-ধ্রুবতারায় চিত্তসংযম করিলে তারাসমূহের গতিজ্ঞান হয়।
নাভিচক্রে কায়ব্যুহ-জ্ঞানম্ ।।৩০।।
-নাভিচক্রে চিত্তসংষম করিলে শরীরের গঠন জানা যায়।
কন্ঠকূপে ক্ষুৎপিপাসানিবৃত্তিঃ ।।৩১।।
-কন্ঠকূপে সংযম করিলে ক্ষুৎপিপাসা নিবৃত্তি হয়।
অতিশয় ক্ষুধিত ব্যক্তি যদি কন্ঠকূপে চিত্তসংযম করিতে পারেন, তবে তাঁহার ক্ষুধা ও পিপাসা নিবৃত্ত হয়।
কূর্মনাড্যাং স্থৈর্যম্ ।।৩২।।
-কূর্মনাড়ীতে চিত্তসংযম করিলে শরীরের স্থিরতা আসে।
যখন তিনি সাধনা করেন, তখন তাঁহার শরীর চঞ্চল হয় না।
মূর্ধজ্যোতিষি সিদ্ধদর্শনম্ ।।৩৩।।
-মস্তিষ্কের জ্যোতির উপর সংযম করিলে সিদ্ধপুরুষদিগের দর্শনলাভ হয়।
সিদ্ধগণ ভূতযোনি অপেক্ষা কিঞ্চিৎ উচ্চস্তরের। যোগী যখন তাঁহার মস্তকের
উপরিভাগে মনঃসংযম করেন, তখন তিনি এই সিদ্ধগণের দর্শন পান। এখানে ‘সিদ্ধ’ শব্দে মুক্তপুরুষ বুঝাইতেছে না, যদিও সচরাচর উহা ঐ অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে।
প্রাতিভাদ্বা সর্বম্ ।।৩৪।।
-অথবা প্রতিভা-শক্তিদ্বারা সমুদয় জ্ঞান লাভ হয়।
যাঁহাদের এইরূপ প্রতিভার শক্তি অর্থাৎ পবিত্রতার দ্বারা লব্ধ-জ্ঞান-বিশেষ আছে, (পূর্বোক্ত) কোন প্রকার সংযম ব্যতীতই তাঁহারা এই সমুদয় জ্ঞানের অধিকারী হন। যখন মানুষ উচ্চ প্রতিভা-শক্তি লাভ করেন, তখনই তিনি এই মহা আলোক প্রাপ্ত হন। তাঁহার নিকট সবই স্পষ্ট হইয়া যায়। কোন প্রকার ‘সংযম’ ব্যতীতই, সমুদয় জ্ঞান স্বতই তাঁহার মধ্যে প্রকাশিত হয়।
হৃদয়ে চিত্তসম্বিৎ ।।৩৫।।
-হৃদয়ে চিত্তসংযম করিলে মনোবিষয়ক জ্ঞানলাভ হয়।
সত্ত্বপুরুষয়োরত্যন্তাসংকীর্ণয়োঃ প্রত্যয়াবিশেষাদ্
ভোগঃ পরার্থত্বাদন্যস্বার্থসংযমমাৎ পুরুষজ্ঞানম্ ।।৩৬।।
-পুরুষ ও বুদ্ধির বিবেকের অভাবেই ভোগ হইয়া থাকে। সেই ভোগ পরার্থ অর্থাৎ অপরের বা পুরুষের জন্য। বুদ্ধির অন্য এক অবস্থায় নাম ‘স্বার্থ’; উহার উপর সংযম করিলে পুরুষের জ্ঞান হয়।
পুরুষ ও বুদ্ধি প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র; তাহা হইলেও পুরুষ বুদ্ধিতে প্রতিবিম্বিত হইয়া উহার সহিত আপনাকে অভেদভাবাপন্ন মনে করে এবং তাহাতেই নিজেকে সুখী বা দুঃখী বোধ করিয়া থাকে। বুদ্ধির এই অবস্থাকে ‘পরার্থ’ বলে, কারণ উহার সমুদয় ভোগ নিজের জন্য নয়-পুরুষের জন্য। এতদ্ব্যতীত বুদ্ধির আর এক অবস্থা আছে-উহার নাম ‘স্বার্থ’। যখণ বুদ্ধি সত্ত্বপ্রধান হইয়া অতিশয় নির্মল হয়, তখন তাহাতে পুরুষ বিশেষভাবে প্রতিবিম্বিত হন, এবং সেই বুদ্ধি অন্তর্মুখী হইয়া পুরুষমাত্রাবলম্বন হয়। সেই স্বার্থ-নামক বুদ্ধিতে সংযম করিলে পুরুষের জ্ঞান হয়। পুরুষমাত্রাবলম্বনবুদ্ধিতে সংযম করিতে বলার উদ্দেশ্য এই-শুদ্ধ পুরুষ জ্ঞাত বলিয়া কখন জ্ঞানের বিষয় হইতে পারেন না।
ততঃ প্রাতিভশ্রাবণবেদনাদর্শাস্বাদবার্তা জায়ন্তে ।।৩৭।।
-তাহা হইতে প্রাতিভ১ (অলৌকিক) শ্রবণ, স্পর্শ, দর্শন, স্বাদ ও ঘ্রাণ উৎপন্ন হয়।
১ প্রাতিভাৎ সূক্ষ্ম-ব্যবহিত-বিপ্রকৃষ্টাতীতানাগত জ্ঞানং, শ্রাবণাদ্ দিব্যশব্দশ্রবণং, বেদনাদ্ দিব্যস্পর্শাধিগমঃ, আদর্শাদ্ দিব্যরূপসম্বিৎ। আস্বাদাদ্ দিব্যরসসম্বিৎ, বার্তাতো দিব্যগন্ধবিজ্ঞানম্ ইত্যেতানি নিত্যং জায়ন্তে।-ব্যাসভাষ্য
তে সমাধাবুপসর্গা ব্যুত্থানে সিদ্ধয়ঃ ।।৩৮।।।
-ইহারা সমাধির পথে বাধা, কিন্তু সংসার-অবস্থায় উহারা সিদ্ধির স্বরূপ।
যোগী জানেন, সংসারে এই সমুদয় ভোগ পুরুষ ও মনের যোগ হইতে হইয়া থাকে, যদি তিনি ‘আত্মা ও প্রকৃতি পরস্পর পৃথক্ বস্তু’ এই সত্যের উপর চিত্তসংযম করিতে পারেন, তবে তিনি ‘পুরুষ’-এর জ্ঞান লাভ করেন। তাহা হইতে বিবেকজ্ঞান উদিত হয়। যখন তিনি এই ‘বিবেক’ লাভে কৃতকার্য হন, তখন তাঁহার প্রাতিভ বা দিব্যজ্ঞান লাভ হয়। কিন্তু এই শক্তিসমুদয় সেই উচ্চতম লক্ষ্যের পথে বাধা অর্থাৎ সেই পবিত্র আত্মার জ্ঞানের ও মুক্তির প্রতিবন্ধকস্বরূপ। পথিমধ্যে যেন এগুলির সহিত সাক্ষাৎ হয়। যোগী যদি এগুলি পরিত্যাগ করেন, তবেই তিনি সেই উচ্চতম জ্ঞানলাভ করিতে পারেন। যদি তিনি এই শক্তিগুলি লাভ করিতে প্রলুব্ধ হন, তবে তাঁহার অগ্রগতি ব্যাহত হয়।
বন্ধকারণশৈথিল্যাৎ প্রচারসংবেদনাচ্চ চিত্তস্য
পরশরীরাবেশঃ ।।৩৯।।
-যখন চিত্তের বন্ধনের কারণ শিথিল হইয়া যায় ও চিত্তের প্রচারস্থানগুলিকে (অর্থাৎ শরীরস্থ নাড়ীসমূহকে) অবগত হন, তখন তিনি অপরের শরীরে প্রবেশ করিতে পারেন।
যোগী অন্য এক দেহে অবস্থান করিয়া সেই দেহে ক্রিয়াশীল থকিলেও কোন মৃতদেহে প্রবেশ করিয়া উহাকে উঠাইয়া গতিশীল করিতে পারেন। অথবা তিনি কোন জীবিত শরীরে প্রবেশ করিয়া সেই দেহস্থ মন ও ইন্দ্রিয়গণকে রুদ্ধ করিয়া সাময়িকভাবে সেই শরীরের মধ্য দিয়া কার্য করিতে পারেন। প্রকৃতি ও পুরুষের বিবেকজ্ঞান লাভ করিলেই তাঁহার পক্ষে ইহা সম্ভব হইতে পারে। তিনি অপরের শরীরে প্রবেশ করিতে ইচ্ছা করিলে সেই শরীরে ‘সংযম’ প্রয়োগ করিলেই ইহা সিদ্ধ হইবে, কারণ তাঁহার আত্মাই যে সর্বব্যাপী তাহা নয়, তাঁহার মনও সর্বব্যাপী-অবশ্য যোগীদিগের মতে। উহা সেই সর্বব্যাপী মনের এক অংশমাত্র। এখন কিন্তু উহা কেবল এই শরীরের স্নায়ুমন্ডলীর ভিতর দিয়াই কার্য করিতে পারে, কিন্তু উহা কেবল এই শরীরের স্নায়ুমন্ডলীর ভিতর দিয়াই কার্য করিতে পারে, কিন্তু যোগী যখন স্নায়বীয় প্রবাহগুলি হইতে নিজেকে মুক্ত করিতে পারেন, তখন তিনি অন্যান্য বস্তু বা শরীরের দ্বারাও কার্য করিতে পারেন।