এতে জাতি-দেশ-কাল-সময়ানবচ্ছিন্নাঃ সার্বভৌমা মহাব্রতম্ ।।৩১।।
-এইগুলি জাতি, দেশ, কাল ও সময় (অর্থাৎ সাময়িক কর্তব্য বা উদ্দেশ্য) দ্বারা
১ ‘যম’-এর প্রথম তিনটি সাধনের জন্য ‘সংক্ষেপে রাজযোগ’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
অবচ্ছিন্ন বা সীমাবদ্ধ না হইলে সার্বভৌম (অর্থাৎ সর্বজনীন) মহাব্রত বলিয়া কথিত হয়।
এই সাধনগুলি অর্থাৎ অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ প্রত্যেক পুরুষ, স্ত্রী ও বালকের পক্ষে জাতি, দেশ অথবা অবস্থা-নির্বিশেষে অনুষ্ঠেয়।
শৌচ-সন্তোষ-তপঃ-স্বাধ্যায়েশ্বরপ্রণিধানানি নিয়মাঃ ।।৩২।।
-বাহ্য ও অন্তঃশৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায় (মন্ত্রজপ বা অধ্যাত্ম-শাস্ত্রপাঠ) ও ঈশ্বরোপাসনা এইগুলি ‘নিয়ম’।
বাহ্যশৌচ অর্থে শরীরকে পবিত্র রাখা; অশুচি ব্যক্তি কখনও যোগী হইতে পারে না। সঙ্গে সঙ্গে অন্তঃশৌচও আবশ্যক। পূর্বে সমাধিপাদ, ৩৩শ সূত্রে যে ধর্মগুলির কথা বলা হইয়াছে, তাহা হইতেই এই অন্তঃশৌচ আসে। অবশ্য বাহ্যশৌচ অপেক্ষা অন্তঃশৌচ অধিকতর প্রয়োজন, কিন্তু উভয়টিরই প্রয়োজনীয়তা আছে; আর অন্তঃশৌচ ব্যতীত কেবল বাহ্যশৌচ কোন কাজে আসে না।
বিতর্কবাধনে প্রতিপক্ষভাবনম্ ।।৩৩।।
-যোগের প্রতিবন্ধক ভাবসমূহ উপস্থিত হইলে ঐগুলির বিপরীত চিন্তা করিতে হইবে।
পূর্বে যে-সকল ধর্মের কথা বলা হইল সেগুলি অভ্যাস করিবার উপায়-মনে বিপরীত প্রকারে চিন্তাস্রোত প্রবাহিত করা; অন্তরে চৌর্যের ভাব আসিলে অচৌর্যের চিন্তা করিতে হইবে। দান গ্রহণ করিবার ইচ্ছা হইলে উহার বিপরীত চিন্তা করিতে হইবে।
বিতর্কা হিংসাদয়ঃ কৃতকারিতানুমোদিতা লোভক্রোধমোহপূর্বকা মৃদুমধ্যাধিমাত্রা
দুঃখাজ্ঞানানন্তফলা ইতি প্রতিপক্ষভাবনম্ ।।৩৪।।
-পূর্বসূত্রে যে প্রতিপক্ষ-ভাবনার কথা বলা হইয়াছে, তাহার প্রণালী এইরূপঃ বিতর্ক অর্থাৎ যোগের প্রতিবন্ধক হিংসাদি-কৃত, কারিত অথবা অনুমোদিত; উহাদের কারণ লোভ, ক্রোধ বা মোহ অর্থাৎ অজ্ঞান, তাহা অল্পই হউক আর মধ্যম পরিমাণই হউক, অথবা অধিক পরিমানই হউক; উহাদের ফল অনন্ত অজ্ঞান ও ক্লেশ; এইরূপ ভাবনাকেই প্রতিপক্ষ-ভাবনা বলে।
আমি নিজে মিথ্যা কথা বলিলে যে পাপ হয়, যদি আমি অপরকে মিথ্যা কথা বলিতে প্রবৃত্ত করি, অথবা অপরে মিথ্যা বলিলে তাহা অনুমোদন করি, তাহাতেও তুল্য পরিমাণ পাপ হয়। মিথ্যা সামান্য হইলেও উহা মিথ্যা। পর্বতগুহায় বসিয়াও যদি তুমি পাপ চিন্তা করিয়া থাকো, যদি কাহারও প্রতি অন্তরে ঘৃণা প্রকাশ করিয়া থাকো, তাহা
হইলে তাহাও সঞ্চিত থাকিবে, কালে আবার তাহা তোমার উপর প্রতিঘাত করিবে, একদিন না একদিন কোন না কোন প্রকার দুঃখের আকারে উহা প্রবলবেগে তোমাকে আক্রমণ করিবে। তুমি যদি ঈর্ষা ও ঘৃণার ভাব পোষণ কর এবং ঐ ভাব চতুর্দিকে প্রেরণ কর, তবে বর্ধিতভাবে উহা তোমার নিকট ফিরিয়া আসিবে। জগতের কোন শক্তিই উহা নিবারণ করিতে পারিবে না। তুমি যখন একবার ঐ শক্তি প্রেরণ করিয়াছ, তখন অবশ্য তোমাকে উহার প্রতিঘাত সহ্য করিতে হইবে। এইটি স্মরণ করিলে তুমি অসৎকার্য হইতে নিবৃত্ত হইবে।
অহিংসাপ্রতিষ্ঠায়াং তৎসন্নিধৌ বৈরত্যাগঃ ।।৩৫।।
-যাহার অন্তরে অহিংসা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে তাহার সমীপে অপরের স্বাভাবিক বৈরিতাও পরিত্যক্ত হয়।
যদি কোন ব্যক্তি অহিংসার আদর্শ পূর্ণভাবে উপলব্ধি করেন, তবে তাহার সন্মুখে যে-সকল প্রাণী স্বভাবতই হিংস্র, তাহারাও শান্তভাব ধারণ করে। সেই যোগীর সন্মুখে ব্যাঘ্র ও মেষ-শাবক একত্র ক্রীড়া করিবে, পরস্পরকে হিংসা করিবে না। এই অবস্থা লাভ হইলে তবে বুঝিতে পারিবে যে, তুমি অহিংসভাবে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হইয়াছ।
সত্যপ্রতিষ্ঠায়াং ক্রিয়াফলাশ্রয়ত্বম্ ।।৩৬।।
-হৃদয়ে সত্য প্রতিষ্ঠিত হইলে কোন কর্ম না করিয়াই যোগী নিজের জন্য বা অপরের জন্য সেই কর্মের ফল লাভ করিবার শক্তি অর্জন করেন।
যখন এই সত্যের শক্তি তোমার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হইবে, যখন স্বপ্নেও তুমি মিথ্যা কথা কহিবে না, যখন কায়মনোবাক্যে সত্য আচরণ করিবে, তখন তুমি যাহা বলিবে, তাহাই সত্য হইয়া যাইবে। তখন তুমি যদি কাহাকেও বলো, ‘তুমি কৃতার্থ হও’, সে তৎক্ষণাৎ কৃতার্থ হইয়া যাইবে। কোন পীড়িত ব্যক্তিকে যদি বলো, ‘রোগমুক্ত হও’, সে তৎক্ষণাৎ রোগমুক্ত হইয়া যাইবে।
অস্তেয়প্রতিষ্ঠায়াং সর্বরত্নোপস্থানম্ ।।৩৭।।
-অচৌর্য প্রতিষ্ঠিত হইলে যোগীর নিকট সমুদয় ধনরত্নাদি আসিয়া থাকে।
তুমি যতই প্রকৃতি হইতে পলায়নের চেষ্টা করিবে, প্রকৃতি ততই তোমার অনুসরণ করিবে; আর তুমি যদি সেই প্রকৃতির প্রতি কিছুমাত্র লক্ষ্য না কর, তবে সে তোমার দাসী হইয়া থাকিবে।
ব্রহ্মচর্যপ্রতিষ্ঠায়াং বীর্যলাভঃ ।।৩৮।।
-ব্রহ্মচর্য প্রতিষ্ঠিত হইলে বীর্য বা শক্তি লাভ হয়।
ব্রহ্মচর্যবান্ ব্যক্তির মস্তিষ্কে প্রবল শক্তি-মহতী ইচ্ছাশক্তি সঞ্চিত থাকে। পবিত্রতা
ব্যতীত আধ্যাত্মিক শক্তি সম্ভন নয়। ব্রহ্মচর্য দ্বারা মানুষের উপর আশ্চর্য ক্ষমতা লাভ করা যায়। মানবসমাজের ধর্ম-নেতাগণ সকলেই ব্রহ্মচর্যবান্ ছিলেন, এই ব্রহ্মচর্য হইতেই তাঁহারা শক্তি লাভ করিয়াছিলেন; অতএব যোগী অবশ্যই ব্রক্ষচর্যবান্ হইবেন।
অপরিগ্রহস্থৈর্যে জন্মকথন্তাসংবোধঃ ।।৩৯।।
-অপরিগ্রহ দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হইলে পূর্বজন্ম স্মৃতিপথে উদিত হইবে।