উদানজয়াজ্জল-পঙ্ক-কন্টকাদিষ্বসঙ্গ উৎক্রান্তিশ্চ ।।৪০।।।
-উদান-নামক স্নায়ুপ্রবাহ জয় করিতে পারিলে যোগী জলে বা পঙ্কে মগ্ন হন না, তিনি কন্টকের উপর ভ্রমণ করিতে পারেন ও ইচ্ছামৃত্যু হন।
‘উদান’-নামক যে স্নায়বীয় শক্তিপ্রবাহ ফুসফুস ও শরীরের উপরিস্থ সমুদয়
অংশকে নিয়মিত করে, যোগী যখন তাহা জয় করিতে পারেন, তখন তিনি অতিশয় লঘু হইয়া যান। তিনি আর জলে মগ্ন হন না, কন্টকের উপর ও তরবারি-ফলকের উপর অনায়াসে চলিতে পারেন, অগ্নির মধ্যে দাঁড়াইয়া থাকিতে পারেন, এবং ইচ্ছামাত্র এই শরীর ত্যাগ করিতে পারেন।
সমানজয়াৎ প্রজ্বলনম্ ।।৪১।।
-সমান-প্রবাহকে জয় করিলে তিনি জ্যোতিঃ দ্বারা বেষ্টিত হইয়া থাকেন।
এ-অবস্থায় তিনি যখনই ইচ্ছা করেন, তখনই তাঁহার শরীর হইতে জ্যোতিঃ নির্গত হয়।
শ্রোত্রাকাশয়োঃ সম্বন্ধসংযমান্দিব্যং শ্রোত্রম্ ।।৪২।।
-কর্ণ ও আকাশের পরস্পর যে সম্বন্ধ আছে, তাহার উপর সংযম করিলে দিব্য শ্রোত্র লাভ হয়।
এই আকাশ (ইথার) ও তাহাকে অনুভব করিবার যন্ত্রস্বরূপ কর্ণ রহিয়াছে। ইহাদের উপর সংযম করিলে যোগী দিব্য শ্রোত্র লাভ করেন। তখন তিনি সমুদয় শব্দ শুনিতে পান। বহুদূরে কোন কথাবার্তা বা শব্দ হইলে তাহাও তিনি শুনিতে পান।
কায়াকাশয়োঃ সম্বন্ধসংযমাল্লঘুতুলসমাপত্তেশ্চাকাশগমনম্ ।।৪৩।।
-শরীরের ও আকাশের সম্বন্ধের উপর চিত্তসংযম করিয়া এবং তুলা প্রভৃতির ন্যায় আপনাকে লঘু ভাবনা করিয়া যোগী আকাশের মধ্য দিয়া গমন করিতে পারেন।
আকাশই এই শরীরের উপাদান; আকাশই এক বিশেষরূপে এই শরীর হইয়াছে। যদি যোগী শরীরের উপাদান ঐ আকাশ-ধাতুর উপর সংযম প্রয়োগ করেন, তবে তিনি আকাশের ন্যায় লঘুতা প্রাপ্ত হন ও বায়ুর মধ্য দিয়া যেখানে ইচ্ছা যাইতে পারেন।
বহিরকল্পিতা বৃত্তিমহাবিদেহা ততঃ প্রকাশাবরণক্ষয়ঃ ।।৪৪।।
-দেহের বাহিরে মনের যে ‘যথার্থ বৃত্তি’ অর্থাৎ মনের ধারণা, তাহার নাম ‘মহাবিদেহ’; তাহার উপর সংযম প্রয়োগ করিলে প্রকাশের যে আবরণ, তাহা ক্ষয় হইয়া যায়।
মন অজ্ঞতাবশতঃ বিবেচনা করে, সে এই দেহের ভিতর দিয়া কাজ করিতেছে। যদি মন সর্বব্যাপী হয়, তবে আমি কেবল এক প্রকার স্নায়ুমন্ডলীর দ্বারা আবদ্ধ থাকিব কেন, অথবা এই অহংকে একটি শরীরেই আবদ্ধ করিয়া রাখিব কেন? ইহার তো কোন যুক্তি দেখিতে পাওয়া যায় না। যোগী চান, যেখানে ইচ্ছা সেখানে তিনি এই ‘আমিত্ব’ অনুভব করিবেন। অহংভাব চলিয়া গিয়া যে মানসিক বৃত্তিপ্রবাহ এই দেহে জাগরিত হয়, তাহাকে ‘অকল্পিতা বৃত্তি’ বা ‘মহাবিদেহ’ বলে। যখন তিনি উহার উপর
‘সংযম’ করিতে পারেন, তখন প্রকাশের সকল আবরণ চলিয়া যায় এবং সমুদয় অন্ধকার ও অজ্ঞান দূরীভূত হয়, সমস্তই তাঁহার নিকট জ্ঞানময়-চৈতন্যময় বলিয়া বোধ হয়।
স্থূলস্বরূপ-সূক্ষ্মান্বয়ার্থবত্ত্ব-সংযমাম্ভূতজয়ঃ ।।৪৫।।
-ভূতগণের স্থূল স্বরূপ, সূক্ষ্ম অন্বয় ও অর্থবত্ত্ব-এই কয়েকটির উপর সংযম করিলে ভূতজয় হয়।১
যোগী সমুদয় ভূতের উপর সংযম করেন; প্রথম স্থূলভূতের উপর, তারপর উহার সূক্ষ্ম অবস্থার উপর ‘সংযম’ করেন। এক সম্প্রদায়ের বৌদ্ধগণ এই সংযমটি বিশেষভাবে গ্রহণ করিয়া থাকেন। খানিকটা কাদার তাল লইয়া তাঁহারা উপার উপর ‘সংযম’ প্রয়োগ করেন, ক্রমশঃ উহা যে-সকল সূক্ষ্মভূতে নির্মিত, তাহা দেখিতে আরম্ভ করেন। যখন তাঁহারা ঐ সূক্ষ্মভূতের বিষয় জানিতে পারেন, তখনই তাঁহারা ঐ ভূতের উপর শক্তিলাভ করেন। সমুদয় ভূতের পক্ষেই এইরূপ বুঝিতে হইবে-যোগী এগুলি সবই জয় করিতে পারেন।
ততোহণিমাদি-প্রাদুর্ভাবঃ কায়সম্পৎতদ্ধর্মানভিঘাতশ্চ ।।৪৬।।
-তাহা হইতেই অণিমা ইত্যাদি সিদ্ধির আবির্ভাব হয়, কায়সম্পৎ লাভ হয় ও সমুদয় শারীরিক ধর্মের অনভিঘাত হয় (অর্থাৎ ধ্বংস হয় না)।
ইহার অর্থ এই যে, যোগী অষ্টসিদ্ধি২ লাভ করেন। তিনি নিজেকে ইচ্ছামত ‘অণু’ করিতে পারেন, খুব বৃহৎ করিতে পারেন, পৃথিবীর ন্যায় গুরু ও বায়ুর ন্যায় লঘু করিতে পারেন, যাহার উপর ইচ্ছা প্রভুত্ব করিতে পারেন, যাহা ইচ্ছা তাহাই জয় করিতে পারেন, তাঁহার ইচ্ছায় সিংহ তাঁহার পদতলে মেষের ন্যায় শান্তভাবে বসিয়া থাকিবে ও তাঁহার সমুদয় বাসনাই তাঁহার ইচ্ছামত পরিপূর্ণ হইবে।
রূপ-লাবণ্য-বল-বজ্রসংহননত্বানি কায়সম্পৎ ।।৪৭।।
-কায়সম্পৎ বলিতে সৌন্দর্য, সুন্দর অঙ্গকান্তি, বল ও বজ্রবৎ দৃঢ়তা বুঝায়।
তখন শরীর অবিনাশী হইয়া যায়, কিছুই উহার কোন ক্ষতি করিতে পারে না। যোগী যদি ইচ্ছা না করেন, তবে কিছুই তাঁহার শরীর বিনাশ করিতে পারে না, কালদন্ড
১ স্বরূপ-পৃথিবীর কাঠিন্য, জলের তারল্যাদি। অন্বয়-সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ প্রত্যেক ভূতে অম্বিত রহিয়াছে, ইহা জানা। অর্থবত্ত্ব-বিশেষ ভোগপ্রদান-সামর্থ্য।
২ অষ্টসিদ্ধিঃ অণিমা, লঘিমা, মহিমা, প্রাপ্তি (দুরস্থ দ্রব্যও সন্নিহিত হওয়া), প্রাকাম্য (ইচ্ছার অনভিঘাত), বশিত্ত্ব, ঈশিত্ব ও কামবসায়িত্ব (সত্যসংকল্পতা)।
ভঙ্গ করিয়া তিনি এই জগতে সশরীরে বাস করেন। বেদে লিখিত আছে, সেই ব্যক্তির রোগ, মৃত্যু অথবা কোন ক্লেশ হয় না।১
গ্রহণস্বরূপাস্মিতান্বয়ার্থবত্ত্বসংযমাদিন্দ্রিয়জয়ঃ ।।৪৮।।
-ইন্দ্রিয়গণের বাহ্যপদার্থাভিমুখী গতি, তজ্জনিত জ্ঞান, এই জ্ঞান হইতে বিকশিত অহং-প্রত্যয়, উহাদের ত্রিগুণময়ত্ব ও ভোগাদাতৃত্ব-এই কয়েকটির উপর সংযম করিলে ইন্দ্রিয়-জয় হয়।