শহরগুলোর বস্তিবাসীরা অশিক্ষা-অজ্ঞতা-অক্ষমতার দরুণ জীবনযুদ্ধে ঘায়েল হয়ে হয়ে ক্রমে উচ্ছন্ন যাচ্ছে। খাওয়া-পরার সংগ্রাম তীব্র ও দুর্বিষহ হচ্ছে আর মাথা গুঁজবার ঠাই ক্রমেই দুর্লভ হয়ে উঠছে। অপঘাতে অপমৃত্যুর হাত থেকে এদের বাঁচবার ইস বাতলে দিতে হবে সাহিত্যের মাধ্যমে। অন্তত শহর ছেড়ে শহরতলীতেও যেন বাঁচবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে তারা, তেমন-পথের সন্ধান দিতে হবে তাদেরকে।
এদেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত কৃষিজীবী ও মজুর। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং কলকারখানা হওয়ার সাথে সাথে জীবন ধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর অভাবে যে-অনটন-সমস্যা এ যুগে দেখা দিয়েছে, তার সমাধানের চাবিকাঠি এদের হাতে নেই। অদৃষ্টবাদের জাদুমন্ত্রের প্রভাবে ওরা স্রষ্টা বা সমাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ-অনুযোগ করতেও ভুলে গেছে, দুঃখের দিনে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেও ভয় পায়–পাছে খোদা আরও রুষ্ট হন। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা ওদের পক্ষ হয়ে ধনবৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাচ্ছে। কিন্তু ওরা নিজেরা অদৃষ্টবাদী ও জড়ধর্মী। তাদেরকে আত্মসচেতন করে তুলতে হলে শিক্ষার মাধ্যমে তাদের প্রাণে প্রেরণা যোগাতে হবে আত্মমর্যাদার ও অধিকারবোধের। আজ তাদের জীবনে প্রেম পলাতক না হলেও স্বস্তি পলাতক। বুভুক্ষু, নিরন্ন, রোগগ্রস্ত লক্ষ লক্ষ আশাহীন, ভাষাহীন পল্লীবাসীকে বাঁচানোর ও সমাজ-কর্মীদের প্রাণে সহানুভূতি ও সাড়া জাগানোর দায়িত্ব সমাজেরই। এরূপে আমাদের দরদী শিক্ষিত জনসাধারণ রাষ্ট্রের মারফত ওদের দুঃখমোচনে সক্ষম হবে। শিক্ষার আলোকে, আত্মমর্যাদাবোধের তীব্রতায় ওরা তখন নিজেরাই বুঝে নেবে নিজেদের দাবী-দাওয়া। বহুকালের অনভ্যাসের ফলে আমাদের দেশের কিশোর ও তরুণেরা বন্দুক-ভীরু হয়ে পড়েছে। বীরত্ব ও দুঃসাহসিকতার ঐতিহাসিক বা কাল্পনিক চিত্র অঙ্কিত করে উদ্বুদ্ধ করতে হবে আমাদের কিশোর-তরুণদের। তাদের সাহস, চিত্তের দৃঢ়তা ও বুকের পাটা দেখে যেন ভয়ও ভয় পায়, ভেতো বাঙালির বদনাম ঘুচুক! পদ্মার দু-তীরে দুঃসাহসী পল্লীবাসী বর্ষাকালীন সর্বগ্রাসিনী পদ্মার প্রলয়-নাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যে টিকে রয়েছে যুগ যুগান্তর ধরে, তাদের বিচিত্র জীবন-কাহিনী আমাদের সাহিত্যের মূল্যবান উপাদান হতে পারে।
চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহের পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের সনাতন জীবনযাত্রা প্রণালী ও মনের গতি-প্রকৃতি আমাদের সাহিত্যে পরিবেশন করতে পারে বিচিত্ররস।
পাটচাষীদের পাটের বাজারদর সম্পর্কিত আশা-নিরাশার চিত্রও সাহিত্য-বস্তু। এ বছ। পাটের দরে না-জানি কেমন করে, ঘরে ঘরে হল ভাবনা। লক্ষ লক্ষ লোকের মরণ-বাঁচন যে পাটের বাজারমূল্যের উপর নির্ভরশীল, পাটচাষীর সে-সমস্যা ও আশা-নৈরাশ্য সাহিত্যে অধিক পরিমাণে রূপায়ণ বাঞ্ছনীয় বৈকী! মেঘনা, পদ্মা আর বঙ্গোপসাগরের জেলেদের ক্ষুদ্রতরী যোগে ঝড়ের রাতের দুঃসাহসিক অভিযানও মনোজ্ঞ সাহিত্যের উপাদান।
চট্টগ্রাম, সিলেট ও নোয়াখালীর নাবিকদের সমুদ্রযাত্রা, প্রবাস, দূরের পিপাসা, বর্মাপ্রবাসী চট্টগ্রামীদের বিচিত্র জীবন-কাহিনী রহস্য-মধুর রোমান্টিক সাহিত্যের উপাদান হতে পারে।
এছাড়া কলকারখানার মজুর, রিকশাওয়ালা, গাড়িওয়ালা, বিড়িওয়ালার জীবন তো রয়েছেই। তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণও সাহিত্যিকদের ব্রত হওয়া উচিত। নারীর শিক্ষা, অবাধ চলাফেরা ও চাকুরি গ্রহণ ব্যাপারে-বাহ্যত না হোক-যুগসঞ্চিত ধর্মীয়, সামাজিক ও নৈতিক সংস্কারবশত আমাদের, বিশেষ করে প্রবীণদের মনে একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। দেখাদেখি যুগরীতির কাছে ঘরে ঘরে সবাই আত্মসমর্পণ করছে সত্য, কিন্তু সমর্থন করে না অনেকেই; প্রতিরোেধ নেই বলে সমর্থন আছে মনে করবার কারণ নেই। এর সামাজিক ও নৈতিক ঝুঁকি এবং মানসিক দ্বন্দ্বেরও সুন্দর চিত্রাঙ্কন চলতে পারে।
মধ্যবিত্ত নামে পরিচিত হতভাগ্যদের কথা আগেই বলা হয়েছে।
মানুষের জীবনে সাহিত্যের উপাদানের অভাব কোনোদিনই হবে না। মানুষ যেমন আকৃতিতে বিচিত্র, তেমনি প্রকৃতি-প্রবৃত্তিতেও। মানুষের এই বিচিত্র জীবনলীলার কাহিনী কোনোদিন বলে শেষ করা যাবে না। তার উপর সৃষ্টি-স্রষ্টা, জগৎ-জীবন, প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির বিচিত্র সম্পর্ক সংযোগ তো আছেই–এসব রহস্য চির-নতুন সাহিত্যের চিরকালীন উপাদান।
আমরা ইট-সুরকির কথা আলোচনা করলাম, কিন্তু সৃষ্টির ব্যাপারে এদের গুরুত্ব বেশি নয়; স্ব স্ব রুচি ও সাধ্যানুসারে শিল্পীরা সাহিত্যসৌধ গড়ে তুলবেন; আকারে-প্রকারে, রূপে-রসে সে সব সৌধ হবে বহুধা ও বহু বিচিত্র। সৃষ্টির ব্যাপারে নির্দেশ চলে না। লেখকের মন-মানসের ধ্যানই স্রষ্টা। বাস্তব অভিজ্ঞতা, দেখবার চোখ, বুঝবার বুদ্ধি, অনুভব করবার হৃদয়, জিজ্ঞাসা, কৌতূহল, মানব-মনের রুচি, গতি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান, সামগ্রিক জীবনবোধ–সর্বোপরি রূপায়ণশক্তি সার্থক সাহিত্য সৃষ্টির জন্যে অপরিহার্য। এজন্যে সাধনা আবশ্যক।
কবিতার কথা
০১.
আজকে বলে নয়, নতুন আঙ্গিক ও মননের কবিতা নিয়ে দেশে দেশে সমকালীন পাঠক মহলে বিরূপতা দেখা দিয়েছে যুগে যুগে। এর প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা সেকালেও ছিল না, আজকেও নেই। শুধু কাব্যক্ষেত্রে নয়, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও নতুন ভাব, চিন্তা ও আঙ্গিকের শত্রু চিরকালই সংখ্যাগরিষ্ঠ।