ব্যক্তি হিসেবেও মানুষের জৈবিক, নৈতিক, বৃত্তিক, বৌদ্ধিক, শান্ত্রিক ও শ্রেণিক বা সামাজিক আচরণ তার বলনে-চাহনে-চলনে কিংবা ক্রীড়ায়-কর্মে-ভঙ্গিতে, হাসি-ঠাট্টায়ক্ৰোধে-ক্ষোভে, দয়ায়-দাক্ষিণ্যে-সেবায়-সমবেদনায়, ঈর্ষায়-অসূয়ায়, লিন্সায়-নিষ্ঠুরতায় নিত্য প্ৰকাশমান। ব্যষ্টি নিয়ে সমষ্টি, সেই সামষ্টিক আচরণে একটা সমাজসত্তার বা জাতিসত্তার সামানীকৃত আচরণ বা অভিব্যক্তি নিরূপণই নৃতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিকের সন্ধিৎসার মূল লক্ষ্য।
মানুষের মনন ও আচরণ নিয়ন্ত্রিত হয় জন্মসূত্রে লব্ধ পারিবারিক-সামাজিক-শান্ত্রিকসাংস্কৃতিক বিশ্বাস-সংস্কার, রীতি-রেওয়াজ, নীতি-আদৰ্শ, প্ৰথা-পদ্ধতি-প্রতিষ্ঠান, উৎসবপার্বণ, আচার-অনুষ্ঠান প্রভৃতির প্রভাবে। এদিক দিয়ে কোনো মানুষই স্বাধীন ও স্বসৃষ্ট নয়, হাজার অদৃশ্য ‘বাগে’ ও বাঁধনে তার ভাব-চিন্তা-কর্ম ও আচরণ নিয়ন্ত্রিত। অতএব সামাজিক আচরণমাত্রই কৃত্রিম তথা অর্জিত, অনুশীলিত ও পরিস্রুত।
এই বহু ও বিচিত্র বিশ্বাস-সংস্কার, রীতি-রেওয়াজ, আচার-আচরণ, উৎসব-পার্বণ, প্ৰথা-পদ্ধতি, দারু-টোনা-ঝাড়-ফুক-তাবিজ-মাদুলি-বাণ-উচাটন প্রভৃতির সম্ভাব্য উৎস নির্দেশ, তার আদি ও রূপান্তর নিরূপণ, টোটেম-টেবু-জাদুর জড় আবিষ্কার প্রভৃতি আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য বা প্ৰায় অসাধ্য বটে, তবে আমাদের তথ্য পরিবেশনা বিদ্বনবিজ্ঞানীদের তত্ত্ব নিরূপণের ও মূলানুসন্ধানের সহায়ক হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। তাই আমাদের এ প্ৰয়াস এবং প্ৰয়াসের সার্থকতাও এখানেই।
আমরা প্রাপ্ত সাংস্কৃতিক আচার-আচরণের শ্রেণী ভাগ করেছি। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক এই উপকরণগুলো প্ৰায় পাঁচশ বছরের পরিসরে রচিত গ্রন্থাবলি থেকে সংগৃহীত ও সংকলিত। সে-যুগে অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক ও কৃৎকৌশলের যন্ত্রগুলো আবিষ্কারপূর্ব যুগে সমাজের বিবর্তনের গতি ছিল স্থবিরপ্রায় মন্থর। আবর্তনই ছিল স্বাভাবিক। পাঁচশ বছরেও পরিবর্তন ছিল দুর্লক্ষ্য। বরং সে-যুগে মনন-বিবর্তন যত সহজ ছিল, তত স্বাভাবিক ছিল না ব্যবহারিক–বৈষয়িক-জীবনধারার পরিবর্তন। তাই জন্মমৃত্যু শাসিত জীবনস্রোত তথা লোকপ্রবাহ ছিল, কিন্তু তেমন ক্রমবিবর্তন ছিল নাজীবনযাত্রার ধারায় কেবল আবর্তিত প্রবাহই ছিল স্বাভাবিক। জন্মসূত্রে পাওয়া সং ও ধর্মশাস্ত্ৰই-যে মানুষের মনন ও আচরণ বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করে, তা কেউ অস্বীকার করে না। সেজন্যেই আমরা কেবল মুসলিম-রচিত বাংলাসাহিত্য থেকেই উপাদান সংগ্ৰহ করেছি। যাতে দেশজ মুসলমানের শাস্ত্ৰ, সমাজ ও সংস্কৃতিগত আচার-আচরণের একটা সার্বিক ও সামগ্রিক রূপ মেলে এই প্ৰত্যাশায়।
সঞ্চয়বুদ্ধিই যৌথজীবনের প্রবর্তনা দেয়। তাই মানুষ ছাড়াও উই-পিঁপড়ে-মৌমাছির মধ্যেও এ যৌথজীবন-পদ্ধতি প্রত্যক্ষ করি। এমনকি সন্তান জন্মানোর ও লালনের জন্যে নীড় নির্মাণ করতে হয় বলে কাক-কবুতর-বক-বাবুই প্রভৃতি অনেক পাখির মধ্যেও সাময়িক দাম্পত্য বা যৌথজীবনাসক্তি দেখতে পাই। কোনো কোনো পশু-পাখির মধ্যেও সর্বগণমান্য দলপতি বা গোষ্ঠীপতি, তথা পরিচালক বা নেতা, অগ্রগামী খাদ্যসন্ধানী দল এবং রক্ষক প্রহরী ও রক্ষাবৃহের ব্যবস্থা দেখা যায়। সংগৃহীত খাদ্যবস্তু বাইরে সঞ্চয় করে রাখার সামৰ্থ্য নেই বলে ছানার জন্যে সংগৃহীত খাদ্য এরা উদরেই রাখে কিছুক্ষণ। গরিলা-শিম্পাঞ্জি-গিবনদের মধ্যেও রয়েছে দাম্পত্য। তা ছাড়া তোতা-কাক-শকুনহাঁস-শিয়াল-বানর-ভেড়া-শূকর-হাতি-বেবুন-গিবন-গরিলা-শিম্পাঞ্জি-ওরাঙউটাং প্রভৃতি বহু বহু প্ৰাণীও জ্ঞাতিত্ববোধে, যৌথজীবনে এবং একপ্রকারের সামাজিক দায়িত্ব পালনে অভ্যস্ত। কাজেই প্ৰাণী হিসেবে হয়তো আদি মানুষও যুথবদ্ধ হয়েই থাকত। তবে তার আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য ও মননশক্তি তার যৌথজীবনে উৎকর্ষ ও বিকাশ দান করেছে দ্রুত। যুথবদ্ধ থাকতে হলে নেতা ও নীতি ভাগে স্বীকৃতি দরকার, তার সঙ্গে আবশ্যিক সমস্বার্থে বা স্ব স্ব স্বার্থে সহিষ্ণুতা, সহাবস্থান ও সহযোগিতার স্থায়ী অঙ্গীকার। যৌথজীবন এ না। হলে চলতেই পারে না। এ বোধ থেকেই পালনীয় ও বর্জনীয় নিয়মনীতিস্বরূপ আইন এবং প্রয়োগকারী সংস্থা সরকারের ক্রমোদ্ভব। তাই আমরা আদিমানুষে পাই দৃঢ় ক্ল্যানচেতনা, তা থেকে ক্ৰমান্বয়ে ফ্রাটি, ময়াটি ও ট্রাইব। এই ট্রাইব বা গোত্রীয় জীবন বন্য, বর্বর ও ভব্য জীবনে দীর্ঘকাল স্থায়ী ছিল। তারপর সর্বপ্ৰাণ-টোটেম-টেবু-জাদু-প্যাগান তত্ত্ব-চেতনার ক্রমোন্নতিতে যখন বিবর্তিত বা প্রবর্তিত শাস্ত্রীয় ধর্মে উত্তরণ ঘটল, তখন সহ ও সম-মতবাদীর দল বা সম্প্রদায় গড়ে উঠল। এভাবেই পরে কালপ্রবাহে অগ্রসর মানুষের পরিচয় দেশ-গোত্র-জািত-বর্ণ-ধর্ম-বৃত্তি-শ্রেণী-সম্পদভিত্তিক হয়ে দাঁড়াল। অনগ্রসর বুনো ও বিচ্ছিন্ন মানুষ আজও ক্ল্যান-ফ্রাটি ময়াটি-ট্রাইব স্তরে আটকে রয়েছে। কিন্তু আজকের অগ্রসর মানুষেও কিন্তু সেই কওম-চেতনা মুছে যায় নি, আদিরূপে কিংবা বিবর্তিত রূপে তা ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তিক কিংবা সামাজিক আচরণে কখনো কখনো প্ৰকটি হয়েই প্ৰকাশ পায়।
জীবনচর্যার উৎস প্রতিবেশ-প্রভাবিত জীবিকা হলেও হাতিয়ার ও নৈপুণ্যের বিবর্তনধারায় তা জটিল পথে মুখ্য-গৌণ, প্ৰত্যক্ষ-পরোক্ষ হয়ে পড়ায় কারণ-ক্রিয়ায় বোধসূত্র লোকস্মৃতিতে গেছে হারিয়ে। তাই অনেক আচার-সংস্কারই হয়ে পড়েছে আপাত নিরুদ্দিষ্ট ও তাৎপৰ্যহীন। ফলে সম্পর্ক-স্বরূপ নিৰ্ণয় হয়েছে দুঃসাধ্য। যেমন নাচ-গান–চিত্ৰ—এগুলো ছিল আদিতে শিকার-সাফল্যের, অনুকূল রোদ-বৃষ্টি আবহসৃষ্টির ও বিপদমুক্তির প্রাকৃত বা দৈবিক আবহসৃষ্টির বাঞ্ছাপ্রসূত উদ্ভাবন। এখন নাচ-গান-চিত্র আমাদের মানসিক-নান্দনিক বিলাসক্রিয়া মাত্র।