মহৎ ও বৃহৎ আদর্শবিহীন, জীবাত্মা-পরমাত্মারহস্য পরাখুখ, পরলোক-বিভ্রান্তিবিমুক্ত জৈব জীবন-সর্বস্ব বস্তু-নির্ভর নাস্তিক্যাদর্শবাদীরা তাই একান্তভাবে ভোগ্যবস্তু লোলুপ। তাদের ধ্যানজ্ঞান আর কর্মভোগেচ্ছা পূরণেই নিয়োজিত। তাদের বুকে বিক্ষোভ, মুখে অভিযোগ, চোখে লোভ।
গাঁয়ে কোনো শক্তিমানের গরুতে যদি গরিব চাষীর ধান খেয়ে যায় তখন সে শক্তিমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের সাহস না পেয়ে বা প্রতিকারের উপায় না দেখে, গাঁয়ের আর দশজনের কাছেই আবেদন জানায়–আজ অমুকের গরুতে আমার ধান খেয়েছে, কাল তোমার ধান খাবে। পরশু অমুকের খাবে। অতএব, এস আমরা সবাই মিলে এর প্রতিকারের একটা ব্যবস্থা করি। আজকাল শহরে সংবাদপত্রের মাধ্যমে এমনিভাবেই সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলেরা লড়াই করে। এরমধ্যে কোনো মহৎ প্রেরণা নেই। স্ব স্ব স্বার্থে লোক নিতান্ত সহজাতবৃত্তিবশে একজোট হয় মাত্র। একই মামলার আসামিরা যেমন আত্মনিষ্কৃতির জন্যে একমুখো চেষ্টা চালায়।
আজকাল মানুষ দুটো শ্রেণীতে বিভক্ত–ভোগী ও ভোগেচ্ছ, ধনী ও গরিব, ভোগী ধনীরা সংখ্যায় কম, কিন্তু বিত্তে বড়। ভোগেন্দুরা সংখ্যায় অগুণতি। তারা সব একজোট হয়েছে। তাদের বক্তব্য এই–পৃথিবী ও পৃথিবীর ভোগ্যসামগ্রী প্রকৃতির দান, আমরাও প্রকৃতিসৃষ্ট। কাজেই এতে সবার সমান অধিকার রয়েছে, এ কারো বা কোনো দল-বিশেষের একচেটিয়া ভোগ্য হতে পারে না। ধনী, তুমি অট্টালিকায় আছ, রাজা তুমি প্রাসাদে রয়েছ; মধ্যবিত্ত, তুমি ভবনবাসী-আমরা এত গরিব-কাঙাল যখন কুটির আর গাছতলা সার করেছি, আর সবার জন্যে যখন অট্টালিকা ও প্রসাদের ব্যবস্থা করা যাবে না, তখন তোমরাও প্রাসাদ-অট্টালিকা-ভবন থেকে নেমে এস, আমরাও গাছতলা থেকে উঠে যাই। সবার জন্যে সমবিত্ত ও সম-ভাগের ব্যবস্থা হয়ে যাক। সুখে থাকি আর দুঃখে পড়ি তাতে আর ক্ষোভ বা ঈর্ষা থাকবে না। তোমাদের ভোগ দেখে আমাদের ঈর্ষা জাগে, তোমাদের বিত্ত দেখে আমাদের মনে ক্ষোভের উদয় হয়, তোমাদের ঐশ্বর্যে আমাদের লালসা বাড়ে। ভোগেছু বিক্ষুব্ধ দলবদ্ধ বঞ্চিত জনগণ মহৎ-নামের আবরণে এ মনোবৃত্তিকেই মহিমময় করে তুলে ধরেছে। মানবতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, জীবনবাদ প্রভৃতি বুলির আবরণে ও আভরণে এমনি এক নগ্ন অসঙ্গত অথচ যৌক্তিক বাসনার দাবী পেশ করেছে। এ মনের অভিব্যক্তি যে-সাহিত্যে লাভ করেছে, তার নাম গণসাহিত্য। মানবতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, গণজীবনে শ্রদ্ধা ও দরদ, প্রচলিত সমাজ ধর্ম ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় অবজ্ঞা, বিত্তশালীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ এসব সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। বাস্তবে জীবনায়ণের গৌরবে মানবতার বাণী প্রচারের দম্ভে, জীবন ও জীবিকার অভিন্ন স্বরূপ উঘাটন-গর্বে, জগৎ ও জীবনের যথার্থ সূত্র আবিষ্কার ও অকৃত্রিম সংজ্ঞা প্রয়োগ-গৌরবে এ সাহিত্য আজ বিশ্বনন্দিত ও গণবন্দিত। এ সাহিত্যের মহান আদর্শ হচ্ছে-মানুষের জন্যে, জীবন-জীবিকার জন্যে, মানবতাবোধ প্রসারের জন্যে, মানবকল্যাণের জন্যে, সমাজ-উন্নয়নের জন্যেই সাহিত্য। মূলত ঈর্ষা, ভোগেচ্ছা, বঞ্চিত বুকের বিক্ষোভ ও অভিযোগ সম্বলিত এ সাহিত্যও রোমান্টিক। এ রোমান্টিকতা আকাশচারী নয়–ভূমি-নির্ভর, কল্পনাসর্বস্ব নয়-ক্লেদাক্ত কামনাপুষ্ট বাস্তব। জীবনভিত্তিক। মহিমময় বুলির আবরণে এরই জয়গানে আমরা মুখর।
মানুষের সাহিত্য মানুষের মন-মননেরই প্রতিচ্ছবি–মানুষের আন্তর্জীবনেরই বাগ-বন্ধ রূপ। এ অর্থে সাহিত্য চিরদিনই বাস্তব-জীবন ও বাস্তববোধ-ভিত্তিক। কাজেই সাহিত্য কোনোকালে। কৃত্রিম অবাস্তব অলৌকিক ছিল না। মানুষের জীবনবোধ যে-যুগে যেমনটি ছিল, সাহিত্যে তেমনটিই বিবৃত হয়েছে।
সাহিত্যের স্বরূপ
সাহিত্যের রূপ ও আদর্শ সম্বন্ধে আজকালকার লোকের প্রশ্ন ও গবেষণার অন্ত নেই। কিন্তু চিরকাল এমনটি ছিল না। পড়তে শুনতে বা ভাবতে ভালো লাগলেই আগেরকার দিনে যে-কোনো রচনাকেই নির্বিচারে সাহিত্য বলে গ্রহণ করা হত। আজকের যুগে মানুষ বড় সচেতন, অত্যন্ত হিসেবী। তারা লাভ-ক্ষতির তৌলে সবকিছুর মূল্য ও সারবত্তা যাচাই করতে চান। ফল দাঁড়িয়েছে এই যে যা-কিছু মানুষের ব্যবহারিক জীবনে অপ্রয়োজনীয় বোধ হয়, তা-ই সাহিত্য থেকে নির্বাসিত করাই বিধেয় বলে ফতোয়া জারি হচ্ছে। মনোজীবন বলে ব্যবহারিক জীবন-নিরপেক্ষ কোনো জীবনের অস্তিত্ব স্বীকার করা তাদের যুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানমুখী মন ও মননে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তার কারণও রয়েছে যথেষ্ট। আজকের দিনে ব্যবহারিক জীবন-সমস্যা এমন উকটভাবে দেখা দিয়েছে যে নিতান্ত বেঁচে থাকার সাধনা অন্য সর্বপ্রকার জৈব-সাধনাকে ছাপিয়ে উঠেছে। বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়া, কলকারখানার স্থাপন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এবং যন্ত্রশক্তির বদৌলত বিশাল পৃথিবীর বিশালতা ও বৈচিত্র্য ঘুচে গিয়ে পৃথিবী হয়ে গিয়েছে ক্ষুদ্র ও একাকার। জীবন ধারণের প্রয়োজনানুরূপ সামগ্রীর অভাবে পারস্পরিক হানাহানি কাড়াকাড়ি লেগেই আছে। মূলত সবদেশের সবলোকের সংগ্রামের রূপ একই–তা হচ্ছে জীবন-সংগ্রাম, বেঁচে থাকবার আকুল আগ্রহে-ই তাঁদের চিত্ত হয়ে উঠছে বিদ্বিষ্ট ও হিংস্র। এই সমস্যা-বিমূঢ় সমাধান-কাতর জগতে তাই জাগতিক ও জৈবিক সর্বব্যাপারে সৃষ্টি হয়েছে নানা মত ও পথ। এমনি অবস্থায় কারো দৃষ্টি স্বচ্ছ থাকার কথা নয়। নির্লিপ্ত আর অনাচ্ছন্ন। বিবেক ও চিন্তাপ্রসূত নয় বলেই বিভিন্ন মত ও পথগুলো দেখা দিয়েছে পরস্পরের মারাত্মক। প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে। স্বার্থপ্রসূত এই বিভিন্ন আদর্শগুলোর সমন্বয় সাধন তাই একরূপ অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সমস্যারও সমাধান হচ্ছে না।