জাতিদেশকালব্যবহিতানামপ্যানন্তর্যং স্মৃতিসংস্কারয়োরেকরূপত্বাৎ ।।৯।।
-স্মৃতি ও সংস্কার একরূপ বলিয়া জাতি, দেশ ও কাল ব্যবহিত হইলেও বাসনার আনন্তর্ষ হইবে।
অনুভূতিসমূহ সূক্ষ্ম সংস্কাররূপে পরিণত হয়, জাগরিত সংস্কারকেই ‘স্মৃতি’ বলে। বর্তমানে জ্ঞাতসারে কৃত কর্মের সহিত সংস্কাররূপে পরিণত পূর্বানুভূতিসমূহের মনের অগোচরে যে সমন্বয় হয়, তাহাও এই স্মৃতির অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যেক দেহে, তজ্জাতীয় দেহে যে-সকল সংস্কার লব্ধ হইয়াছে, কেবল সেগুলি সেই দেহে কর্মের কারণ হইবে। ভিন্ন জাতীয় দেহের সংস্কার তখন স্তিমিতভাবে থাকিবে। প্রত্যেক শরীরই সেই জাতীয় কতকগুলি শরীরের উত্তর-পুরুষরূপে কার্য করিবে। এইরূপে বাসনার পৌর্বাপর্য নষ্ট হয় না।
তাসামনাদিত্বঞ্চাশিষো নিত্যত্বাৎ ।।১০।।
-সুখের বাসনা নিত্য বলিয়া বাসনাও অনাদি।
আমাদের সকল ভোগ ও অভিজ্ঞতা সুখী হইবার বাসনা হইতেই উৎপন্ন। এই ভোগের কোন আদি নাই; কারণ প্রত্যেক নূতন ভোগই পূর্বভোগের দ্বারা আমাদের চিত্তে যে এক প্রকার প্রবণতা উৎপন্ন হইয়াছে, তাহারই উপর স্থাপিত। এই কারণে বাসনা অনাদি।
হেতুফলাশ্রয়ালম্বনৈঃ সংগৃহীতত্বাদেষামভাবে তদভাবঃ ।।১১।।
-এই বাসনাগুলি হেতু, ফল, আধার ও তাহার বিষয়- এইগুলি দ্বারা একত্র গ্রথিত বলিয়া ইহাদের অভাব হইলে বাসনারও অভাব হয়।
এই বাসনাগুলি কার্যকারণসূত্রে গ্রথিত১; মনে কোন বাসনা উদিত হইলে উহা স্বীয় ফলপ্রসব না করিয়া বিনষ্ট হইবে না। আবার মন সংস্কাররূপে পরিণত অতীত বাসনাসমূহের আধার-বৃহৎ ভান্ডারস্বরূপ; যতক্ষণ না ঐগুলি কর্মরূপে নিঃশেষিত হইতেছে, ততক্ষণ উহাদের বিনাশ নাই। আবার যতদিন ইন্দ্রিয়গণ বাহ্যবস্তু গ্রহণ করিবে, ততদিন নূতন নূতন বাসনা উত্থিত হইবে। যদি এইগুলি (কার্য, কারণ, আধার ও বিষয়) হইতে অব্যাহতি পাওয়া সম্ভব হয়, তবেই বাসনার বিনাশ হইতে পারে।
অতীতানাগতং স্বরূপতোহস্ত্যধ্বভেদাদ্ধর্মাণাম্ ।।১২।।
-বস্তুর ধর্ম (বা গুণ) সকলই বিভিন্ন রূপ ধারণ করিয়াছে বলিয়া অতীত ও ভবিষ্যৎ (বর্তমানে দৃষ্টি না হইলেও) তাহাদের স্বরূপেই অবস্থিত আছে।
তাৎপর্য এই যে, অসৎ (অনস্তিত্ব) হইতে কখনও সৎ (অস্তিত্ব) উৎপন্ন হয় না। অতীত ও ভবিষ্যৎ যদিও ব্যক্তরূপে এখন নাই, তথাপি সূক্ষ্মাকারে বিদ্যমান আছে।
১ এই প্রসঙ্গ দ্রষ্টব্যঃ যোগসূত্রের ২।৩, ২।১৩ ও ৪।৭ সূত্র।
তে ব্যক্তসূক্ষ্মা গুণাত্মানঃ ।।১৩।।
-উহারা কখনও ব্যক্ত, কখনও বা সূক্ষ্ম অবস্থায় অবস্থান করে, আর গুণই উহাদের আত্মা অর্থাৎ স্বরূপ।/p>
গুণ বলিতে সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ-এই তিন উপাদানকে বুঝায়, উহাদের স্থূল অবস্থাই এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ। অতীত ও ভবিষ্যৎ এই গুণ কযেকটিরই বিভিন্ন প্রকাশে উৎপন্ন হয়।
পরিণামৈকত্বাদ্বস্তুতত্ত্বম্ ।।১৪।।
-পরিণামের মধ্যে একত্ব দেখা যায় বলিয়া বস্তু বাস্তবিক এক।
যদিও উপাদান তিনটি-অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ, তথাপি তাহাদের পরিণাম ও পরিবর্তনের ভিতরে একটি সম্বন্ধ থাকায় সকল বস্তুতেই একত্ব আছে, বুঝিতে হইবে।
বস্তুসাম্যে চিত্তভেদাত্তয়োর্বিভক্তঃ পন্থাঃ ।।১৫।।
-বস্তু এক হইলেও চিত্ত ভিন্ন ভিন্ন বলিয়া ভিন্ন ভিন্ন রূপ বাসনা ও অনুভূতি হইয়া থাকে। একই বস্তু সম্পর্কে যেহেতু অনুভূতি ও বাসনা ভিন্ন ভিন্ন হয়, অতএব মন ও বিষয় ভিন্নস্বভাব।১
তদুপরাগাপেক্ষিত্বাচ্চিত্তস্য বস্তু জ্ঞাতাজ্ঞাতম্ ।।১৬।।
-চিত্তে বস্তুর প্রতিবিম্বপাতের অপেক্ষা থাকাতে বস্তু কখন জ্ঞাত ও কখন অজ্ঞাত থাকে।
সদা জ্ঞাতাশ্চিত্তবৃত্তয়স্তৎপ্রভোঃ পুরুষস্যাহপরিণামিত্বাৎ ।।১৭।।
-চিত্তবৃত্তিগুলিকে সর্বদাই জানা যায়, কারণ উহাদের প্রভু পুরুষ অপরিণামী।
এতক্ষণ ধরিয়া যে মতের কথা বলা হইতেছে, তাহার সংক্ষিপ্ত মর্ম এই যে, জগৎ মনোময় ও ভৌতিক-এই উভয় প্রকারই। আর এই মনোময় ও ভৌতিক জগৎ সর্বদাই যেন প্রবাহের আকারে চলিয়াছে। এই পুস্তকখানি কি? ইহা নিত্যপরিবর্তনশীল কতকগুলি পরমাণুর সমষ্টিমাত্র। কতকগুলি বাহিরে যাইতেছে, কতকগুলি ভিতরে আসিতেছে, উহা একটি আবর্তস্বরূপ। কিন্তু এই একত্ববোধ কি করিয়া হইতেছে? এটি যে সেই একই পুস্তক, এই বোধ কি করিয়া হইতেছে? এই পরিণামগুলি তালে তালে হইতেছে; তালে তালে উহারা আমার মনে তাহাদের প্রভাব প্রেরণ করিতেছে। যদিও উহাদের ভিন্ন ভিন্ন অংশগুলি সদা পরিবর্তনশীল, তথাপি উহারাই একত্র হইয়া একটি অবিচ্ছিন্ন চিত্রের জ্ঞান উৎপন্ন করিতেছে। মনও এইরূপ সদা পরিবর্তনশীল। মন আর শরীর যেন বিভিন্ন বেগে গতিশীল একই পদার্থের দুইটি স্তর মাত্র। তুলনায় একটি মৃদু ও অপরটি দ্রুততর বলিয়া অবশ্য আমরা ঐ দুইটি গতির মধ্যে পার্থক্য অনায়াসে ধরিতে পারি। যেমন একটি ট্রেন চলিতেছে এবং একখানি গাড়ি তাহার পাশ দিয়া যাইতেছে। কিছুদূর পর্যন্ত এই উভয়েরই গতি নির্ণীত হইতে পারে। কিন্তু তথাপি আর একটি পদার্থের প্রয়োজন। নিশ্চল বস্তু একটি থাকিলেই গতিকে অনুভব করা যাইতে পারে। তবে যখন দুই-তিনটি বস্তু বিভিন্ন গতিবিশিষ্ট হয়, তখন আমরা প্রথমে দ্রুততরটির, পরিশেষে মৃদুতর গতিশীল বস্তুটির গতি অনুভব করিতে পারি। মন কি করিয়া অনুভব করিবে? উহাও নিয়ত গতিশীল। সুতরাং অপর একটি বস্তু থাকা প্রয়োজন, যাহা অপেক্ষাকৃত মৃদুভাবে গতিশীল; পরে তদপেক্ষা মৃদুতর, তদপেক্ষা মৃদুতর এইরূপ চলিতে চলিতে ইহার আর সীমা পাওয়া যাইবে না। সুতরাং যুক্তি তোমাকে কোন একস্থানে থামিতে বাধ্য করিবে। অপরিবর্তনীয় কোন বস্তুকে জানিয়া তোমাকে এই পর্যায়ের শেষ করিতেই হইবে। এই অশেষ গতিশৃঙ্খলের পশ্চাতে অপরিণামী, অসঙ্গ, শুদ্ধস্বরূপ পুরুষ রহিয়াছেন। যেমন ম্যাজিক লন্ঠন হইতে আলোক আসিয়া স্থির বস্ত্রখন্ডের উপর প্রতিফলিত হইয়া উহাতে নানা বর্ণের চিত্র উৎপন্ন করে, অথচ কোনরূপেই উহাকে মলিন বা রঞ্জিত করে না, ঠিক সেইভাবেই এই-সব সংস্কার স্থির পুরুষের উপর প্রতিফলিত হইতেছে মাত্র।