আমাদের মনে রাখতে হবে সাহিত্য শুধু জনচিত্তের বিশ্লেষণ করবে না, প্রচলিত সমাজ-চিত্র দেবে না, সমাজকে নিয়ন্ত্রিতও করবে, দিশাও দেবে পরোক্ষভাবে, প্রভাবিত করবে অতি সন্তর্পণে। কিন্তু তাই বলে উগ্র ও প্রত্যক্ষ আদর্শবাদ থাকবে না। এটুকু আদর্শবাদ ও রোমান্টিকতা প্রচ্ছন্ন না থাকলে, সাহিত্যের উদ্দেশ্যই যাবে ব্যর্থ হয়ে। কেননা শুধু বাস্তব দিয়ে চিত্র হতে পারে, শিল্প হবে না। রচনায় শিল্পীর মনের রঙ-রস ও চিন্তা মেশাতেই হবে। কিন্তু কোনো আদর্শবাদই জৈবধর্ম বা প্রাণধর্ম বা পরিবেশের প্রতিকূল হলে চলবে না। তথাপি এ-যুগে লেখকদের হতে হবে জীবন শিল্পী। আদর্শবাদ থাকবে প্রচ্ছন্ন। মহৎ সৃষ্টির এ-ই লক্ষণ।
এ যুগের গল্প-উপন্যাসের পটভূমি বিশাল–গোটা দুনিয়া। জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা, স্বাদেশিকতা ও বিশ্বমানবতা এ যুগে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কেননা, যদিও স্বাজাত্যবোধ হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিজীবনে বল-ভরসার আকর, আত্মকল্যাণই এর লক্ষ্য; কিন্তু তবু কল্যাণ আপেক্ষিক শব্দ। অপরের অকল্যাণ করে নিজের হিতসাধন হয় না। ব্যক্তিস্বার্থ নিৰ্দ্ধন্দু ও নির্বিঘ্ন করতে হলে, পরিবার-পরিজনেরও বৃহত্তর স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। তেমনি পরিবারের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যেই সামাজিক স্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন থাকা চাই। সামাজিক কল্যাণ সাধনের খাতিরেই স্বাদেশিক ও স্বাজাতিক মঙ্গলের দিকে সতর্কদৃষ্টি রাখা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আর স্বাজাতিক কল্যাণের গরজে আন্তর্জাতিক শুভেচ্ছার কামনা জেগে ওঠে। অতএব, স্বাতন্ত্র-বোধ অসম্ভব!
কথাসাহিত্য রূপ ও রসের দিক দিয়ে চার ভাগে বিভক্ত হতে পারে : ক, চিত্রধর্মী, খ. মনোসমীক্ষাধর্মী, গ. বিশ্লেষণধর্মী ও ঘ. রোমান্টিক।
কথাসাহিত্য ও নাটকের সংলাপের ভাষা নিয়েও কথা উঠেছে। এ ব্যাপারে একটি বিষয় গুরুত্ব সহকারে স্মরণীয় ও বিবেচ্য। সাধুভাষার কাছাকাছি না হলে কোনো কথ্যভাষাই দেশের সর্বাঞ্চলের লোকের বোধগম্য ও প্রয়োগ-যোগ্য হবে না। এটা বুঝেছিলেন বলেই পূর্ববঙ্গঘেঁষা উত্তরবঙ্গের লোক প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেছিলেন ভাগীরথী তীরাঞ্চলের ভাষা। নতুন কথ্যভাষা গ্রহণ করবার গরজ আমাদের থাকলে, কুষ্টিয়া যশোহর বা খুলনা অঞ্চলের কথ্যরূপ গ্রহণ করাই শ্রেয়। বিশেষত সাহিত্যের ভাষা চিরকালই কিছুটা কৃত্রিম। প্রমথ চৌধুরী প্রবর্তিত কথ্যভাষাও অকৃত্রিম নয়। ও ভাষার অবিকল প্রতিরূপ কথায় ব্যবহৃত হয় না কোথাও।
আমরা অনেক সমস্যা তুলে ধরলাম। তাতে উদ্বিগ্ন হবার কিছুই নেই। শক্তিমানের সামনে কোনো সমস্যাই টিকতে পারে না। এগিয়ে চলার পথ করে নিতে পারে সে। আমরা জানি, আমরা নব-শিক্ষিত ও নতুন সংস্কৃতিসেবী, আমাদের জাতীয় জীবনও আধুনিক অর্থে গড়ার মুখে। তবু আমাদের কথা-সাহিত্যক্ষেত্রে দু-চারজন যথার্থ শিল্পীকে ইতিমধ্যে পেয়েছি। বেশ কয়েকটা ভালো সৃষ্টিও হয়েছে। অবশ্য আরো কিছুকাল হয়তো প্রতিভার আবির্ভাবের প্রতীক্ষায় থাকতে হবে আমাদের। এতে হতাশ হবার কিছুই নেই। কোনো দেশেই প্রতিভা গণ্ডায় গণ্ডায় জন্মায় না।
.
০৩.
আধুনিক যুগে ব্যবহারিক জীবনে শোষণ, অত্যাচার ও নিপীড়নে জর্জরিত হয়ে মানুষ নিছক বস্তুতান্ত্রিক হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কলকারখানা স্থাপনের ফলে আর্থিক বৈষম্য মানুষের ব্যবহারিক জীবনে এনেছে গ্লানি, মনন-জীবন করেছে পঙ্গু। তাই অধিকারবাদের লড়াই শুরু হয়েছে দুনিয়াময়। ব্যবহারিক জীবনের যে-মনোজীবন রয়েছে, তা দুঃখ-দৈন্য ও অভাব উৎপীড়নের প্রতিক্রিয়ার ফলে আজ লাঞ্ছিত ও উপেক্ষিত।
আমাদের দেশের সমস্যা যেমনি জটিল, তেমনি মারাত্মক। কিন্তু এদেশে যারা মার খায়, তারা সহ্য করতে অভ্যস্ত। আর যারা মার দেয়, তারাও একে অন্যায় বলে উপলব্ধি করতে অক্ষম। ফলে যে-চেতনা যে-মর্যাদাজ্ঞান, যে-অধিকার আদায়-প্রয়াস বিপ্লব আনে, তা আমাদের দেশে আজো স্বপ্ন। ১৩৫০ সালের মন্বন্তরে লক্ষ লক্ষ মানুষের নির্বাক-নির্বিদ্রোহ আত্মাহুতিই এর প্রমাণ।
তাই য়ুরোপের অনুকরণে আমাদের দেশে গণতন্ত্র, সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে-শৌখিন আন্দোলন শুরু হল, তাতে জনগণের আন্তরিক যোগ ছিল না। অনুভূতি- বিহীন মনীষালব্ধ বাণীর বাহক ও প্রচারক আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের প্রচেষ্টা তাই ব্রত না হয়ে বিলাসরূপে প্রকাশ পেল। যে জিজ্ঞাসা, সমাজবোধ, সমস্যা-সচেতনতা, সামাজিক জীবনচেতনা ও বাস্তবানুভূতি, মানুষের প্রকৃতি ও প্রবৃদ্ধি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা এবং রুচি-আদর্শ সজাগতা সার্থক সৃষ্টির পক্ষে অপরিহার্য, তা আমাদের আদর্শপ্রিয় য়ুরোপমুখী কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে বিরল। এইজন্যে তাদের রচনায় মনন-বৈচিত্র্য নেই। তাদের রচনা যে বিচিত্রধারায় ও মননে সার্থক হয়ে উঠছে না, তার কারণ বাস্তব ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভূতির অভাব। শুধু আদর্শের প্রতি আনুগত্য, কল্পনা, শ্রুতিস্মৃতি ও অনুকরণ দ্বারা সার্থক সৃষ্টি সম্ভব নয়। মানুষের মন ভাঙাগড়া আর সমাজ ভাঙাগড়ার মতো সৃষ্টি কী অল্প-সাধনায় সাধ্য!
একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারি, ইসলামের মূলবাণী হচ্ছে Live and let live. মানে নিজে বেঁচে থাকো এবং অপরকে বাঁচতে সাহায্য কর। ইসলাম বলে–এমন কিছু তুমি তোমার ভাই-এর জন্যে কামনা করো না, যা তুমি নিজের জন্যে পছন্দ করতে পার না; অর্থাৎ যে-দুঃখ, যে-বেদনা, যে-আঘাত তুমি এড়িয়ে চলতে চাও; সে-দুঃখ, সে-বেদনা, সে-আঘাত তুমি অপরকে দিও না। আজকের হিংসা-কোন্দল-হরণ-শোষণ-জর্জরিত মানুষের কাছে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট বাণী কী আছে, যা এই হানাহানি আর কাড়াকাড়ির দুনিয়াতে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষকে নিঃশঙ্ক শান্তি দান করতে পারে? জীবনের সমস্যা, তথা ব্যক্তি ও সমাজের সমস্যা এই আদর্শের আলোকে প্রত্যক্ষ করে সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দেশের জনসাধারণ আধিদৈবিক, আধিভৌতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সর্বপ্রকার দুর্যোগ-দুর্ভোগকে মনুষ্যসাধ্য-বহির্ভূত তকদিরের মামলা বলে আত্মপ্রবোধের ছলে আত্মপ্রবঞ্চনা করতে অভ্যস্ত। এই অদৃষ্টবাদ মানুষের পুরুষ্কারকে যুগ যুগ ধরে অপমানিত ও নিরুদ্যম করে আসছে। এখানেই ঘটেছে আমাদের প্রাণধর্মের, মনুষ্যত্বের ও আত্মশক্তির অপমৃত্যু। একূল ভাঙে ওকূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা–এই হচ্ছে আমাদের স্বীকৃত জীবন-দর্শন। এ মারাত্মক সর্বনাশা সংস্কার থেকে আমাদের উদ্ধার পেতে হবে। কর্মবিমুখ, সাধনাভীরু, আকাভ ক্ষাবিহীন জনসাধারণ আলস্যকে উদাসীনতা, অক্ষমতাকে নিস্পৃহতা, কাপুরুষতাকে সহনশীলতা, আত্মবিশ্বাসকে অহঙ্কার, পরাজয়কে অদৃশ্যশক্তির ইচ্ছা, অভাব-অনটনকে আত্মিক শোধনের উপায় ও পার্থিব জীবনের দুঃখ-বেদনাকে পারলৌকিক জীবনে সুখের আভাস ঠাওরিয়ে, পৌরুষহীন নিষ্ক্রিয় জীবনকে শ্রেয় মনে করে নিয়েছে। আজকের দিনে খলতা, কপটতা, প্রতারণা, মিথ্যা, অন্যায়, দুর্নীতি পরিণত হয়েছে মানুষের জীবন-বেদে। এ অবস্থা অশুভ এবং পরিণাম ভয়াবহ। ন্যায়নীতি ও সত্য আজ নির্বাসিতা। ন্যায়নীতিবোধ জাতির মেরুদণ্ড স্বরূপ। ন্যায়নীতি, সত্যপ্রীতি হারালে জাতি দাঁড়াবে কিসের জোরে? মিথ্যায় সুবিধা আছে, কিন্তু শক্তি নেই, তাই পতন অনিবার্য। এ কথার কথা নয়, ইতিহাসের বাণী। এজন্যে আমাদের সাহিত্যে প্রতারণা, মিথ্যা, অন্যায় ও দুর্নীতির বিভীষিকাময় পরিণতির চিত্র অঙ্কিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ন্যায়-নীতি-সত্য যে আত্মমর্যাদা ও মনুষ্যত্বের পরিপোষক, মনোবল ও আত্মশক্তির বিকাশক, এ ধারণাও জন্মিয়ে দিতে হবে ইতিহাসের নজির দিয়ে। মিথ্যা, প্রতারণা ও দুর্নীতির পঙ্ককুণ্ড থেকে জাতিকে উদ্ধার করার ব্রতও গ্রহণ করতে হবে আমাদের সাহিত্য-স্রষ্টাদের।