক্তিরূপ দৃষ্টির শুদ্ধতা লাভ হইয়া থাকে। আমাদের দৃষ্টির আবরণ সরিয়া যায়, আমরা তখন বস্তুর স্বরূপ উপলব্ধি করিতে পারি। আমরা বুঝিতে পারি যে, প্রকৃতি একটি মিশ্র পদার্থ, উহা সাক্ষিস্বরূপ পুরুষের জন্য এই-সকল বিচিত্র দৃশ্য দেখাইতেছে। আমরা তখন বুঝিতে পারি, প্রকৃতি জগতের প্রভু নয়। এই প্রকৃতির সমুদয় সংহতি কেবল আমাদের হৃদয়সিংহাসনে সমাসীন রাজা পুরুষকে এই-সব দৃশ্য দেখাইবার জন্য। যখন দীর্ঘকাল অভ্যাসের দ্বারা বিবেকর উদয় হয়, ভয় চলিয়া যায় ও কৈবল্যপ্রাপ্তি হয়।
তচ্ছিদ্রেষু প্রত্যয়ান্তরাণি সংস্কারেভ্যঃ ।।২৬।।
-উহার বিঘ্নরূপে মধ্যে মধ্যে অন্যান্য চিন্তা মনে উঠে, তাহা সংস্কার হইতেই উৎপন্ন হয়।
আমাকে সুখী করিবার জন্য কোন বাহিরের বস্তু আবশ্যক-এইরূপ বিশ্বাস আমাদের যে-সকল ভাব হইতে আসে, সেগুলি সিদ্ধিলাভের প্রতিবন্ধক। পুরুষ স্বভাবতঃ সুখ-ও আনন্দ-স্বরূপ। কিন্তু এই জ্ঞান পূর্বসংস্কারের দ্বারা আবৃত রহিয়াছে। এই সংস্কারগুলির ক্ষয় হওয়া আবশ্যক।
হানমেষাং ক্লেশবদুক্তম্ ।।২৭।।
-(অবিদ্যা, অস্মিতা প্রভৃতি) ক্লেশগুলিকে যে উপায়ের দ্বারা ধ্বংস করার কথা বলা হইয়াছে (২।১০), এগুলিকেও ঠিক সেই উপায়েই নাশ করিতে হইবে।
প্রসংখ্যানেহপ্যকুসীদস্য সর্বথাবিবেকখ্যাতের্ধর্মমেঘঃ সমাধিঃ ।।২৮।।
-তত্ত্বসমূহের বিবেকজ্ঞানলাভের ঠিক পূর্বে ঐশ্বর্ষরূপ ফলও যিনি ত্যাগ করেন, বিবেকজ্ঞানের ফলে তাঁহার ধর্মমেঘ-নামক সমাধি লাভ হইয়া থাকে।