দ্রষ্টা দৃশিমাত্রঃ শুদ্ধোহপি প্রত্যয়ানুপশাঃ ।।২০।।
-দ্রষ্টা কেবল চৈতন্য মাত্র; যদিও তিনি স্বয়ং পবিত্রস্বরূপ, তথাপি বুদ্ধির ভিতর দিয়া তিনি দেখিয়া থকেন।
এখানেও সাংখ্যদর্শনের কথা বলা হইয়াছে। আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি, সাংখ্যদর্শনের এই মত যে, নিম্নতম বিকাশ হইতে বুদ্ধি পর্যন্ত সবই প্রকৃতির অন্তর্গত; পুরুষগণ প্রকৃতির বাহিরে, এই পুরুষগণের কোন গুণ নাই। তবে আত্মা দুঃখী বা সুখী বলিয়া প্রতীয়মান হন কেন? প্রতিফলনের দ্বারা। একখন্ড স্ফটিকের নিকট একটি লাল ফুল রাখিলে ঐ স্ফটিকটিকে লাল দেখাইবে; সেইরূপ আমরা যে সুখ বা দুঃখ বোধ করিতেছি, তাহা বাস্তবিক প্রতিবিম্ব মাত্র, বাস্তবিক আত্মাতে এ-সকল কিছুই নাই। আত্মা প্রকৃতি হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্ বস্তু। প্রকৃতি এক বস্তু, আত্মা এক বস্তু, এই দুই চিরদিন পৃথক্। সাংখ্যেরা বলেন যে, (বুদ্ধিজাত) জ্ঞান একটি মিশ্র পদার্থ, উহার হ্রাসবৃদ্ধি আছে, উহা পরিবর্তনশীল; শরীরের ন্যায় উহাও ক্রমশঃ পরিণামপ্রাপ্ত হয়, শরীরের যে-সকল ধর্ম, উহাতেও প্রায় সে-সকল ধর্ম বিদ্যমান। শরীরের পক্ষে নখ যেমন, এই জ্ঞানের পক্ষে দেহও সেইরূপ। নখ শরীরের একটি অংশ, উহাকে শত শত বার কাটিয়া ফলিলেও শরীর বাঁচিয়া থাকে। সেইরূপ এই শরীর বহুবার পরিত্যক্ত হইলেও (বুদ্ধিজাত) জ্ঞান যুগযুগান্তর ধরিয়া থাকিবে। কিন্তু তাহা হইলেও এই জ্ঞান কখনও অবিনাশী হইতে পারে না, কারণ উহা পরিবর্তনশীল, উহার হ্রাসবৃদ্ধি আছে। আর যাহা কিছু পরিবর্তনশীল, তাহা কখনও অবিনাশী হইতে পারে না। এই জ্ঞান অবশ্যই জন্যপদার্থ। আর ইহা হইতেই বুঝাইতেছে, অন্য আর এক পদার্থ আছে। জন্যপদার্থ কখনও মুক্তস্বভাব হইতে পারে না। সংশ্লিষ্ট সবকিছুই প্রকৃতির অন্তর্গত, সুতরাং চিরকালের জন্য বদ্ধ। তবে মুক্ত কে? যিনি কার্য-কারণ-সম্বন্ধের অতীত, তিনিই প্রকৃত মুক্ত। তুমি যদি বলো, মুক্তভাবটি ভ্রমাত্মক, আমি বলিব, বন্ধনের ভাবটিও ভ্রমাত্মক। আমাদের জ্ঞানে এই দুই ভাবই সদা বিরাজিত, পরস্পরের আশ্রিত-একটি না থাকিলে অপরটি থাকিতে পারে না। বন্ধন ও মুক্তি সম্বন্ধে ইহাই আমাদের ধারণা। যদি দেওয়ালের মধ্য দিয়া যাইতে চাই, আমাদের মাথা দেওয়ালে ধাক্কা খায়; তাহা হইলে বুঝিলাম, আমরা ঐ দেওয়ালের দ্বারা সীমাবদ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে বুঝিলাম, আমাদের একটা ইচ্ছাশক্তি আছে। এবং মনে করি, এই ইচ্ছাশক্তিকে আমরা যেখানে ইচ্ছা পরিচালিত করিতে পারি। প্রতিপদে এই বিরোধী ভাব-দুইটি আমাদের সন্মুখে আসিতেছে। আমাদিগকে বিশ্বাস করিতেই হইবে আমরা মুক্ত; কিন্তু প্রতি মুহূর্তে দেখিতেছি, আমরা মুক্ত নই। দুইটি ভাবের মধ্যে একটি যদি ভ্রমাত্মক হয়, তবে অপরটিও ভ্রমাত্মক হইবে, আর একটি যদি সত্য হয় তবে অপরটিও সত্য হইবে, কারণ উভয়েই অনুভবরূপ একই ভিত্তির উপর স্থাপিত। যোগী বলেন, এই দুইটি ভাবই সত্য, বুদ্ধি পর্যন্ত ধরিলে আমরা বদ্ধ। কিন্তু আত্মা হিসাবে আমরা মুক্ত। মানুষের প্রকৃত স্বরূপ-আত্মা বা পুরুষ-কার্যকারণ-শৃঙ্খলের বাহিরে। এই আত্মার মুক্তস্বভাবটি জড়ের ভিন্ন ভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়া পরিস্রুত হইয়া বুদ্ধি, মন ইত্যাদি নানা আকার ধারণ করিয়াছে। আত্মারই জ্যোতিঃ সবকিছুর ভিতর দিয়া প্রকাশিত হইতেছে। বুদ্ধির নিজের কোন আলো নাই। মস্তিষ্কে প্রত্যেক ইন্দ্রিয়েরই এক-একটি কেন্দ্র আছে। সকল ইন্দ্রিয়ের যে একটিমাত্র কেন্দ্র, তাহা নয়, প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের কেন্দ্র পৃথক্ পৃথক্। তবে আমাদের এই অনুভূতিগুলি সামঞ্জস্য লাভ করে কিভাবে? কোথায় তাহারা একত্ব লাভ করে? মস্তিষ্কে যদি তাহারা এই একত্ব লাভ করিত, তাহা হইলে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গুলির একটি মাত্র কেন্দ্র থাকিত। কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে জানি যে, প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কেন্দ্র আছে। মানুষ কিন্তু একই সময়ে দেখিতে ও শুনিতে
পায়। ইহাতেই বোধ হইতেছে যে, এই বুদ্ধির পশ্চাতে অবশ্যই একটি একত্ব আছে। বুদ্ধি মস্তিষ্কের সহিত সম্বন্ধ-কিন্তু এই বুদ্ধিরও পশ্চাতে পুরুষ রহিয়াছেন। তিনিই একত্বস্বরূপ। তাঁহার নিকট গিয়াই সমুদয় বেদনা ও অনুভূতি মিলিত হয় ও একীভাব ধারণ করে। আত্মাই সেই কেন্দ্র, যেখানে সমুদয় ভিন্ন ভিন্ন ইন্দ্রিয়ানুভূতি মিলিত ও একীভূত হয়। সেই আত্মা মুক্তস্বভাব। এই আত্মার মুক্ত স্বাভাবই তোমাকে প্রতি মুহূর্তে বলিতেছে, তুমি মুক্ত। কিন্তু তুমি ভুল করিতেছ। সেই মুক্ত স্বভাবকে প্রতি মুহূর্তে বুদ্ধি ও মনের সহিত মিশ্রিত করিয়া ফেলিতেছ। তুমি সেই মুক্ত স্বভাব বুদ্ধিতে আরোপ করিবার চেষ্টা করিতেছ। আবার তৎক্ষণাৎ দেখিতে পাইতেছ যে, বুদ্ধি মুক্তস্বভাব নয়। তুমি তখন সেই মুক্ত স্বভাব দেহে আরোপ করিয়া থাকো, কিন্তু প্রকৃতি তোমাকে তৎক্ষণাৎ বলিয়া দেন, তুমি আবার ভুল করিয়াছ। এই জন্যই একই সময়ে আমাদের মুক্তি ও বন্ধনের মিশ্রিত অনুভূতি দেখিতে পাওয়া যায়। যোগী মুক্ত ও বদ্ধ, উভয় অবস্থারই বিশ্লেষণ করেন; এবং তাঁহার অজ্ঞানান্ধকার দূর হয়। তিনি বুঝিতে পারেন যে, পুরুষই মুক্ত, জ্ঞানঘন; বুদ্ধিরূপ উপাধির মধ্য দিয়া তিনিই এই সান্ত (সীমাবদ্ধ) জ্ঞানরূপে প্রকাশ পাইতেছেন, সেই হিসাবেই তিনি বদ্ধ।