তারকং সর্ববিষয়ং সর্বথা-বিষয়মক্রমঞ্চেতি বিবেকজং জ্ঞানম্ ।।৫৫।।
-যে বিবেকজ্ঞান সকল বস্তু ও বস্তুর সর্ববিধ অবস্থাকে যুগপৎ গ্রহণ করিতে পারে, তাহাকে ‘তারকজ্ঞান’ বলে।
‘তারক’ অর্থে যাহা যোগীকে সংসার (জন্ম-মৃত্যুর সাগর) হইতে তারণ করে। সমগ্র প্রকৃতির সূক্ষ্ম স্থূল সর্ববিধ অবস্থা এই জ্ঞানের আয়ত্তের মধ্যে। এই জ্ঞানে কোনরূপ ক্রম নাই। ইহা সমুদয় বস্তুকে যুগপৎ-একদৃষ্টিতে গ্রহণ করিতে পারে।
সত্ত্বপুরুষয়োঃ শুদ্ধিসাম্যে কৈবল্যমিতি ।।৫৬।।
-যখন সত্ত্ব পুরুষের শুদ্ধির সমতা হয়, তখনই কৈবল্যলাভ হয়।
কৈবল্যই আমাদের লক্ষ্য; যখন এই লক্ষ্যস্থলে পৌঁছিতে পারা যায়, তখন আত্মা বুঝিতে পারেন যে, তিনি চিরকাল একাকী, ‘কেবল’ (শুদ্ধ); তাঁহাকে সুখী করিবার জন্য আর কাহারও প্রয়োজন নাই। যতদিন আমরা আমাদিগকে সুখী করিবার জন্য আর কাহাকেও চাই, ততদিন আমরা দাসমাত্র। যখন পুরুষ জানিতে পারেন-তিনি মুক্তস্বভাব ও তাঁহাকে পূর্ণ করিতে আর কাহারও প্রয়োজন হয় না-আর এই প্রকৃতি ক্ষণিক, ইহার কোন প্রয়োজন নাই, তখনই তিনি মুক্তিলাভ করেন, তখনই তাঁহার এই কৈবল্যলাভ হয়। যখন আত্মা জানিতে পারেন যে, জগতে ক্ষুদ্রতম পরমাণু হইতে দেবতা পর্যন্ত কোন কিছুরই উপর তিনি নির্ভর করেন না, তখন তাঁহার সেই অবস্থাকে কৈবল্য (পৃথকত্ব) ও পূর্ণতা বলে। যখন শুদ্ধি ও অশুদ্ধি উভয় মিশ্রিত ‘সত্ত্ব’ অর্থাৎ বুদ্ধি পুরুষেরই মতো শুদ্ধ হইয়া যায়, তখনই এই কৈবল্যলাভ হইয়া থাকে, তখন সেই শুদ্ধবুদ্ধি কেবল নির্গুণ পবিত্রস্বরূপ পুরুষকেই প্রতিফলিত করে।
০৪. কৈবল্য-পাদ (চতুর্থ অধ্যায়)
জন্মৌষধিমন্ত্রতপঃসমাধিজাঃ সিদ্ধায়ঃ ।।১।।
-সিদ্ধি (শক্তি)-সমূহ জন্ম, ঔষধ, মন্ত্র, তপস্যা ও সমাধি হইতে উৎপন্ন হয়।
কখনও কখনও মানুষ পূর্বজন্মলব্ধ সিদ্ধি লইয়া জন্মগ্রহণ করে। এই জন্মে সে যেন তাহাদের ফলভোগ করিতেই আসে। সাংখ্যদর্শনের পিতাস্বরূপ কপিল সম্বন্ধে কথিত আছে যে, তিনি সিদ্ধ১হইয়া জন্মিয়াছিলেন। ‘সিদ্ধ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ-যিনি সফল বা কৃতকার্য হইয়াছেন।
যোগীরা বলেন, রাসায়নিক উপায়ে অর্থাৎ ঔষধাদি দ্বারা এই-সকল শক্তি লাভ করা যাইতে পারে। তোমরা সকলেই জানো যে, রসায়নবিদ্যার প্রারম্ভ আলকেমি (alchemy) হইতে। মানুষ পরশ-পাথর (philosopher’s stone), সঞ্জীবনী অমৃত (elixir of life) ইত্যাদির অন্বেষণ করিত। ভারতবর্ষে ‘রসায়ন’ নামে এক সম্প্রদায় ছিল। তাহাদের মত ছিলঃ সূক্ষ্মতত্ত্বপ্রিয়তা, জ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা, ধর্ম-এ সব খুবই ভাল, কিন্তু এ-গুলি লাভ করিবার একমাত্র উপায় এই শরীর। যদি মধ্যে মধ্যে শরীর ভগ্ন অর্থাৎ মৃত্যুগ্রস্ত হয়, তবে সেই চরমলক্ষ্যে পৌছিতে অনেক সময় লাগিবে। মনে কর, কোন ব্যক্তি যোগ অভ্যাস করিতে বা আধ্যাত্মিকভাবাপন্ন হইতে ইচ্ছুক। কিন্তু যথেষ্ট উন্নতি করিতে না করিতেই তাহার মৃত্যু হইল। তখন সে আর এক দেহ লইয়া পুনরায় সাধন করিতে আরম্ভ করিল, আবার তাহার মৃত্যু হইল; এইরূপে পুনঃপুনঃ জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুতেই তাহার অধিকাংশ সময় নষ্ট হইয়া গেল। যদি শরীরকে এরূপ সবল ও নিখুঁত করিতে পারা যায় যে, উহার জন্মমৃত্যু একেবারে বন্ধ হয়, তাহা হইলে আধ্যাত্মিক উন্নতি করিবার অনেক সময় পাওয়া যাইবে। এই কারণে এই রাসায়নেরা বলিয়া থাকেন, ‘প্রথমে শরীরকে খুব সবল কর।’ তাঁহারা বলেন, শরীরকে অমর করা যাইতে পারে। ইঁহাদের মনের ভাব এই যে, শরীর গঠন করিবার কর্তা যদি মন হয়, আর ইহা যদি সত্য হয় যে, প্রত্যেক ব্যক্তির মন সেই অনন্ত শক্তিপ্রকাশের এই একটি বিশেষ প্রণালীমাত্র, তবে এইরূপ প্রত্যেক প্রণালীর বাহির হইতে যথেচ্ছ শক্তি সংগ্রহ করিবার কোন সীমা নির্দিষ্ট থাকিতে পারে না। সুতরাং আমরা চিরকাল এই শরীরকে রাখিতে পারিব না কেন? যত শরীর আমরা ধারণ করি, সব আমাদিগকেই গঠন করিতে হয়। যখনই এই শরীরের পতন হইবে, তখন আবার আমাদিগকেই আর একটি শরীর গঠন করিতে হইবে। যদি আমাদের এই ক্ষমতা থাকে, তবে এই শরীর হইতে বাহিরে না গিয়া আমরা এখানেই এবং এখনই সেই গঠনকার্য করিতে পারিব না কেন? তত্ত্বের দিক দিয়া ইহা সম্পূর্ণ সত্য। ইহা যদি সম্ভব হয় যে, আমরা মৃত্যুর পরও (কোন একভাবে) জীবিত থাকি এবং নিজ নিজ শরীর গঠন করি, তবে শরীরকে সম্পূর্ণ ধ্বংস না করিয়া কেবল উহাকে ক্রমশঃ পরিবর্তিত করিয়া এই পৃথিবীতে (নূতনতর) শরীর গঠন করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হইবে কেন? তাঁহাদের আরও বিশ্বাস ছিল যে, পারদে ও গন্ধকে অত্যদ্ভুত শক্তি লুক্কায়িত আছে। এই দ্রব্যগুলি হইতে প্রস্তুত কোন বিশেষ ‘রসায়ন’ দ্বারা মানুষ যতদিন ইচ্ছা শরীরকে অবিকৃত রাখিতে পারে। অপর কেহ বিশ্বাস করিত যে, ঔষধবিশেষের সেবনে আকাশ-গমনাদি সিদ্ধিলাভ হইতে পারে। আজকালকার অধিকাংশ আশ্চর্য ঔষধই, বিশেষতঃ ঔষধে ধাতুর ব্যবহার, আমরা এই রসায়নবিদ্যা হইতে পাইয়াছি। কোন কোন যোগিসম্প্রদায় দাবি করেন, তাঁহাদের প্রধান প্রধান গুরুরা অনেকে এখনও তাঁহাদের পুরাতন শরীরেই বিদ্যমান আছেন। যোগসম্বন্ধে শ্রেষ্ঠ প্রমাণভূত (যাঁহার প্রামাণ্য অকাট্য, সেই) পতঞ্জলিও ইহা অস্বীকার করেন না।
১ তুলনীয়ঃ ‘সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ’-গীতা, ১০।২৬