সাধন পাদ
বিবেকখ্যাতিরবিপ্লবা হানোপয়ঃ ।।২৬।।
-নিরন্তর এই বিবেকের অভ্যাসই অজ্ঞান-নাশের উপায়।
সমুদয় সাধনের প্রকৃত লক্ষ্য এই সদসদ্বিবেক-একটি বিশেষরূপে জানা যে, পুরুষ প্রকৃতি হইতে স্বতন্ত্র, পুরুষ জড়ও নন, মনও নন; আর উনি প্রকৃতি নন বলিয়া উঁহার কোনরূপ পরিবর্তনও সম্ভব নয়। কেবল প্রকৃতিই সর্বদা পরিণত হইতেছে, সর্বদাই উহার সংশ্লেষ, বিশ্লেষ ও পুনঃসংশ্লেষ ঘটিতেছে। যখন নিরন্তর অভ্যাসের দ্বারা আমরা এই বিবেকজ্ঞান লাভ করিব, তখনই অজ্ঞান চলিয়া যাইবে। তখনই পুরুষ স্ব-স্বরূপে অর্থাৎ সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান্ ও সর্বব্যাপিরূপে প্রতিভাত হইবেন।
তস্য সপ্তধা প্রান্তভূমিঃ প্রজ্ঞা ।।২৭।।
-তাঁহার (জ্ঞানীর) বিবেকজ্ঞানের সাতটি উচ্চতম স্তর আছে।
যখন এই জ্ঞান লাভ হইতে থাকে, তখন যেন উহা একটির পর আর একটি করিয়া সপ্তস্তরে আসিতে থাকে। যখন উহাদের মধ্যে একটি অবস্থা আরম্ভ হয়, আমরা তখন বুঝিতে পারি যে, আমরা জ্ঞানলাভ করিতেছি। প্রথমে এইরূপ অবস্থা আসিবে, মনে হইবে-‘যাহা জানিবার তাহা জানিয়াছি’; মনে তখন আর কোনরূপ অসন্তোষ থাকিবে না। যতক্ষণ আমাদের জ্ঞানপিপাসা থাকে, ততক্ষণ আমরা ইতস্ততঃ জ্ঞানের অনুসন্ধান করি। যেখানেই কিছু সত্য পাইব বলিয়া মনে হয়, অমনি সেদিকে ধাবিত হই। সেখানে উহা না পাইলে মনে অশান্তি আসে, আবার অন্য একদিকে সন্ধান করি। যতদিন না অনুভব করিতে পারি যে, সমুদয় জ্ঞান আমাদের ভিতরেই রহিয়াছে, যতদিন না বোধ করি, কেহই আমাদিগকে সত্যলাভে সাহায্য করিতে পারে না, আমাদের নিজেদের নিজেকে সাহায্য করিতে হইবে, ততদিন সমুদয় সত্যান্বেষণই বৃথা। বিবেক অভ্যাস করিতে আরম্ভ করিলে আমরা যে সত্যের নিকটবর্তী হইতেছি, তাহার প্রথম এই লক্ষণ প্রকাশ পাইবে যে, ঐ অসন্তোষের ভাব চলিয়া যাইবে। আমাদের নিশ্চিত ধারণা হইবে, আমরা সত্য পাইয়াছি এবং ইহা সত্য ব্যতীত আর কিছুই হইতে পারে না। তখন আমরা জানিতে পারিব যে, সত্যস্বরূপ সূর্য উদিত হইতেছেন, আমাদের অজ্ঞান-রজনী প্রভাত হইতেছে। তখন সাহসে বুক বাঁধিয়া অধ্যবসায় অবলম্বন করিতে হইবে-যতদিন না সেই পরমপদ লাভ হয়। দ্বিতীয় অবস্থায় সমস্ত দুঃখ চলিয়া যাইবে। বাহ্য বা আভ্যন্তর কোন বিষয়ই তখন আমাদিগকে দুঃখ দিতে পারিবে না। তৃতীয় অবস্থায় আমরা পূর্ণ জ্ঞানলাভ করিব, অর্থাৎ সর্বজ্ঞ হইব। চতুর্থ অবস্থায় বিবেকসহায়ে সমুদয় কর্তব্যের অবসান হইবে। তারপর ‘চিত্তবিমুক্তি’ অবস্থা আসিবে। আমরা বুঝিতে পারিব, আমাদের বিঘ্নবিপত্তি সব চলিয়া গিয়াছে। যেমন কোন পর্বতের চূড়া হইতে একটি প্রস্তরখন্ড নিম্নে উপত্যকায় পতিত হইলে আর কখন উপরে উঠিতে পারে না, সেইরূপ মনের সংগ্রাম ও চঞ্চলতা সব নীচে পড়িয়া যাইবে, আর মনে উঠিবে না। পরবর্তী অবস্থায়-চিত্ত বুঝিতে পারিবে, ইচ্ছামাত্রেই উহা স্বকারণে লীন হইয়া যাইতেছে। অবশেষে দেখিতে পাইব, আমরা স্ব-স্বরূপে অবস্থিত আছি; দেখিব, এতদিন জগতে একাকী আত্মারূপে কেবল আমরাই ছিলাম। মন বা শরীরের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নাই। উহারা তো আমাদিগের সহিত কখনই যুক্ত ছিল না। উহারা আপন আপন কাজ করিতেছিল, আমরা অজ্ঞানবশতঃ নিজদিগকে উহাদের সহিত যুক্ত করিয়াছিলাম। কিন্তু আমরা একাকী, নিঃসঙ্গ, কেবল, সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপী ও সদানন্দ। আমাদের আত্মা এত পবিত্র ও পূর্ণ যে, আমাদের আর কিছুরই আবশ্যক ছিল না। আমাদিগকে সুখী করিবার জন্য আর কাহাকেও প্রয়োজন ছিল না, কারণ আমরাই সুখস্বরূপ। আমরা দেখিতে পাইব, এই জ্ঞান অন্য কিছুর উপর নির্ভর করে
না। জগতে এমন কিছুই নাই, যাহা আমাদের জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত না হইবে। ইহাই যোগীর চরম অবস্থা; যোগী তখন ধীর ও শান্ত হইয়া যান, আর কোন প্রকার কষ্ট অনুভব করেন না, আর কখনও অজ্ঞান-মোহে ভ্রান্ত হন না এবং দুঃখ আর তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারে না। তিনি জানিতে পারেন, ‘আমি নিত্যানন্দস্বরূপ, নিত্যপূর্ণস্বরূপ ও সর্বশক্তিমান্।’
যোগাঙ্গানুষ্ঠানাদশুদ্ধিক্ষয়ে জ্ঞানদীপ্তিরাবিবেকখ্যাতেঃ ।।২৮।।
-যোগের বিভিন্ন অঙ্গগুলি অনুষ্ঠান করিতে করিতে মনের মলিনতা দূর হইয়া গেলে জ্ঞান উদ্ভাসিত হইয়া উঠে; উহার শেষ সীমা বিবেক-খ্যাতি।
এখন সাধনের কথা বলা হইতেছে। এতক্ষণ যাহা বলা হইতেছিল, তাহা অনেক উচ্চতর ব্যাপার। উহা অনেক দূরে, অনেক ঊর্দ্ধ্বে, কিন্তু উহাই আমাদের আদর্শ। প্রথমতঃ শরীর ও মন সংযত করা আবশ্যক। তখনই পূর্বোক্ত আদর্শের উপলব্ধি স্থায়ী হইতে পারে। আদর্শ কি, তাহা আমরা জানিয়াছি; এখন উহা লাভের জন্য সাধন করিতে হইবে।
যম-নিয়মাসন-প্রাণায়াম-প্রত্যাহার-ধারণা-ধ্যান-সমাধয়োহষ্টাবঙ্গানি ।।২৯।।
-যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান, সমাধি-এই আটটি যোগের অঙ্গস্বরূপ।
অহিংসা-সত্যাস্তেয়-ব্রহ্মচর্যাপরিগ্রহা যমাঃ ।।৩০।।
-অহিংসা, সত্য, অস্তেয় (অচৌর্য), ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ-এইগুলিকে ‘যম’ বলে।
পূর্ণ যোগী হইতে গেলে সাধককে স্ত্রী-পুরুষ-লিঙ্গভিমান ত্যাগ করিতে হইবে। আত্মার কোন লিঙ্গ নাই; তবে লিঙ্গভিমান দ্বারা নিজেকে অবনমিত করিবে কেন? পরে আমরা আরও স্পষ্ট বুঝিতে পারিব, কেন এই-সকল ভাব একেবারে পরিত্যাগ করিতে হইবে। চৌর্য যেমন অসৎকার্য, পরিগ্রহ অর্থাৎ অপরের নিকট হইতে কিছু গ্রহণ করাও সেইরূপ অসৎ কর্ম। যিনি অপরের নিকট হইতে কিছু গ্রহণ করেন, তাঁহার মন দাতার মন দ্বারা প্রভাবিত হয়, সুতরাং যিনি দান গ্রহণ করেন, তাঁহার পতিত হইবার সম্ভাবনা। অপরের নিকট হইতে দান গ্রহণ করিলে মনের স্বাধীনতা নষ্ট হইতে পারে, আমরা ক্রীতদাসতুল্য হইয়া পড়িতে পারি। অতএব কোন দান গ্রহণ করিও না।১