মানুষ যা জানে না, যা বোঝে না, যা রহস্যাবৃত, যা অচেনা; তাকে জানবার, বুঝবার ও আয়ত্ত করবার এক উদ্দাম বাসনা, এক অসহ্য ব্যাকুলতা বোধ করে। মন দিয়ে, কল্পনা দিয়ে, বুদ্ধির সাহায্যে, বোধির প্রয়োগে, চিন্তার মাধ্যমে তার একটা যুক্তিসহ বা বুদ্ধিগ্রাহ্য সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা না দিয়ে সে স্বস্তি পায় না। এভাবে সে বাহ্যজগতের সবকিছুর একটি সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দিয়ে আত্মপ্রবোধ পেয়েছিল। লাভ করেছিল আত্মপ্রসাদ।
এমনি করে মানুষ সেদিন কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করেছিল। তাতে ছিল পঙ্খিরাজ ঘোড়া, বিচিত্র হাত-পা-মাথা-মুখ-চোখ-কানওয়ালা দেব-দৈত্য-পরী-জীন রাক্ষস-ড্রাগন। কল্পলোকের এসব জীবের কল্পিত রোমাঞ্চকর জীবনোপখ্যানই ছিল সেদিন মানুষের মনের রস-পিপাসা–মনের ক্ষুধা মিটাবার অবলম্বন। এ মনের প্রতিফলন দেখি রূপকথায়। রূপকথা সে যুগের জীবন্তিকা। রূপকথার জন্ম হল এভাবেই। কথায় বলে–অদারু দারু হয় শিলে পিষিলে। অকথা কথা হয় লোকে। ঘোষিলে। ফলে রূপকথাই যুগান্তরে হয়ে দাঁড়াল মানুষের অতি-শোনা প্রতিবেশী রাজ্যের সত্য কাহিনী। মাটির গড়া রক্তমাংসের মানুষের বাস্তবজীবনে প্রতিবেশীর প্রভাবের মতো সে প্রভাব পড়ল মানুষের মনে-মানসে আর ব্যবহারিক জীবনে। এসব কল্পলোকবাসী মানুষের ব্যবহারিক জীবনের গরজে কল্পিত হয় দুইরূপে-অরি ও মিত্ররূপে। দেবতারা শক্তিমান অতি-মানুষ ও মানুষের সহায়রূপে কীর্তিত; আর সব দেব-মানবের শত্রুরূপে কল্পিত। এদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক সগ্রামে দেব-মানব পরস্পরের সহায়ক। বর্বরতম মানুষের শৈশব অতিক্রান্ত হল এভাবে। মানুষের জীবনবোধের কিছুটা প্রসার হল। হতে থাকল জ্ঞানপ্রজ্ঞা-বোধির উন্মেষ। পূর্বের কল্পনালব্ধ ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হয়ে চলল। বিকশিত বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানবমনে জেগে উঠল নতুনতর পিপাসা। জীবন পরিধি হল কিছুটা প্রসারিত। বাহুবলে বলীয়ান মানুষের মনের ক্ষেত্র হল বিস্তৃত। আবার যেখানে অজ্ঞতা সেখানেই মানুষের ভয়, সেখানে মানুষ অসহায়। তাই সৃষ্টির আদিতে মানুষ ভয় করেছে মাটির দূর্বা থেকে আকাশের নক্ষত্র অবধি সবাইকে।
জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞান উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অর্জন করেছে আত্মবিশ্বাস, আত্মশক্তি। কল্পনা ও ভাবপ্রবণতা হয়েছে পরিমিত, কাঁচা মন হয়েছে পাকা। সে বিশেষ মানুষ। ইতরের চাইতে জীবনে তার চাহিদা বেশি, সে দেহে শক্তিমান, কৌশলে কুলীন আর মনে উচ্চাভিলাষী। শিশুমানুষের–পশুমানুষের মন এভাবে একটু একটু করে ক্রমে জেগে উঠেছে। বিস্ময়বিমূঢ় মনে, শঙ্কাকাতর মনে, কল্পনাপ্রবণ মনে, আত্মপ্রত্যয়হীন মনে, ত্রাসদলিত মনে অঙ্কুরিত হয় কামনা–সে কামনা ভোগের, আত্মপ্রসারের-পরাক্রান্ত মনের। উচ্চাভিলাষী শক্তিবিলাসী মনে সাড়া দিয়ে নড়ে উঠল অজ্ঞাতপূর্ব দুটো লোভ-জমির আর জরুর। যেমন-তেমন জমি নয়–রাজ্য, আর যে-সে কন্যা নয়–সুন্দরীতম ডানাকাটা পরী। দুটোই দুর্লভ। তাই শুরু হল অভিযান, বেধে গেল সগ্রাম, দেখা দিল পদে পদে সংঘাত। এ অভিযানে দেবতা হল মানুষের সহায়, আর দেও-জিন-রাক্ষস দাঁড়াল পথরোধ করে। মানুষের মধ্যে এ উচ্চাভিলাষী সগ্রামী দলে রয়েছে শক্তিমান ও বুদ্ধিমান রাজকুমার, মন্ত্রীপুতুর, সদাগর আর কোটাল। এভাবে কল্পলোকের সঙ্গে যুক্ত হল ইহলোক। কল্পরাজ্যে-মনোরাজ্যে ঘটল মিতালি, স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত হল জৈব-কামনা। জীবন পরিব্যাপ্ত হল জীবনের লোকে। দেব-মানবে জীবনে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। এবার রূপকথা নয়, কল্পনোক নয়, আবার তাকে বাদ দিয়েও নয়। এবার প্রবুদ্ধ জীবনের জয়যাত্রা–আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রসার স্পৃহার মূর্তস্বরূপ। এ-যুগ রোমন্সের যুগ। সভ্যতার ইতিহাসে মহাকাব্যের যুগ।–ইলিয়াড-ওডেসী আর রামায়ণ-মহাভারতে বিধৃত রয়েছে তার স্বরূপ। এ থেকে মনুষ্যসমাজেও সৃষ্টি হল শ্রেণী–তুচ্ছ ও উচ্চ মানবশ্রেণী। উচ্চমানুষের আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রসার দেখে সেদিন তুচ্ছ মানুষ ঈর্ষা করেনি বরং স্বাজাত্যবোধে সে উল্লসিতই হয়েছিল মানুষের জয়যাত্রায়। নির্বোধ তুচ্ছ মানুষ সেদিন আত্মভোলা হয়ে স্বজাতির প্রগতিতে আত্মপ্রসাদই লাভ করেছিল, উপভোগ করেছিল পরমানন্দ। এভাবে মনুষ্যজীবনে সার্থক হয়ে উঠল স্বপ্ন ও সত্য, কল্পনা ও মনন, মাটি ও আকাশ, আর জীবন ও জিজ্ঞাসা। বাস্তবজীবনই ব্যাপ্ত হল স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে। এ ত্রয়ীর পটভূমিকায় সংঘাতে-ঈর্ষায় বিদ্বেষে ও প্রীতি-অনুকম্পায় দেব-দৈত্য-নর রইল পরস্পরের প্রতিবেশী হয়ে।
এ যুগটি মানুষের জীবনে তথা ইতিহাসে দীর্ঘতম স্থায়ী স্তর। মনুষ্যজাতির কোনো কোনো সম্প্রদায়ে আজো এর পূর্ণ ও প্রবল জের চলছে। এক সমাজেও প্রতিবেশ ও শিক্ষাগত কারণে সব মানুষ একই স্তরে উন্নীত হতে পারে না। তাই আলো-আঁধারি, কায়া-ছায়া, কল্পনা-বাস্তব, জ্ঞান অজ্ঞান, বোধি-প্রজ্ঞা, ভাব-প্রবণতা, ভয়-ভাবনা, চেতনা-অবচেতনা, শঙ্কা-কৌতুক, বিস্ময়-জিজ্ঞাসা মিশ্রিত বহু বিচিত্র এ জীবনলীলার মোহ কোনো ছলেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না মানুষ। যতই ভাবে, যতই দেখে, ততই রহস্যের মায়াজালে আত্মসমর্পণ করে আত্মসমাহিত হতে চায়, গদগদ কণ্ঠে বিমুগ্ধ ও অতৃপ্ত চিত্তের বাণী ধ্বনিত হয়ে উঠে একটি কথায়–আহা! কিংবা একটি উচ্ছ্বসিত নিশ্বাসে। এ যুগে মানবজাতি সাংস্কৃতিক মানানুসারে নানা স্তরে বিভক্ত রয়েছে। আমরা এর সবচেয়ে প্রগতিশীল সম্প্রদায়কেই আমাদের বক্তব্যের অবলম্বন করব।