ঘুমে-অচেতন মানুষ স্বপ্ন দেখে। তা থেকেই সে সহজাত বুদ্ধি দিয়ে বুঝেছে, দেহ ও চৈতন্য পৃথক সত্তা। তা ছাড়া স্বপ্নে মৃতমানুষকেও সে ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে পায়, সে-কায়াধারী মৃত্যমানুষ অশনে-বসনে-আসনে-কথায়-কাজে অবিকল জীবিত মানুষের মতো। এর থেকেই মানুষের ধারণা ও নিশ্চিত বিশ্বাস হয়েছে যে আত্মা নামে জীবচৈতন্য অবিনশ্বর-অমর। কাজেই আনুষঙ্গিকভাবে পরলোক-প্রেতলোক-আত্মালোক, দেবলোক, স্বৰ্গ-নরকলোকে কল্পনা করা ও সেগুলোর অস্তিত্ত্বে দৃঢ় বিশ্বাস রাখা অবশ্যম্ভাবী ও আবশ্যিক হয়ে পড়ে। বিদেহী আত্মার অমরত্বে আস্থা রাখলে সে-সম্পর্কিত চিন্তাচেতনা এড়ানো যায় না। পারলৌকিক দায়িত্ব-কর্তব্যও বর্তায় এবং তাতে দেহ-মনের কাজ বাড়ে। নিজের জন্যে তো বটেই, মৃত আত্মীয়-স্বজনের জন্যেও কিছু করতে হয়। জীবিতমাত্রেই খাদ্য চায়, কাজেই জীবিত আত্মারও খাদ্য দরকার। এর জন্যে খাদ্য পানীয় প্রভৃতি জীবিতের যাবতীয় আবশ্যিক বস্তুর ব্যবস্থা করতে হয়। আবার আত্মা যেহেতু অমর এবং কায়াহীন আত্মার স্থিতি এখনো ধারণাতীত, সেহেতু মমি করেও দেহ রাখার ব্যবস্থা। মৃতের সৎকার, প্রার্থনা, শ্ৰাদ্ধ, ভোজ, মমি, পিণ্ডি, জানাজা, জেয়ারত, পিতৃপুরুষ পূজা, প্ৰেত পূজা, শোকপ্রকাশ প্রভৃতি আচার-প্ৰথা-পদ্ধতি তাই স্বরূপে কিংবা রূপান্তরে আদিম এবং সর্বজনীন। শিব কেউ কবর দেয়, কেউ পোড়ায়, কেউ শকুনকে বিলায়, কেউ ভাসায়। প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত (১৬০,০০০ বছর আগে উদ্ভূত এবং ৪০,০০০ বছর আগে বিলুপ্ত) Neanderthalers জাতীয় আদিমানুষেরা পশ্চিম এশিয়ায় ও উত্তর য়ূরোপে বাস করত। তাদের মধ্যে প্ৰাণিপূজা, জাদু ও মৃতের শাস্ত্রীয় সৎকারের রীতি চালু ছিল। শিকার-সহায় ‘ভালুক’ টোটেমরূপে অবলম্বন ছিল—পরে নব্যপোলীয় যুগের য়ূরোপে দেখি ষাঁড়, ইরাক-ইরান-মহেনজোদারোতেও পাই ষাঁড়। উত্তর ও পশ্চিম য়ূরোপে ও সাইবেরিয়ায় টোটেমরূপে পিতৃপুরুষ প্রতীক। ‘ভালুক’ পূজার রেওয়াজ ছিল। স্মৃতিরক্ষার জন্যে চিতায়-কবরে সৌধ রচনাদি নানা ব্যবস্থা আজও অবিরল।
আবার প্রত্যক্ষ বাস্তব ঐহিক জীবন থেকে কাল্পনিক পারিত্রিক জীবন কখনো অধিক কাম্য হতে পারে না। তাই মৃত্যু ও মৃত দুই-ই বিনাশপ্রতীক ও ভীতিপ্রদ। ন্যায়-অন্যায়, সুকৰ্ম-দুষ্কর্ম, শাপ-বর ও পাপ-পুণ্য চেতনা ক্ৰমে সেই ভয় বৃদ্ধি করেছে। আগে থেকেই তো জগৎ ও জীবন-নিয়ন্ত্রী একটা বা একাধিক সার্বভৌম অদৃশ্য-অলৌকিক শক্তির ধারণা ছিলই, শাস্ত্রীয় যুগে তা তত্ত্ব-দর্শনের বিষয় হয়ে সুসামঞ্জস, সুসংহত, সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট অমিত শক্তির আধার এবং দান-দয়া ও দণ্ড-মুণ্ডের মালিকরুপে চিরন্তন স্থিতি পেল। কাজেই মানুষের জন্ম-জীবন-জীবিকা, ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণ প্রভৃতির মালিক, নিয়ন্তা ও বিচারকরূপী স্রষ্টা বিধাতাও উপাস্য হলেন। তাকে বা তাদের এড়ানো সরানো চলে না বলেই তাঁর বা তাদের শাসন-লালন মানতেই হয়। তাই সুখে-দুঃখে, রোগেশোকে, লাভে-ক্ষতিতে আনুগত্য অবিচল রাখতে হয়-বিদ্রোহ কেবল বিপদ-যন্ত্রণাই বৃদ্ধি করবে–এ বিশ্বাস মানুষের জীবনে এত গভীর যে তার প্রভাবে কোনো আস্তিক মানুষই আত্মিক শক্তিতে আস্থা রেখে কোনো কাজি সাফল্য সম্বন্ধে আত্মপ্রত্যয়ী হতে পারে না। তাই আস্তিক মানুষ মাত্রেই দেবনির্ভর। ধর্মের মূল্যের, গুরুত্বের ও ধর্মে আনুগত্যের কারণ এ-ই। গোত্রীয় মানুষকে মতবাদভিত্তিক ঐক্য ও সংহতি দান করে ধর্মমত সেইদিন দুশমন ও দূরের মানুষ নিয়ে বৃহত্তর সমাজ ও সম্প্রদায় গঠনের কারণ হয়েছিল এবং মনুষ্য-সভ্যতার ক্রমোন্নতি ত্বরান্বিত করেছিল। গোত্রীয় জীবনধারার অবসানের পরেও পশুপালন এবং কৃষিকাৰ্য দুটোই সমাজ-বিকাশের বিশেষ স্তরে যৌথ প্ৰয়াস ও কর্মসাপেক্ষ ছিল। জীবিকা উৎপাদন ও বণ্টন যখন জনবৃদ্ধির সঙ্গে আনুপাতিক সমতা রক্ষায় ব্যর্থ হয় তখনই শক্তিবৈষম্য ও জীবিকা সম্পদে হ্রাস-বৃদ্ধি প্রকট হয়ে ওঠে। কায়িক শক্তিতে-বুদ্ধিতে-কৌশলে ও সম্পদে যে দুর্বল, সে-ই প্রবল দুর্জনের দীেরাত্ম্যের শিকার হল। জীবিকার জন্যেই বাহুবল, ধনবল, বুদ্ধিবল যার বা যাদের ছিল, তারাই অনন্যেপায় দুর্বলকে বশ বা দাস করতে পারল। দাসদের খাটিয়ে মালিকের পক্ষে তার পশুর বৃহৎ পাল পোষণ ও চাষের জমির সীমা বৃদ্ধি করা সম্ভব হল। এমনি করে ধনী আরো ধনী ও গরিবরা দাসে পরিণত হচ্ছিল; পরিণামে তা-ই সামন্তসমাজের উদ্ভব ঘটোল। গোত্রীয় জীবনের অবসান-মুহূর্তে যদি বিনিময় প্রতীক মুদ্রা চালু থাকত, তা হলে হয়তো দাসপ্রথা এমন সর্বব্যাপী ও দীর্ঘস্থায়ী হত না। কারণ সে-ক্ষেত্রে এখনকার মতো মুদ্ৰামূল্যেই মজুর মিলত।
ক্রমবিকাশের ধারায় যেখানে যেখানে জীবিকার সৃষ্টি ও অর্জনপদ্ধতি বৈচিত্ৰ্য লাভ করেছিল এবং জীবনধারণে আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় কিংবা স্বাচ্ছন্দ্যসামগ্ৰী বা বিলাসব্যাসন বস্তু নব নব আবিষ্কারে ও উদ্ভাবনে বৃদ্ধি পাচ্ছিল; তখন সেই বহু ও বিচিত্র দ্রব্য ও পণ্য নির্মাণে, উৎপাদনে কিংবা অন্যপ্রকার উপযোগ সৃষ্টির কাজে বর্ধিত হারে শ্রমশক্তি বিনিয়োগ আবশ্যিক হয়ে ওঠে। অর্থাৎকৃষি-শিল্প-বাণিজ্য এবং ধোয়া-মােছা-কাটা ছাড়াও ঘর-ঘাট, বাট-মাঠ-মন্দির নির্মাণ, পূজা-শিন্নি, পঠন-পাঠন, রোগ-নিদান-চিকিৎসা-শুশ্রুষা প্রভৃতি হাজারো রকম প্রাত্যহিক কর্তব্য ও কাজ দেখা দিচ্ছিল। তখন দায়িত্ব ও কর্মভাগ আবশ্যিক হল। ক্ৰমে উচ্চ-তুচ্ছ, লঘু-গুরু, শক্ত-সহজ, কুশল-অকুশল, প্রয়োজনবিলাস ও ক্ষয়-অর্জন ভেদে শ্রমিকেরও ধন-মান-যশও গুরুত্বভেদ হল, এবং পরিণামে পৃথিবীব্যাপী সর্বত্র ধর্মভেদে জািত-জন্ম-মান-বৰ্ণভেদ দেখা দিল। তাই দুনিয়া ব্যাপী সর্বত্র মানুষের সমাজে নানাপ্রকারের বৈষম্য-বিভেদ-বিরোধ-দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ-সংঘাত-পীড়নপোষণ-শাসন-শোষণ আজ অবধি রয়েছে, কেবল তা কোথাও গণমানবের অজ্ঞতাঅসহায়তার দরুন গুরু, কোথাও-বা নানা কারণে লঘু। সেটার আধুনিক নাম শ্রেণীদ্বন্দ্ব। সুবিধাভোগী ধনী-মানীরা স্ব-স্বার্থেই স্রষ্টা, শাস্ত্র ও সমাজের দোহাই দিয়ে সেই বৈষম্যকেই চিরন্তন করে রাখতে চেয়েছে, এখনো চায়। ফলে যারা পীড়ক-শোষক তারাও যেমন এর মধ্যে অন্যায়-অবিচার দেখে না, যারা পীড়িত-শোষিত তারাও ঐ বঞ্চনা দুর্ভোগকে অদৃষ্ট বলেই মানে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় এদের জীবন-মনন চিত্র স্বল্প কথায় সঠিক অভিব্যক্ত :