সাহিত্যেও তাই প্রধানত দুটো আপোষহীন নীতি ও আদর্শের সংঘাত দেখা দিয়েছে। একটা হচ্ছে বাস্তবতা, অপরটা কল্পনা সর্বস্বতা; একটা প্রয়োজনানুগ অপরটা রসবিলাস, একটা গণসাহিত্য অপরটা বুর্জোয়া সাহিত্য; একটি প্রগতিকামী অপরটি রস-লীলাপরায়ণ; একটা ধর্ম ও স্থানীয় বা জাতীয় সংস্কৃতির ধারক, বাহক ও প্রচারক অপরটা নৈর্ব্যক্তিক সংস্কৃতির ধূরক।
আমরা এই আলোচনার বিষয়টা খোলাসা করে বুঝে নেবার চেষ্টা করব মাত্র কোনো সমাধান পাবার আশা না রেখেই।
প্রথমত, সাহিত্য হচ্ছে অনুভূতির অভিব্যক্তি মাত্র। তা কাব্য হোক, নাটক হোক বা প্রবন্ধ হোক। অনভূতিসঞ্জাত যে-ভাব আমাদের মনে ও মাথায় (তথা হৃদয়ে) আলোড়ন জাগায়, তা-ই বাণীরূপ লাভ করে হয় সাহিত্য। অবশ্য আমাদের সবকথার মূলে ভাব থাকে এবং তার পশ্চাতে থাকে অনুভূতি অর্থাৎ সব প্রকারের ভাবের মূলে থাকে Cognition, Volition ও emotion বা feeling. তথাপি সব বাণীই আমরা যথাযথ সচেতনতা ও যত্নের সাথে প্রকাশ করিনে। সুতরাং যা-কিছু সযত্নে ও স্বচৈতন্যে প্রকাশ করি তা-ই আমাদের সাহিত্য। কারণ তখন আমাদের বাণী অন্য হৃদয়ে সঞ্চারিত হবার যোগ্যতাসম্পন্ন হয় অর্থাৎ তা বিশেষ অর্থে রসাত্মক হয়ে ওঠে। যত্ন ও প্রয়াসের সাথে শক্তি যোগ না হলে তা অপর হৃদয়ে অনুরূপ ভাব বা অনুভূতি সঞ্চারের সামর্থ্য পায় না, তাই সব রচনা সর্বজনগ্রাহ্য সাহিত্য হয় না। এখানে এ-কথা স্বীকার করা ভালো যে সব রচনাই পাঠকের উদ্দেশ্যে রচিত হয়।
দ্বিতীয়ত, অনুভূতি মাত্রেই ভাবের সত্য অর্থাৎ বিশেষ মনের বিশেষ অবস্থার সত্য। সে-সত্যের সাথে বহির্জীবনের সত্যের সামঞ্জস্য থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। যেমন আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, প্রাণ-সখা বন্ধু-হে আমার অথবা পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে পাগল আমার মন জেগে ওঠে। এসব হচ্ছে অনুভূতিজাত ভাবের সত্য–বাস্তবের সত্য নয়। তেমনি শরৎচন্দ্রের মহেশ বা রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার গল্পদ্বয়ে বর্ণিত অবস্থাও ভাবের সত্য। বাস্তবে কত গফুর, কত রতনকার খবর কে রাখে? কিন্তু লেখকের হৃদে-মনে-মাথায় এমনি অবস্থার অনুভূতি যে-ভাব-আন্দোলন সৃষ্টি করেছিল, তা-ই প্রকাশিত হয়েছে রচনায় এবং সে-রচনা সযত্নে ও স্বচৈতন্যে সম্ভব হয়েছে। শুধু বাস্তব নয়, শুধু কল্পনাও নয়; বাস্তবে-অবাস্তবে, সম্ভব-অসম্ভবে, জ্ঞান প্রজ্ঞা, বুদ্ধি-বোধি সমন্বয়ে সম্ভব হয়েছে এ সৃষ্টি। দার্শনিক তত্ত্বগুলো যেমন বাস্তব-নির্ভর হয়েও বাস্তব নয়–অনুভূতি ও প্রজ্ঞার সত্য; সাহিত্যও তেমনি অনুভূতি-উপলব্ধির সত্য, বাস্তব থেকে পাওয়া কিন্তু বাস্তব-সত্য নয়।
অতএব অনুভূতি বাস্তবাহৃত, বাস্তব-নির্ভর ও বাস্তবানুগ হয়েও তা বাস্তবাতিরিক্ত এবং কল্পনা নির্ভর হয়েও কল্পনা-সর্বস্ব নয়। মূলত তা জীবন-চেতনা-প্রসূত–প্রত্যক্ষভাবে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রচেতনা জাত নয়। কারণ, তা অনুভূতির জারক রসে রসায়িত হয়েই অভিব্যক্তি লাভ করে, তার আগে নয়।
তৃতীয়ত, মানুষের মন স্বভাবত ভাবগ্রাহী, বৃহত্তর অর্থে মানবজীবন ভাবসর্বস্ব। মানুষের সুখ দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, লাভ-ক্ষতি–সবকিছুই অনুভূতি মাত্র। অনুভব করি তো কোনো ঘটনা পর্বত প্রমাণ মনে হবে, আর অনুভব না করি তো তৃণবৎ তুচ্ছই থেকে যাবে। যেমন, শিশুটি উঠানে একপাত্র প্রয়োজনীয় পানি ফেলে দিলে আমার কোনো ক্ষয়-ক্ষতি নেই, তাই আমি নির্বিকার; কিন্তু যদি একপাত্র সদ্যকেনা দুধ ফেলে দেয় তখন? একটি বাঘ নিহত হলে মানুষ খুশি হয়, একজন মানুষের অপমৃত্যু হলে তখন? তখন যে-দুঃখ যে-ক্ষোভ আমি অনুভব করছি তা তো স্বতঃস্ফূর্ত নয়, তা হচ্ছে বিবেচনাপ্রসূত। মানুষের মনন ও অভিজ্ঞতার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের এই অনুভূতির জীবন বিস্তৃত হয়েছে। তাই বলে কোনো অনুভূতি বাহ্যবস্তু-নিরপেক্ষ নয়, বস্তুত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ থেকেই সব অনুভূতি আসে। কারণ যা স্কুল বা সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তার কল্পনাও সম্ভব নয়।
সুতরাং মানুষের সব কর্ম-চিন্তা ও কামনা-বাসনার মধ্যে জীবন-চৈতন্য রয়েছে। একটু ব্যাখ্যা করে বললে কথাটা এই দাঁড়ায় : চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক দ্বারা আমরা যথাক্রমে রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও স্পর্শ লাভ করি। এর ফলে আমাদের মনে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, প্রেম, স্নেহ, ভালোবাসা, আনন্দ, বেদনা, সুখ, দুঃখ প্রভৃতি হরেক রকম বোধ জন্মে। বস্তুত এইসব বোধ বা ভাব কিন্তু অনুভূতি বা ভাবরাশির সঙ্গে আমাদের জীবন-চৈতন্যের কোনো মূলগত পার্থক্য নেই। অন্য কথায় জীবন-চৈতন্য মানে দাঁড়ায় বাহ্যপরিবেশের সঙ্গে মনের গভীরতর যোগ চৈতন্য। এই ব্যাখা যদি মেনে নিই, তবে আমরা দেখতে পাই জীবনচৈতন্য ও সমাজচৈতন্য বলে আলাদা কিছুই নেই। ব্যবহারিক জীবনের অভাব-অভিযোগ, বাধাবিঘ্ন মানসলোকে অর্থাৎ আমাদের অনুভূতির জগতে কিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তার বিশিষ্ট রূপ যদি সাহিত্যে বিধৃত না হয়, তবে তা রসগ্রাহী তথা ভাবসর্বস্ব মনে ভাব বা অনুভূতি সঞ্চার করতে সমর্থ হবে না; এক কথায় বহিরোখিত ঘটনার সংঘাতে আমাদের বৃত্তি-প্রবৃত্তির প্রক্রিয়া কী বিচিত্র রূপ ধারণ করে, তা কার্যকারণপরম্পরায় চিত্রিত না হলে, সব সৃষ্টি-প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হতে বাধ্য।