উৎপন্ন নন। যাহা মিশ্রণ হইতে উৎপন্ন নয়, তাহার কখনও নাশ হইতে পারে না। এই পুরুষ বা আত্মা-সমূহের সংখ্যা অসীম।
এখন আমরা এই সূত্রটির তাৎপর্য বুঝিতে পারিব। ‘বিশেষ’ অর্থে স্থূলভূত-যেগুলিকে আমরা ইন্দ্রিয়দ্বারা উপলব্ধি করিতে পারি। ‘অবিশেষ’ অর্থে সূক্ষ্মভূত -তন্মাত্র, এই তন্মাত্র সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করিতে পারে না। পতঞ্জলি বলেন, ‘যদি তুমি যোগাভ্যাস কর, কিছুদিন পরে তোমার অনুভব-শক্তি এত সূক্ষ্ম হইবে যে, তুমি তন্মাত্রগুলি বাস্তবিক পত্যক্ষ করিবে।’ তোমরা শুনিয়াছ, প্রত্যেক ব্যক্তির চারিদিকে এক প্রকার জ্যোতিঃ আছে, প্রত্যেক প্রাণীর ভিতর হইতে সর্বদা এক প্রকার আলোক বাহির হইতেছে। পতঞ্জলি বলেন, কেবল যোগীই উহা দেখিতে পান। আমরা সকলে উহা দেখিতে পাই না, কিন্তু যেমন পুষ্প হইতে সর্বদাই সূক্ষ্মকণা নির্গত হয়, যেগুলি দ্বারা আমরা আঘ্রাণ পাই, সেইরূপ আমাদের শরীর হইতেও সর্বদাই এই তন্মাত্রসকল বাহির হইতেছে। প্রত্যহই আমাদের শরীর হইতে শুভ বা অশুভ শক্তি ও ভাবরাশি বাহির হইতছে; এবং আমরা যেখানেই যাই, সেখানেই পরিবেশ এই তন্মাত্রয় পূর্ণ থাকে। ইহার প্রকৃত রহস্য না জানিলেও এইভাবেই অজ্ঞাতসারে মানুষের মনে মন্দির, গির্জাদি করিবার ভাব আসিয়াছে। ভগবানকে উপাসনা করিবার জন্য মন্দিরনির্মাণের কি প্রয়োজন ছিল? যেখানে সেখানে ঈশ্বরের উপাসনা কর না কেন? কারণ না জানিলেও মানুষ বুঝিয়াছিল যে, যেখানে লোকে ঈশ্বরের উপাসনা করে, সে স্থান পবিত্র তন্মাত্রয় পরিপূর্ণ হইয়া যায়। সকলে প্রত্যহ সেখানে যায়, সেখানে যতই বেশী যাতায়াত করে, ততই মানুষ পবিত্র হইতে থাকে, সঙ্গে সঙ্গে স্থানটিও পবিত্রতর হইতে থাকে। যে ব্যক্তির অন্তরে বেশী সত্ত্বগুণ নাই, সে যদি সেখানে যায়, তাহারও সত্ত্বগুণের উদ্রেক হইবে। অতএব মন্দির ও তীর্থাদি কেন পবিত্র বলিয়া গণ্য হয়, তাহার কারণ বুঝা গেল। কিন্তু এটি সর্বদাই স্মরণ রাখিতে হইবে যে, সাধু লোকের সমাগমের উপরেই সেই স্থানের পরিত্রতা নির্ভর করে। কিন্তু মুশকিল এই যে, মানুষ মূল উদ্দেশ্য ভুলিয়া যায়-অশ্বের সন্মুখে শকট যোজনা করে। প্রথমে মানুষই এই স্থানগুলিকে পবিত্র করিয়াছিল, তারপর সেই স্থানের পবিত্রতা আবার কারণ হইয়া অপরকেও পবিত্র করিত। যদি সে স্থানে সর্বদা অসাধু লোকই যাতায়াত করে, তাহা হইলে সেই স্থান অন্যান্য স্থানের মতোই অপবিত্র হইয়া যাইবে। বাড়িঘরের গুণে নয়, লোকের গুণেই মন্দির পবিত্র বলিয়া গণ্য হয়; কিন্তু এটি আমরা সর্বদা ভুলিয়া যাই। এই কারণেই সমধিক সত্ত্বগুণসম্পন্ন সাধু ও মহাত্মাগণ চতুর্দিকে ঐ সত্ত্বগুণ বিকিরণ করিয়া তাঁহাদের চতুষ্পার্শ্বস্থ লোকের উপর দিনরাত প্রচন্ড প্রভাব বিস্তার করিতে পারেন। মানুষ এত পবিত্র হইতে পারে যে, তাহার সেই পবিত্রতা যেন স্পর্শ করা যায়। সাধুর শরীর পবিত্র, তিনি যেখানে বিচরণ করেন, সেখানেই পবিত্রতা বিচ্ছুরিত হয়। যে কেহ তাঁহার সংস্পর্শে আসে, সে-ই পবিত্র হইয়া যায়।
এখন ‘লিঙ্গমাত্র’-এর অর্থ কি, দেখা যাক। ‘লিঙ্গমাত্র’ বলিতে বুদ্ধিকে বুঝায়; উহা প্রকৃতির প্রথম অভিব্যক্তি, উহা হইতেই অন্যান্য সমুদয় বস্তু অভিব্যক্ত হইয়াছে। গুণের শেষ অবস্থাটির নাম ‘অলিঙ্গ’ বা চিহ্নশূন্য। এইখানেই আধুনিক বিজ্ঞান ও ধর্মগুলির মধ্যে বিশেষ পার্থক্য দেখা যায়। প্রত্যেক ধর্মেই এই ভাবটি দেখিতে পাওয়া যায় যে, এই জগৎ চৈতন্যশক্তি হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। ঈশ্বর আমাদের ন্যায় ব্যক্তিবিশেষ কিনা, এ বিচার ছাড়িয়া দিয়া কেবল মনোবিজ্ঞানের দিক দিয়া ধরিলে ঈশ্বরবাদের তাৎপর্য এই যে, চৈতন্যই সৃষ্টির আদি বস্তু; তাহা হইতেই স্থূলভূতের প্রকাশ হইয়াছে। কিন্তু আধুনিক দার্শনিক পন্ডিতেরা বলেন, চৈতন্য সৃষ্টির শেষ বস্তু। তাঁহাদের মত এই যে, অচেতন জড় বস্তুসকল অল্পে অল্পে জীবজন্তুতে পরিণত হইয়াছে, এই জীবজন্তু ক্রমশঃ উন্নত হইয়া মনুষ্যরূপে বিকশিত হইয়াছে। তাঁহারা বলেন, জগতে সমুদয় বস্তু যে চৈতন্য হইতে প্রসৃত হইয়াছে তাহা নয়, বরং চৈতন্যই সৃষ্টির সর্বশেষ বস্তু। ধর্ম ও বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত আপাতবিরূদ্ধ বলিয়া মনে হইলেও দুইটি সিদ্ধান্তই সত্য। একটি অনন্ত শৃঙ্খল বা শ্রেণী গ্রহণ কর, যেমন ক-খ-ক-খ-ক-খ-ইত্যাদি; প্রশ্ন এই, ইহার মধ্যে ক আদিতে অথবা খ আদিতে? যদি তুমি এই শৃঙ্খলটিকে ক-খ এইরূপে গ্রহণ কর, তাহা হইলে অবশ্য ‘ক’কে প্রথম বলিতে হইবে, কিন্তু যদি তুমি উহাকে খ-ক এইভাবে গ্রহণ কর, তাহা হইলে ‘খ’কেই আদি ধরিতে হইবে। আমরা যে দিক দিয়া দেখিতেছি, তাহার উপর উহা নির্ভর করে। চৈতন্য পরিণামপ্রাপ্ত ইহয়া স্থূলভূতের আকার ধারণ করে, স্থূলভূত আবার চৈতন্যরূপে পরিণত হয়, এইভাবেই চলিতে থাকে। সাংখ্যেরা ও অন্যান্য ধর্মাচার্যগণ চৈতন্যকে অগ্রে স্থাপন করেন। তাহাতে ঐ শৃঙ্খল এই আকার ধারণ করে, যথা-প্রথমে চৈতন্য, পরে জড়। বৈজ্ঞানিক জড়কে গ্রহণ করিয়া বলেন, ‘প্রথমে জড়, পরে চৈতন্য’। উভয়েই একই শৃঙ্খলের কথা বলিতেছেন। ভারতীয় দর্শন কিন্তু এই চৈতন্য ও জড়-উভয়েরই পারে পুরুষ বা আত্মাকে দেখিতে পান। এই আত্মা বুদ্ধির অতীত; বুদ্ধি তাঁহারই প্রতিফলিত আলোক।