প্রযত্নশৈথিল্যানন্তসমাপত্তিভ্যাম্ ।।৪৭।।
-শরীরে যে এক প্রকার অভিমানাত্মক প্রযত্ন আছে, তাহা শিথিল করিয়া দিয়া ও অনন্তের চিন্তা দ্বারা আসন স্থির ও সুখকর হইতে পারে।
অনন্তের চিন্তা দ্বারা আসন অবিচলিত হইতে পারে। অবশ্য আমরা সেই নিরপেক্ষ অনন্ত (ব্রহ্ম) সম্বন্ধে (সহজে) চিন্তা করিতে পারি না, কিন্তু আমরা অনন্ত আকাশের বিষয় চিন্তা করিতে পারি।
ততো দ্বন্দ্বানভিঘাতঃ ।।৪৮।।
-এইরূপে আসন-জয় হইলে দ্বন্দ্ব-পরম্পরা আর কিছু বিঘ্ন উৎপাদন করিতে পারে না।
দ্বন্দ্ব অর্থে শুভ-অশুভ, শীত-উষ্ণ, আলোক-অন্ধকার, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি বিপরীতধর্মী দুই দুই পদার্থ। এগুলি আর তোমাকে চঞ্চল করিতে পারিবে না।
তস্মিন্ সতি শ্বাসপ্রশ্বাসয়োর্গতিবিচ্ছেদঃ প্রাণায়ামঃ ।।৪৯।।
-এই আসন-জয়ের পর শ্বাস ও প্রশ্বাস উভয়ের গতি সংযত করাকে ‘প্রাণায়াম’ বলে।
যখন এই আসন-জয় সমাপ্ত হইয়াছে, তখন শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি ভঙ্গ করিয়া দিয়া উহাকে নিয়ন্ত্রিত করিতে হইবে, এখান হইতে প্রাণায়ামের বিষয় আরম্ভ হইল। প্রাণায়াম কি? শরীরস্থিত জীবনীশক্তিকে বশে আনা। যদিও ‘প্রাণ’ শব্দ সচরাচর শ্বাসপ্রশ্বাস অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, কিন্তু বাস্তবিক উহা শ্বাসপ্রশ্বাস নয়। ‘প্রাণ’ অর্থে জাগতিক শক্তিসমষ্টি। উহা প্রত্যেক দেহে অবস্থিত শক্তি, এবং উহার বাহ্যপ্রকাশ-এই ফুসফুসের গতি। প্রাণ যখন শ্বাসকে ভিতর দিকে আকর্ষণ করে, তখনই এই গতি
আরম্ভ হয়; ‘প্রাণায়াম’-এ আমরা উহাকেই নিয়ন্ত্রিত করিতে চাই। এই প্রাণের উপর শক্তিলাভ করিবার সহজতম উপায়রূপে আমরা প্রথমে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রিত করিতে আরম্ভ করি।
বাহ্যাভ্যন্তরস্তম্ভবৃত্তিঃ দেশকালসংখ্যাভিঃ পরিদৃষ্টো দীর্ঘসূক্ষ্মঃ ।।৫০।।
-বাহ্যবৃত্তি, আভ্যন্তরবৃত্তি ও স্তম্ভবৃত্তি ভেদে এই প্রাণায়াম ত্রিবিধ; দেশ, কাল, সংখ্যার দ্বারা নিয়মিত এবং দীর্ঘ বা সূক্ষ্ম হওয়াতে উহাদেরও আবার নানাপ্রকার ভেদ আছে।
এই প্রাণায়াম তিন প্রকার ক্রিয়ায় বিভক্ত। প্রথম-যখন আমরা শ্বাসকে অভ্যন্তরে আকর্ষণ করি; দ্বিতীয়-যখন আমরা উহা বাহিরে নিক্ষেপ করি; তৃতীয়-যখন শ্বাস ফুসফুসের মধ্যেই ধৃত হয় বা বাহির হইতে শ্বাসগ্রহণ বন্ধ রাখা হয়। উহারা আবার দেশ, কাল ও সংখ্যা অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন আকার ধারণ করে। ‘দেশ’ অর্থে-প্রাণকে শরীরের কোন অংশবিশেষে আবদ্ধ রাখা। ‘সময়’ অর্থে-প্রাণ কোন্ স্থানে কতক্ষণ রাখিতে হইবে, এবং ‘সংখ্যা’ অর্থে-কতবার ঐরূপ করিতে হইবে, তাহা বুঝিতে হইবে। এইজন্য কোথায়, কতক্ষণ ও কতবার রেচকাদি করিতে হইবে, ইত্যাদি কথিত হইয়া থাকে। এই প্রাণায়ামের ফল ‘উদ্ঘাত’ অর্থাৎ কুন্ডলিনীর জাগরণ।
বাহ্যাভ্যন্তরবিষয়াক্ষেপী চতুর্থঃ ।।৫১।।
-চতুর্থ প্রকার প্রাণায়ামে বাহ্য বা আন্তর বিষয় চিন্তা দ্বারা প্রাণ নিরূদ্ধ করা হয়।
ইহা চতুর্থ প্রকার প্রাণায়াম। ইহাতে পূর্বোক্ত চিন্তাসহ দীর্ঘকাল অভ্যাসের দ্বারা স্বাভাবিক কুম্ভক (স্তম্ভবৃত্তি) হইয়া থাকে। অন্য প্রাণায়ামগুলিতে চিন্তার সংস্রব নাই।
ততঃ ক্ষীয়তে প্রকাশাবরণম্ ।।৫২।।
-তাহা হইতেই চিত্তের প্রকাশের আবরণ ক্ষয় হইয়া যায়।
চিত্তে স্বভাবতই সমুদয় জ্ঞান রহিয়াছে, উহা সত্ত্বপদার্থ দ্বারা নির্মিত, কিন্তু উহা রজঃ ও তমোদ্বারা আবৃত্ত রহিয়াছে। প্রাণায়াম দ্বারা চিত্তের এই আবরণ দূরীভূত হয়।
ধারণাসু চ যোগ্যতা মনসঃ ।।৫৩।।
-(তাহা হইতেই) ‘ধারণা’ বিষয়ে মনের যোগ্যতা হয়।
এই আবরণ চলিয়া গেলে আমরা মনকে একাগ্র করিতে সমর্থ হই।
স্বস্ববিষয়াসম্প্রয়োগে চিত্ত-স্বরূপানুকার ইবেন্দ্রিয়াণাং প্রত্যাহারঃ ।।৫৪।।
-যখন ইন্দ্রিয়গণ তাহাদের নিজ নিজ বিষয় পরিত্যাগ করিয়া যেন চিত্তের স্বরূপ গ্রহণ করে, তখন তাহাকে ‘প্রত্যাহার’ বলা যায়।
এই ইন্দ্রিয়গুলি মনেরই বিভিন্ন অবস্থা মাত্র। মনে কর, আমি একখানি পুস্তক দেখিতেছি। বাস্তবিক ঐ পুস্তকাকৃতি বাহিরে নাই, উহা মনেই অবস্থিত বাহিরের কোন কিছু ঐ আকৃতি জাগাইয়া দেয় মাত্র; বাস্তবিক রূপ বা আকৃতি চিত্তেই আছে। এই ইন্দ্রিয়গুলি, তাহাদের সন্মুখে যাহা আসিতেছে, তাহারই সহিত মিশিয়া গিয়া তাহারই আকার গ্রহণ করিতেছে। যদি তুমি মনের এই-সকল ভিন্ন ভিন্ন আকৃতি-ধারণ নিবারণ করিতে পারো, তবে তোমার মন শান্ত হইবে এবং ইন্দ্রিয়গুলিও শান্ত হইবে। ইহাকেই ‘প্রত্যাহার’ বলে।
ততঃ পরমা বশ্যতেন্দ্রিয়াণাম্ ।।৫৫।।
-তাহা (প্রত্যাহার) হইতেই ইন্দ্রিয়গণ সম্পূর্ণরূপে বশীভূত হইয়া থাকে।
যখন যোগী ইন্দ্রিয়গণের এইরূপ বহির্বস্তুর আকৃতি-ধারণ নিবারণ করিতে পারেন ও মনের সহিত উহাদিগকে এক করিয়া ধারণ করিতে কৃতকার্য হন, তখনই ইন্দ্রিয়গণ সম্পূর্ণরূপে জিত হইয়া থাকে। আর যখন ইন্দ্রিয়গণ সর্বতোভাবে বশীভূত হয়, তখনই প্রত্যেকটি স্নায়ু ও মাংসপেশী বশে আসিয়া থাকে, কারণ ইন্দ্রিয়গণই সর্বপ্রকার অনুভূতি ও কার্যের কেন্দ্রস্বরূপ। এই ইন্দ্রিয়গণ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয়-এই দুই ভাগে বিভক্ত। সুতরাং যখন ইন্দ্রিয়গণ সংযত হইবে, তখন যোগী সর্বপ্রকার ভাব ও কার্যকে জয় করিতে পারিবেন; সমগ্র শরীরটিই তাঁহার বশীভূত হইবে। এইরূপ অবস্থা লাভ হইলেই মানুষ দেহধারণের আনন্দ অনুভব করে। তখনই সে ঠিক ঠিক বলিতে পারে, ‘জন্মিয়াছিলাম বলিয়া আমি সুখী।’ যখন ইন্দ্রিয়গণের উপর এইরূপ শক্তিলাভ হয়, তখনই বুঝিতে পারা যায, বাস্তবিক এই শরীর অতি আশ্চর্য পদার্থ।
০৩. বিভূতি-পাদ (তৃতীয় অধ্যায়)
এই অধ্যায়ে যোগের বিভূতি (শক্তি বা ঐশ্বর্য) আলোচিত হইবে।