এই ব্যাখ্যার আলোকে যাচাই করলে আমরা দেখতে পাই সাহিত্যে বাস্তব-অবাস্তব, প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় বা গণ-বুর্জোয়া বলে কোনো বিশিষ্ট ধারা নেই। তবে বস্তুভেদে অনুভূতিভেদ আছে। তা হচ্ছে নিতান্ত স্তরভেদ সুতরাং রূপগত নয় রসগত। শাকের স্বাদ মাছে নেই, আবার মাছের স্বাদ মাংসে অসম্ভব। তাই বলে শাক ও মাছে স্বাদ আছে, মাংসে নেই; অথবা মাছে বা মাংসে স্বাদ আছে, শাকে নেই–এমন কথা কোনোক্রমেই বলা চলে না। প্রত্যেকটাই বিশিষ্টরূপে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবু এদের মধ্যে স্তরভেদ আছে। তেমনি সাহিত্যেও বিষয়বস্তু অনুসারে স্তরভেদ আছে। আমি দেশী সাহিত্য থেকেই কয়েকটি উদাহরণ নিচ্ছি। যেমন জসীমউদ্দীনের কাব্যে রস আছে, তা পাঠকচিত্ত আকৃষ্ট করে। তাই বলে রবীন্দ্রনাথের বলাকার সঙ্গে তার তুলনা চলে না। তেমনি নজরুলের সাম্যবাদী আমাদের ভালো লাগে, কিন্তু এর সঙ্গে নক্সীকাঁথার মাঠের কোনো বিষয়গত ও ভাবগত ঐক্য নেই। তবু আমরা এই তিন প্রকারের কাব্যকেই স্বীকার করে নিয়েছি এবং এই তিন প্রকার রচনায় তিনটি স্তরও স্বীকার করেছি, কিন্তু রসহীন বলিনি। রসের তারতম্য দিয়ে উৎকর্ষ–অপকর্ষ বিচার চলে, কিন্তু অন্য নামে সাহিত্যকে বিচ্ছিন্ন করে চিহ্নিত করা চলে না।
আগেই বলেছি সৃষ্টি মাত্রেই কল্পনাধর্মী। কুলি-মজুরের কথাই লিখি, বা রাজপুত্র-রাক্ষসের গল্পই বলি, বসন্তের জয়গানই করি বা বর্ষার চিত্ৰই আঁকি–সবকিছুই মূলত অনুভূতিজাত ভাবেরই অভিব্যক্তি; বাস্তবের প্রতিকৃতি নয়। তবে অনুকৃতি বটে; তা রাক্ষসের গল্পও বাস্তবের অনুকৃতি বই তো নয়; কারণ পূর্বেই বলেছি-ইন্দ্রিয় বহির্ভূত কল্পনা অসম্ভব। এই অর্থে সাহিত্যে বাস্তবতা বলে কিছুই নেই এবং এই অর্থেই সাহিত্য মাত্রেই কল্পনা বা ভাব বা অনুভূতি আশ্রয়ী। এই কল্পনা, ভাব বা অনুভূতির বৈচিত্র্যানুসারে সাহিত্যে রসবৈচিত্র্য ঘটে। এই বৈচিত্র্য আসে স্রষ্টার জ্ঞান-প্রজ্ঞা, বোধ-বুদ্ধি, রুচি-প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির পার্থক্য থেকে। একই পরিবেশ বা প্রকৃতি থেকেও বিভিন্ন। মনোভঙ্গি গড়ে উঠতে পারে। তাই মন ও মননের পার্থক্যবশত সাহিত্যেও রসবৈচিত্র ঘটে, আদর্শ বৈচিত্র্যও এর আনুষঙ্গিক ফল। সুতরাং সৃষ্টি পরিকল্পনায় কোনো সচেতন প্রয়াস বিশেষ কার্যকর হয় না–মগ্নচৈতন্যের উপলব্ধি–যা অন্য অর্থে লেখকের জীবন-বোধ বা জীবন-চৈতন্য তা-ই রচনায় ব্যক্ত হয়ে পড়ে। অতএব গণসাহিত্য বা বুর্জোয়া সাহিত্য বলে আসলে কিছুই নেই। লেখক বিশেষের স্বকীয় মনোভঙ্গিরই অর্থাৎ রুচি-সংস্কারের রূপ-বৈচিত্র্য বিশেষ। লেখকের কলমের ডগায় যে বিশেষ সামাজিক ও রাষ্ট্রিক মত, পথ বা ধর্মীয় আদর্শ প্রকাশিত হয়, তা নিতান্ত আকস্মিক নয়। আকস্মিক নয় এইজন্যে যে, সেটা লেখকের উপরি পাওয়া জিনিস নয়–মর্মমূল নিঃসৃত সত্য বিশেষ। তথাপি তা সর্বজনগ্রাহ্য নাও হতে পারে, কারণ লেখক ও পাঠক নির্বিশেষের শিক্ষা, রুচি, সংস্কার ও পরিবেশ এক রকমের হয় না। যেমন আবর্জনা দেখলে আমাদের গা ঘিনঘিন করে, কিন্তু একজন মেথরের তেমন হয় না। একজন মুসলিম তরুণীর কাছে বৈধব্য তেমন বড় সমস্যা নয়, কিন্তু হিন্দু তরুণীর বৈধব্য মানে নিজেরও অপমৃত্যু। অতএব উপরোক্ত অবস্থায় উদ্ভূত দুই অনুভূতিতে রসবৈচিত্র্য অবশ্যম্ভাবী।
তারপর কোনো সাহিত্য বা অনুভূতি সর্বজনগ্রাহ্য হতে হলে তা জীবনের তথা হৃদয়ের গভীরতর বৃত্তি-প্রবৃত্তির সাথে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন অর্থাৎ তা দেশ, কাল ও পাত্রের ছাপবিহীন একটি সর্বজনীন রূপ লাভ করবে। যতক্ষণ তা সম্ভব না হচ্ছে, ততক্ষণ তা দেশ-কালের গণ্ডীর মধ্যেই থাকবে আবদ্ধ। যেমন পানি বলতে জগতে যেখানে যত পানি আছে সবগুলোকে বুঝায়। কিন্তু তবু ডোবর পানি, নদীর পানি, দীঘির পানি, পুষ্কণীর পানি বা সমুদ্রের পানি এক নয়। এদের কারো সব-পানির প্রতিনিধিত্ব করবার যোগ্যতা নেই, কারণ এগুলো আধারের ছাপ-মুক্ত নয়! কিন্তু distilled water-এর সঙ্গে সব পানির ঐক্য আছে। অর্থাৎ ঐ পানি নির্বিশেষ পানির প্রতিনিধিত্ব করবার যোগ্যতাসম্পন্ন–কারণ তা বিশেষ আধারের ছাপমুক্ত। সাহিত্য সম্পর্কেও এই নিয়ম। দেশ-কাল জাতি ও ধর্মের ছাপমুক্ত সর্বজনীন অনুভূতি বা ভাব যে-সাহিত্যে প্রকাশ পাবে তা হবে চির-মানবের সাহিত্য। অন্য প্রকারের সাহিত্য হবে বিশেষ দেশের, জাতির, কালের বা ধর্মসম্প্রদায়ের। আধুনিক সাহিত্যে Yeats, রবীন্দ্রনাথ, T.S. Elliot ও ইকবাল–এই চারজনই অধ্যাত্মবাদী। কিন্তু Yeats ও রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মবাদ জীবন-রহস্য উদঘাটনের প্রয়াসপ্রসূত। পক্ষান্তরে T.S. Elliot ও ইকবালের সাহিত্য বিশিষ্ট আদর্শের ছাপযুক্ত সেজন্যে তা নির্বিশেষ পাঠকের গ্রাহ্য নয়। সুতরাং T.S. Elliot ও ইকবাল বিশেষ দেশ-কাল ও জাতি-ধর্মের কবি ও শিক্ষক; আর Yeats ও রবীন্দ্রনাথ দেশ-জাত নিরপেক্ষ আস্তিক মানুষের কবি।
তারপর আসে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের কথা। এক হিসেবে সাহিত্য-মাত্রেই অপ্রয়োজনীয় এবং অবান্তর। কারণ সাহিত্য হচ্ছে মূলত মানুষের ভাবলব্ধ সত্য-অনুভূতি ব্যতিরেকে বাস্তবে তার প্রতিচ্ছবি পাওয়া অসম্ভব এবং সাহিত্য কোনো বাস্তব-প্রয়োজন প্রত্যক্ষভাবে সিদ্ধ করে না। আর এক হিসেবে সাহিত্য–মনুষ্য জীবনে অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য। যে-প্রেরণায়, যে-অব্যক্ত-প্রয়োজনে সাহিত্য সৃষ্টি হয়, সে-প্রয়োজন পরিহার করে চলা মানুষের পক্ষে তেমনি অসম্ভব। আমরা যে হোমার, ভার্জিল, দান্তে, মিল্টন, কালিদাস, ভবভূতি, ব্যাস, বাল্মীকি, ফেরদৌসী-রুমী-জামীকে স্মরণে রেখেছি, তাঁদের রচনা পড়ে চলেছি–তা-ই আমাদের প্রয়োজনের যথেষ্ট প্রমাণ নয় কী? পক্ষান্তরে অগ্নি যিনি আবিষ্কার করলেন, কয়লা যিনি যোগালেন, রেডিও-টেলিগ্রাফ-টেলিফোন টেলিভিশন যারা দান করলেন তাঁদের কেন আমরা স্মরণে রাখার গরজ বোধ করিনে! এতেই প্রমাণিত হয় এসবের ব্যবহারিক প্রয়োজন যেমনই হোক, তার সঙ্গে আমাদের অন্তর্জীবনের সম্পর্ক অকিঞ্চিৎকর; পক্ষান্তরে অন্তৰ্জীবন তথা আমাদের অনুভূতির জীবন যতই অবাস্তব মনে হোক, তা ই আমাদের জীবনসর্বস্ব। তবু তা শিল্প মাত্র! অন্য দশ শিল্পকর্মের মতো এ-ও আমাদের প্রয়াসপ্রসূত সুতরাং স্বতঃস্ফূর্ত নয়। সাহিত্যে বাস্তবতা ও কল্পরসবিলাস সম্বন্ধেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। কোনো বিষয়বস্তুই সাহিত্যে নিরর্থক নয়, কারণ যে-কোনো ব্যাপারে মানুষের অন্তর্নিহিত বৃত্তি-প্রবৃত্তির স্ফুরণ হয়। হৃদয়-সংযুক্ত বহির্জীবনের সমস্যার সমাধান-চিত্র যেমন মানুষকে জীবন পথে প্রেরণা দান করে, তেমনি রাক্ষস-রাজপুত্রের কাহিনীতেও মানুষের বৃত্তি-প্রবৃত্তি রূপায়িত হয়দুটোরই প্রয়োজন আছে। ফলত বুর্জোয়া ও গণসাহিত্য বলে সাহিত্যকে দ্বিধা- বিভক্ত করা নিরর্থক। কারণ আমরা বলেছি, মূলত মানুষের জীবন ভাবসর্বস্ব বা অনুভূতি-সমষ্টি মাত্র। কাজেই অনুভূতির জগতে স্ব স্ব স্বাভাবিক প্রবণতানুসারেই সাহিত্য সৃষ্টি হয় এবং মনোভঙ্গির পার্থক্যবশতই আমরা সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে ও রসে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় এবং বাস্তব ও অবাস্তবের সীমারেখা টানতে প্রয়াসী হই। আমাদের সাহিত্য সম্বন্ধে ধারণা ও মতগত অনৈক্যের মূলও এখানে। সাহিত্যে রস-সর্বস্বতা, জীবন-সর্বস্বতা, সমাজ-সর্বস্বতা, রাষ্ট্র-সর্বস্বতা বা প্রয়োজন-সর্বস্বতা বলে কিছুই নেই–যা আছে তা অনুভূতি ও উপলব্ধির সর্বস্বতা। এর প্রকারভেদেই আদর্শ, নীতি, রস ও বিষয় ভেদ ঘটে।