যখন কেহ অপরের নিকট হইতে কোন বস্তু গ্রহণ করেন না, তখন তাঁহার অপরের সহিত বাধ্যবাধকতা হয় না, তিনি স্বাধীন ও মুক্তিই থাকেন। তাঁহার মন শুদ্ধ হইয়া যায়। প্রতিটি দানের সহিত দাতার মন্দ ভাবগুলিও গ্রহণ করিতে হইতে পারে। এই পরিগ্রহ ত্যাগ করিলে মন শুদ্ধ হইয়া যায়, আর ইহা হইতে যে-সকল শক্তি লাভ হয়, তন্মধ্যে প্রথম-পূর্বজন্মকথা মনে করিতে পারা। তখনই সেই যোগী সম্পূর্ণরূপে তাঁহার নিজ আদর্শে দৃঢ় হইয়া থাকিতে পারেন। কারণ তিনি দেখিতে পান, বহুবার তিনি কেবল যাওয়া-আসা করিতেছেন। সুতরাং তিনি তখন হইতে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞারূঢ় হন যে, এইবার আমি মুক্ত হইব, আর যাওযা-আসা করিব না, আর প্রকৃতির দাস হইব না।
শৌচাৎ স্বাঙ্গজুগুপ্সা পরৈরসংসর্গঃ ।।৪০।।
-শৌচ প্রতিষ্ঠিত হইলে নিজের শরীরের প্রতি ঘৃণার উদ্রেক হয়, অন্যের সঙ্গ করিতেও আর প্রবৃত্তি থাকে না।
যখন বাস্তবিক বাহ্য ও আন্তর-উভয় প্রকার শৌচ সিদ্ধ হয়, তখন শরীরের প্রতি অযত্ন আসে; কিসে উহা ভাল থাকিবে, কিসেই বা উহা সুন্দর দেখাইবে, এ-সকল ভাব একেবারে চলিয়া যায়। অপরে যে মুখ অতি সুন্দর বলিবে, তাহাতে জ্ঞানের কোন চিহ্ন না থাকিলে যোগীর নিকট তাহা পশুর মুখ বলিয়া প্রতীয়মান হইবে। জগতের লোক যে মুখে কোন বিশেষত্ব দেখে না, তাহার পশ্চাতে চৈতন্যের প্রকাশ থাকিলে তিনি তাহাকে স্বর্গীয় মনে করিবেন। এই দেহতৃষ্ণা মানুষ্যজীবনে সর্বনাশের কারণ। সুতরাং শৌচ-প্রতিষ্ঠার প্রথম লক্ষণ এই যে, তুমি নিজে একটি শরীর বলিয়া ভাবিতে চাহিবে না। আমাদের মধ্যে যখন এই শৌচ বা পবিত্রতা আসে, তখনই আমরা এই দেহভাব অতিক্রম করিতে পারি।
সত্ত্বশুদ্ধি-সৌমনস্যৈকাগ্র্যেন্দ্রিয়জয়াত্মদর্শনযোগ্যত্বানি চ ।।৪১।।
-এই শৌচ হইতে সত্ত্ব-শুদ্ধি, সৌমনস্য অর্থাৎ মনের প্রফুল্ল ভাব, একাগ্রতা, ইন্দ্রিয় জয় ও আত্মদর্শনের যোগ্যতা লাভ হইয়া থাকে।
এই শৌচ-অভ্যাসের দ্বারা সত্ত্বগুণ বর্ধিত হইবে, সুতরাং মনও একাগ্র ও প্রফুল্ল হইবে। তুমি যে ধর্মপথে অগ্রসর হইতেছ, তাহার প্রথম লক্ষণ এই যে, তুমি বেশ
প্রফুল্ল হইতেছ। বিষাদপূর্ণ ভাব অবশ্য আজীর্ণ রোগের ফল হইতে পারে, কিন্তু তাহা ধর্ম নয়। সুখই সত্ত্বের স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম; সাত্ত্বিক ব্যক্তির পক্ষে সবই সুখময় বলিয়া বোধ হয়; সুতরাং যখন তোমার এই আনন্দের ভাব আসিতে থাকিবে, তখন তুমি বুঝিবে, তুমি যোগসাধনায় উন্নতি করিতেছ। যাবতীয় দুঃখযন্ত্রণা তমোগুণপ্রসূত, সুতরাং উহা হইতে অব্যাহতি লাভ করিতে হইবে। বিষণ্ণতা তমোগুণের একটি লক্ষণ। সবল, দৃঢ়, সুস্থকায়, যুবা ও সাহসী ব্যক্তিরাই যোগী হইবার উপযুক্ত। যোগীর দৃষ্টিতে সবই সুখময়। যে-কোন মনুষ্যমুখ তিনি দেখেন, তাহাতেই তাহার আনন্দ হয়। ইহাই ধার্মিক লোকের লক্ষণ। পাপই কষ্টের কারণ, আর অন্য কিছু নয়। বিষাদমেঘাচ্ছন্ন মুখ লইয়া কি হইবে? উহা ভয়ঙ্কর! এইরূপ মেঘাচ্ছন্ন মুখ লইয়া বাহিরে যাইও না, কখন এইরূপ হইলে দ্বার অর্গলবদ্ধ করিয়া সারাদিন ঘরে কাটাইয়া দাও। সমাজে, সংসারে এই ব্যাধি সংক্রামিত করিবার তোমার কি অধিকার আছে? যখন তোমার মন সংযত হইবে, তখন তুমি সমুদয় শরীরও বশে রাখিতে পারিবে। তখন আর তুমি এই যন্ত্রের ক্রীতদাস থাকিবে না; এই দেহযন্ত্রই তোমার ভৃত্য হইয়া থাকিবে। দেহযন্ত্র আত্মাকে নিম্নদিকে আকর্ষণ করিয়া লইয়া যাইবে না, বরং উহাই মুক্তিপথে শ্রেষ্ঠ সহায় হইবে।
সন্তোষাদনুত্তমঃ সুখলাভঃ ।।৪২।।
-সন্তোষ হইতে পরম সুখলাভ হয়।
কায়েন্দ্রিয়সিদ্ধিরশুদ্ধিক্ষয়াত্তপসঃ ।।৪৩।।
-অশুদ্ধি-ক্ষয়-নিবন্ধন তপস্যা হইতে দেহ ও ইন্দ্রিয়ের নানাপ্রকার শক্তি আসে।
তপস্যার ফল কখন কখন সহসা দূরদর্শন, দূরশ্রবণ ইত্যাদি রূপে প্রকাশ পায়।
স্বাধ্যায়াদিষ্টদেবতাসম্প্রয়োগঃ ।।৪৪।।
-মন্ত্রাদির পুনঃপুনঃ উচ্চারণ বা অভ্যাস দ্বারা ইষ্টদেবতার দর্শনলাভ হইয়া থাকে।
যে পরিমাণে উচ্চ প্রাণী (দেবতা, ঋষি, সিদ্ধ) দেখিবার ইচ্ছা করিবে, সাধনাও সেই পরিমাণে কঠোর করিতে হইবে।
সমাধিসিদ্ধিরীশ্বরপ্রণিধানাৎ ।।৪৫।।
-ঈশ্বরে সমুদয় অর্পণ করিলে সমাধিলাভ হইয়া থাকে।
ঈশ্বরে নির্ভরের দ্বারা সমাধি ঠিক পূর্ণা হয়।
স্থিরসুখামাসনম্ ।।৪৬।।
-যেভাবে অনেকক্ষণ স্থিরভাবে সুখে বসিয়া থাকা যায়, তাহার নাম আসন।
এখন আসনের কথা বলা হইবে। যতক্ষণ তুমি স্থিরভাবে অনেকক্ষণ বসিয়া
থাকিতে না পারিতেছ, ততক্ষণ তুমি প্রাণায়াম ও অন্যান্য সাধনে কিছুতেই কৃতকার্য হইবে না। আসন দৃঢ় হওয়ার অর্থ এই যে, তুমি শরীরের অস্তিত্ব মোটেই অনুভব করিবে না। এইরূপ হইলে বাস্তবিক আসন দৃঢ় হইয়াছে, বলা যায়। কিন্তু সাধারণভাবে তুমি যদি কিয়ৎক্ষণের জন্য বসিতে চেষ্টা কর, শরীরে নানাপ্রকার বাধাবিঘ্ন আসিতে থাকিবে, কিন্তু যখনই তুমি এই স্থূলদেহভাব অতিক্রম করিবে, তখন শরীরবোধ হারাইয়া ফেলিবে। তখন আর তুমি সুখ বা দুঃখ কিছুই অনুভব করিবে না। আবার যখন তোমার শরীরে জ্ঞান ফিরিয়া আসিবে, তখন অনুভব করিবে, যেন অনেকক্ষণ বিশ্রাম করিয়াছ। যদি শরীরকে পূর্ণ বিশ্রাম দেওয়া সম্ভব হয়, তবে উহা এইরূপেই হইতে পারে। যখন তুমি এইরূপে শরীরকে জয় করিয়া উহাকে দৃঢ় রাখিতে পারিবে, তখন তোমার সাধনাও দৃঢ় হইবে। কিন্তু যতক্ষণ তোমার শারীরিক বিঘ্নবাধাগুলি আসিতে থাকিবে, ততক্ষণ তোমার স্নায়ুমন্ডলী চঞ্চল থাকিবে এবং তুমি কোনরূপে মনকে একাগ্র করিয়া রাখিতে পারিবে না।