বিদেশের কথা বলে কাজ নেই। দেশেই রয়েছে এর বহু নজির। গত একশ বছরের মধ্যে আমাদের সাহিত্যে লেখক-পাঠকে যে-কয়বার দ্বন্দ্ব ঘটে গেছে, তাদের উল্লেখ মাত্রই এক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে।
মধুসূদন বড় ভরসায় বড় মুখ করে বলেছিলেন a real graduate তার মেঘনাদবধের টীকা লিখছেন। সে real graduate হেমচন্দ্রও অমিত্রাক্ষর ছন্দের গোড়ার কথাই বুঝতে পারেননি। মেঘনাদবধ বা অমিত্রাক্ষর ছন্দের কোনো কদরই হয়নি উনিশ শতকে। মধুসূদনের প্রতিভা ও সৃষ্টি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধাও অর্জন করেনি কোনোদিন। মধুসূদনের ঠাই হল না। হেমচন্দ্র হলেন জাতীয় কবি, শ্রেষ্ঠ কবি, মহাকবি।
বঙ্কিমচন্দ্রের অশুদ্ধ ভাষা ও অশ্লীল উপাখ্যান সে-যুগে কী অবজ্ঞাই না লাভ করেছে! গুরুজনের নামে স্বরচিত উপন্যাস উৎসর্গ করে নীতবাগীশদের নিন্দা শুনতে হয়েছে তাকে।
সে যুগের আমেরিকা-ফেরৎ, বি-এ পাশ, ডেপুটি, কবি-নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্রনাথের কবিতার মাথা-মুণ্ড বুঝতে না পেরে বলেছেন অর্থহীন। প্রেমের অশ্লীল কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথ দেশের লোকের চরিত্র নাশ করছেন বলে অভিযোগ করেছিলেন তিনি। কালীপ্রসন্ন ঘোষ প্রভৃতি যদি তাঁর কবিতা দুর্বোধ্য বলে থাকেন তবে বিস্মিত হবার কিছু থাকে না।
এমন যে বিহারীলাল, তিনিও জীবকালে পাত্তা পাননি। আর কার কথা বলব? শরৎচন্দ্র নজরুলের উপর এককালে যে ঝড়ঝাপ্টা গেছে, তা অনেকেরই স্মরণে আছে। কল্লোল যুগের বহুনিন্দিত গল্প-লিখিয়েরা চোখের সামনেই ভক্ত-হৃদয়ের পূজো পাচ্ছেন।
নতুন সৃষ্টি বা উদ্ভাবন মাত্রেই প্রতিভার দান। ইচ্ছে করলেই কেউ নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। দুনিয়াতে স্তরে স্তরে কোটি কোটি মানুষ এসেছে, গেছে। নতুন সৃষ্টি বা উদ্ভাবন করতে পেরেছে কয়জনে? ব্যবহারিক জীবনের প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্রব্য-সামগ্রীই হোক, রান্নাবান্নার কলাকৌশলই হোক, সমাজে-ধর্মে-রাষ্ট্রে বা আচার-আচরণেই হোক, নতুন উদ্ভাবন সহজ কথা নয়। এতে বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ সৃষ্টিশীল নয়, সৃষ্টি-পরিকল্পনা তাদের মধ্যে নেই। অবচেতন মনে সৃজনের কোনো প্রেরণা সুপ্ত যদিও বা থাকে, তা অনুকরণ স্পৃহাতেই রূপ নেয় এবং সার্থকতা খোঁজে।
মানুষের পুরোনোর প্রতি যত প্রীতি আছে, নতুনের প্রতি তত শ্রদ্ধা নেই। তাই সাধারণ মানুষ ঐতিহ্যপ্রিয়, প্রাচীনপন্থী ও রক্ষণশীল। তাদের পুরোনোর প্রতি যেমন মমতা ও শ্রদ্ধা থাকে, নতুনের প্রতি তেমনি থাকে ভীতি, বিরূপতা আর অবজ্ঞা। মানুষ যতটা পশ্চাত্মখী, সে পরিমাণে সম্মুখদৃষ্টিসম্পন্ন নয়। তাই ইতিহাসের সাক্ষ্য সত্ত্বেও মানুষ চিরকাল নতুনকে অভিনন্দিত না করে পুরাতনকে বন্দনা করেছে। ইতিহাস আমাদের বলেছে–কোনো নতুনই মানুষের অকল্যাণের জন্যে আসে না। অন্তত তা যে মানুষেরই অগ্রগতির নিশ্চিত ফল এবং ফেলে আসা দিনের চেয়ে যে না আসা দিনগুলোতে মানুষের বোধবুদ্ধির বেশি বিকাশ হবে–কেননা সামগ্রিকভাবে মানুষ প্রতিমুহূর্তেই উন্নত হচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে, রুচি-বুদ্ধি-বোধির বিকাশ হচ্ছে–তা ইতিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তবু আমাদের চৈতন্য হয় না। আমরা চিরকাল এ ব্যাপারে অর্থাৎ নতুন পুরাতনের দ্বন্দ্বে নির্বিচারে পুরাতনের পক্ষই সমর্থন করেছি। তবু কোনোদিন রোধ করা যায়নি নতুনের প্রতিষ্ঠা।
এতে দুটো তত্ত্ব পাওয়া যাচ্ছে। এক. বোঝা যাচ্ছে নতুনের উদ্ভাবক সাধারণ মানুষের তুলনায় কত অসাধারণ। আর এজন্যেই সাধারণের পক্ষে সমকালীন প্রতিভার মূল্যায়ন ও মর্যাদা দান সম্ভব হয় না। তাদের চোখে সে বিদ্রোহী। দুই. মানুষের পশ্চাৎমুখিতা ও নতুনের প্রতি অশ্রদ্ধা এতই প্রবল যে এ ব্যাপারে তাদের বিচারশক্তি লোপ পায়, চোখ থেকেও তারা দৃষ্টিহীন। একটা অন্ধ সংস্কার-নির্ভর আবেগই তাদের একমাত্র অবলম্বন–যুক্তি-বুদ্ধি নয়।
শুধু সাহিত্য ব্যাপারেই নয়, ধর্ম ও রাষ্ট্র বিষয়েও তাই। রাজনীতিতে নেতৃত্ব মানার বা সামাজিক কাজে কর্তৃত্ব স্বীকার করার ব্যাপারে তাই অনেক সময়–যুক্তি নয়–অভিমানই দেয় বাধা। এ ব্যাপারে বয়োজ্যেষ্ঠের অভিমান আর মর্যাদাবোধও অনেকাংশে দায়ী।
.
০২.
যেখানে অজ্ঞতা, সেখানেই কল্পনার প্রশ্রয়। বিস্ময়ের উৎস এবং আশ্রয়ও তা-ই! আর যেখানে কল্পনা ও বিস্ময় সেখানেই উচ্ছ্বাস। বলা যায়, উচ্ছ্বাস ও কল্পনা বিস্ময়-বোধেরই সন্তান। অতিভাষণ উচ্ছ্বাসের নিত্যকালের সঙ্গী। এবার ভারতচন্দ্রের উক্তি স্মরণ করুন : সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর। ফল দাঁড়াল এই–লোকে দৈত্য, রাক্ষস, যক্ষ, ড্রাগন, পঙ্খিরাজঘোড়া, দেবলোক, জীন, পরী, গন্ধর্ব প্রভৃতি যেমন মনোরাজ্যে সৃষ্টি করেছে, তেমনি করেছে চন্দ্রে-সূর্যে-মেঘে-সমুদ্রে ব্যক্তিত্ব আরোপ। আমাদের রূপকথায়, উপকথায়, ইতিবৃত্তে, মহাকাব্যে, ধর্মশাস্ত্রে ও রোমান্সে তাই আদি মধ্যযুগে এর ছড়াছড়ি দেখতে পাচ্ছি। মধ্যযুগ আমরা বিশেষ অর্থে প্রয়োগ করছি, কেননা মধ্যযুগ সবদেশে ও সবজাতে সমকালীন নয়–এর শুরু ও শেষ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মানের উপর নির্ভরশীল।
মানুষের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিকাশ হল মানুষের বুদ্ধি ও বোধের। এর ফলে মানুষের মনে যুক্তিবাদের জন্ম হল। জন্ম হল বললে ভুল বলা হয়; বরং বলা যেতে পারে সুপ্তি থেকে জেগে উঠে বিশ্বাস-সংস্কারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হল, কেননা যুক্তিবাদই মনুষ্যত্ব। যুক্তিবিজ্ঞানের ভাষায় মানুষের differentia হল যুক্তি-বুদ্ধি। বহুকাল চলল কেহ কারে নাহি। জিনে সমানে সমান অবস্থায়। অবশেষে বিজ্ঞান এসে সব তত্ত্ব ও কল্পনার, বিশ্বাস ও সংস্কারের গোড়ার কথা বেফাঁস করে দিল। আমরা দেখলাম সূর্য বামুন হয়ে মর্ত্যে নামতে পারে না; চাঁদ সুন্দরও নয়, প্রণয়ীও নয়। রাক্ষস, ড্রাগন, যক্ষ, দৈত্য দুনিয়ায় কোনোকালে ছিল না। সূর্য অস্তও যায় না, আবিরও ছড়ায় না। অরুণে-কমলে সখ্য নেই। চাঁদে-চকোরে প্রেম নেই, মেঘ বাম্পপুঞ্জ মাত্র ইন্দ্র-ঐরাবতের সঙ্গে তার সম্পর্কমাত্র নেই, বজ্র শয়তানও তাড়ায় না, দৈত্যও খেদায় না, বৃত্রকেও মারে না! এভাবে আমাদের কল্পনার তাসের ঘর ভেঙে পড়ল, স্বপ্নসৌধ জাদু-সৃষ্ট বস্তুর মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আমরা–অজ্ঞরা অবাক হয়ে ভাবলাম–এসবের বিরুদ্ধে হাজারো বছর কাটিয়া গিয়াছে কেহ তো কহেনি কথা! আজ একি কথা শুনি–নেই! নেই, সত্যি কিছুই নেই–এ কারণে নাস্তিকের উল্লাসে, বন্ধন-মুক্তির স্বস্তিতে, মুক্তির আশ্বাসে, ভবিষ্যৎ নিশ্চিন্ততার আনন্দে, প্রসারিত জীবনের মুখরতায় মানুষ স্বচ্ছন্দ ও উচ্ছল হয়ে উঠল।