স্বামী বিবেকানন্দ একটি বিশেষ সভায় প্রাচ্যদেশের নারীদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আলোচনা করেন : কোন জাতির প্রগতির শ্রেষ্ঠ মাপকাঠি নারীদের প্রতি তাহার মনোভাব। প্রাচীন গ্রীসে স্ত্রী-পুরুষের মর্যাদায় কোন পার্থক্য ছিল না; পূর্ণ সমতার ভাব বিরাজিত ছিল। কোন হিন্দুও বিবাহিত না হইলে পুরোহিত হইতে পারে না; ভাবটা এই যে, অবিবাহিত ব্যক্তি অর্ধাঙ্গ ও অসম্পূর্ণ। পূর্ণ স্বাতস্ত্র্যই পূর্ণ নারীত্ব। আধুনিক হিন্দুনারীর জীবনের প্রধান ভাব তাহার সতীত্ব। পত্মী যেন বৃত্তের কেন্দ্র-ঐ কেন্দ্রর স্থিরত্ব নির্ভর করে তাহার সতীত্বের উপর। এই আদর্শের চরম অবস্থায় হিন্দু বিধবারা সহমরণে দগ্ধ হইতেন। সম্ভবতঃ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নারীদের অপেক্ষা হিন্দুনারীগণ বেশী ধর্মশীলা ও আধ্যাত্মিকভাবসম্পন্না। যদি আমরা চরিত্রের ঐ সকল সদ্গুণ রক্ষা করিতে পারি এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নারীদের বুদ্ধিবৃত্তির পুষ্টিসাধন করিতে পারি, তাহা হইলে ভবিষ্যৎ হিন্দুনারী জগতের আদর্শস্থানীয়া হইবেন।
১০. ধর্মীয় ঐর্কের মহাসন্মেলন
[২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩, ‘Chicago Sunday Herald’ পত্রিকার প্রকাশিত স্বামীজীর বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত বিবরণী।]
এই ধর্মমহাসভায় প্রদত্ত বক্তৃতাগুলির সাধারণ সিদ্ধান্ত এই যে, মানুষের ভ্রাতৃত্বই বহু-আকাঙ্খিত উদ্দেশ্য। এই ভ্রাতৃত্ব একটি স্বাভাবিক অবস্থা, কারণ আমরা সকলে একই ঈশ্বরের সন্তান-এ সম্বন্ধে অনেক কথা বলা হইয়াছে। আবার এমন অনেক সম্প্রদায় আছে, যাহার ঈশ্বরের অস্তিত্ব অর্থাৎ ব্যক্তিভাবাপন্ন ঈশ্বর স্বীকার করে না। যদি আমরা এই-সকল সম্প্রদায়কে উপেক্ষা করিয়া বাহিরে রাখিতে চাই, তাহা হইলে অবশ্য আমাদের ভ্রাতৃত্ব সর্বজনীন হইবে না; যদি তাহা না চাই, তাহা হইলে সমগ্র মানবজাতিকে অন্তর্ভুক্ত করিবার জন্য আমাদের মিলনভূমি প্রশস্ত করিতেই হইবে। এই ধর্মমহাসভায় আরও বলা হইয়াছে-মানবজাতির কল্যাণ সাধন করা আমাদের কর্তব্য, কারণ প্রত্যেক অসৎ ও হীন কার্যেরই প্রতিক্রিয়া আছে। আমার মনে হয়, এটি দোকানদারির ভাব : আমরাই প্রথমে, তারপর আমাদের ভাই-এরা। আমি মনে করি, ঈশ্বরের সর্বজনীন পিতৃত্বে আমরা বিশ্বাস করি বা না করি, ভাইকে আমাদের ভালবাসিতেই হইবে, কারণ প্রত্যেক ধর্ম ও প্রত্যেক মত মানুষের দিব্যভাব স্বীকার করে; কাহারও অনিষ্ট করিও না, তাহা হইলে তাহার অন্তর্নিহিত দিব্যভাবকে ক্ষুন্ন করা হইবে না।
১১. ভগবৎপ্রেম
[২৫শে সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩, ‘Chicago Herald’ পত্রিকায় প্রকাশিত স্বামীজীর একটি বক্তৃতার সংক্ষিপ্ত বিবরণী]
লাফলিন ও মনরো স্ট্রীটে তৃতীয় ইউনিটেরিয়ান চার্চের বক্তৃতা-গৃ্হে সমবেত শ্রোতৃমন্ডলী গতকল্য প্রাতে স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা শ্রবণ করেন। তাঁহার বক্তৃতার বিষয় ছিল ভগবৎপ্রেম; আলোচনা বাগ্মিতাপূর্ণ ও অপূর্ব হইয়াছিল।
তিনি বলেন : ঈশ্বর পৃথিবীর সর্বত্র পূজিত হন, কিন্তু বিভিন্ন নামে এবং বিভিন্ন উপায়ে। মহান্ ও সুন্দর ঈশ্বরকে উপাসনা করা মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক, এবং ধর্ম মানুষের প্রকৃতিগত। সকলেই ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এবং ঈশ্বরের প্রতি প্রেমই মানুষকে দান, দয়া, ন্যায়পরতা প্রভৃতি সৎকার্যে প্রণোদিত করে। সকলেই ঈশ্বরকে ভালবাসে, কারণ তিনি প্রেমস্বরূপ।
বক্তা চিকাগোতে আসা অবধি মানুষের ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধে অনেক কিছু শুনিয়াছেন। তিনি বিশ্বাস করেন-আরও দৃঢ়তর বন্ধন মানুষকে যুক্ত করিয়া রাখিয়াছে, কারণ সকলেই ঈশ্বরপ্রেম হইতে সঞ্জাত। মানুষের ভ্রাতৃত্ব ঈশ্বরের পিতৃত্বেরই যুক্তিগত সিদ্ধান্ত। বক্তা বলেন :
তিনি ভারতের বনে বনে ভ্রমণ করিয়াছেন, পর্বতগুহায় রাত্রি কাটাইয়াছেন, সমগ্র প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করিয়া তিনি এই বিশ্বাসে উপনীত হইয়াছেন যে, স্বাভাবিক নিয়মের ঊর্দ্ধে এমন কিছু আছে, যাহা মানুষকে অসত্য বা অন্যায় হইতে রক্ষা করে। তিনি সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, উহা ঈশ্বরপ্রেম। ঈশ্বর যদি যীশু, মহম্মদ ও বৈদিক ঋষিগণের সহিত কথা বলিয়া থাকেন, তাহা হইলে ঈশ্বরেরই অন্যতম সন্তান-তাঁহার সহিতও তিনি কেন কথা বলেন না?
স্বামী আরও বলিলেন : সত্যই তিনি আমার সহিত এবং তাঁহার সকল সন্তানের সহিত কথা বলেন। আমরা তাঁহাকে আমাদের চতুর্দিকে দেখি এবং তাঁহার প্রেমের সীমাহীনতা দ্বারা নিরন্তর প্রভাবিত হই এবং সেই প্রেম হইতে আমাদের মঙ্গল ও শুভকর্মের প্রেরণা লাভ করি।
০২. কর্মযোগ
০১. কর্ম-চরিত্রের উপর ইহার প্রভাব
কর্ম শব্দটি সংস্কত ‘কৃ’-ধাতু হইতে নিষ্পন্ন; ‘কৃ’-ধাতুর অর্থ ‘করা’; যাহা কিছু করা হয়, তাহাই কর্ম। এই শব্দটির আবার পারিভাষিক অর্থ ‘কর্মফল’। দার্শনিকভাবে ব্যবহৃত হইলে কখন কখন উহার অর্থ হয়-সেই-সকল ফল, আমাদের পূর্ব কর্ম যেগুলির কারণ। কিন্তু কর্মযোগে আমাদের ‘কর্ম’ শব্দটি কেবল ‘কাজ’ অর্থেই ব্যাবহার করিতে হইবে। মানবজাতির চরম লক্ষ্য-জ্ঞানলাভ। প্রাচ্য দর্শন আমাদের নিকটে এই একমাত্র লক্ষ্যের কথাই বলিয়াছেন। মানুষের চরম লক্ষ্য সুখ নয়, জ্ঞান। সুখ ও আনন্দ তো শেষ হইয়া যায়। সুখই চরম লক্ষ্য-এরূপ মনে করা ভ্রম। জগতে আমরা যত দুঃখ দেখিতে পাই, তাহার কারণ-মানুষ অজ্ঞের মতো মনে করে, সুখই আমাদের চরম লক্ষ্য। কালে মানুষ বুঝিতে পারে, সুখের দিকে নয়, জ্ঞানের দিকেই সে ক্রমাগত চলিয়াছে। দুঃখ ও সুখ উভয়েই তাহার মহান্ শিক্ষক, সে শুভ এবং অশুভ হইতে সমভাবে শিক্ষা পায়। সুখ-দুঃখ যেমন আমাদের মনের উপর দিয়া চলিয়া যায়, অমনি তাহারা উহার উপর নানাবিধ চিত্র রাখিয়া যায়, আর এই চিত্রসমষ্টি বা সংস্কার-সমষ্টির ফলকেই আমরা মানুষের ‘চরিত্র’ বলি। কোন ব্যক্তির চরিত্র লইয়া আলোচনা করিয়া দেখ, বুঝিবে উহা প্রকৃতপক্ষে তাহার মনের প্রবৃত্তি -মনের প্রবণতাসমূহের সমষ্টিমাত্র। দেখিবে, সুখ দুঃখ-দুই-ই সমভাবে তাহার চরিত্রগঠনের উপাদান; চরিত্রকে এক বিশেষ ছাঁচে ঢালিবার পক্ষে ভাল-মন্দ উভয়েরই সমান অংশ আছে; কোন কোন স্থলে সুখ অপেক্ষা বরং দুঃখ অধিকতর শিক্ষা দেয়। জগতের মহাপুরুষদের চরিত্র আলোচনা করিলে দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুখ অপেক্ষা দুঃখ তাঁহাদিগকে অধিক শিক্ষা দিয়াছে-ধনৈ্শ্বর্য অপেক্ষা দারিদ্র্য অধিক শিক্ষা দিয়াছে, প্রশংসা অপেক্ষা নিন্দারূপ আঘাতই তাঁহাদের অন্তরের অগ্নি প্রজ্বলিত করিতে অধিক পরিমাণে সাহায্য করিয়াছে।