অতএব, যে-কেউ কিছু বলবেন বা লিখবেন তাতে তার অচেতন, অবচেতন বা সচেতন মনের বিশেষ দৃষ্টি বা মত বা আদর্শ প্রকাশ পাবে। এ হচ্ছে নিতান্ত স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি–প্রয়াস বা প্রভাবপ্রসূত নয়। মানুষের ব্যবহারিক গতিবিধিকে অর্ডিন্যান্স যোগে নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব তো বটেই, সহজও। কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ত মনন-চিন্তন ধারাকে কোনো আদেশ-নির্দেশ-উপদেশের অর্ডিন্যান্স প্রয়োগে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। অর্ডিন্যান্স প্রয়োগ করলে মননধারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে কোনো বিশিষ্ট খাতে প্রবাহিত তো হবেই না, বরং বলপ্রয়োগে তা লুপ্ত বা ধ্বংস হতে বাধ্য। মানুষের মন-মননের উপর অর্ডিন্যান্স মারাত্মক অভিসন্ধি। আগের যুগেও এরূপ অর্ডিন্যান্স জারির লিপ্সা কারো কারো হয়েছিল। ফল কী হয়েছিল কারো অজানা নেই।
এ যুগে–এই জ্ঞানপ্রবুদ্ধ যুগেও নানা দেশে যেসব বিজ্ঞলোক মানুষের মনন-চিন্তনের উপর অর্ডিন্যান্স প্রয়োগে প্রয়াসী, তাঁদের বিজ্ঞতায় অশ্রদ্ধা জাগা অস্বাভাবিক নয়। কারণ আমার কাছে যা সত্য ও সুন্দর, তা-ই একমাত্র সত্য এবং একমাত্র সুন্দর, আর সব মিথ্যা ও ক্ষতিকর–এমন ধারণা যার মনে বাসা বাঁধে, তাঁর জ্ঞান-মনীষায় আস্থা বা শ্রদ্ধা রাখা কোনো সুস্থমস্তিষ্ক লোকের পক্ষেই সম্ভব নয়। অপরাপর সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিধানের মতো সাহিত্যেও বিধিবিধান প্রয়োগের ধৃষ্টতা দেখা দিয়েছে। কোনো আদর্শে কী বিষয়বস্তু নিয়ে কিরূপ ভাষায় কোনো ছাদে সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে, পূর্বাহ্নে তার permit নিতে হবে নীতিবেত্তা ও নিয়ামকদের কাছ থেকে!
যারা সাহিত্য সৃষ্টি করেন, তাঁদের সৃষ্টির মূলে রয়েছে একাগ্র ধ্যান, অবিচলিত নিষ্ঠা, একান্ত বিশ্বাস এবং দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। মনন ও প্রকাশের স্বাধীনতা জীবনের অন্যক্ষেত্রে স্বীকৃত না হলেও হয়তো তেমন ক্ষতি নেই, কিন্তু সাহিত্যক্ষেত্রে এই-ই হচ্ছে সৃষ্টির উৎসমুখ। এই স্বাধীনতা যদি না থাকে, তবে সাহিত্য-সৃষ্টি অসম্ভব। হোমার, শেকসপিয়ার, শ বা সাদী-রুমীর সৃষ্টি এক আদর্শপ্রসূত নয়; তাতে মানুষের চিন্তা রাজ্যে সংঘাত ঘটেনি বরং মনোসঞ্চরণের ক্ষেত্র বিচিত্রতর ও প্রশস্ততর হয়েছে। বিশেষ করে ব্যক্তিবিশেষের কাছে জ্ঞানরাজ্যের সীমা-পরিসীমা নেই। বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন পথে সে-জ্ঞান আহরণেই আরাম, আনন্দ এবং কল্যাণ। সে-কল্যাণ মানবসাধারণের। সাহিত্যক্ষেত্রে যারা বিধাতার আসনে বসে নির্দেশে ফরমায়েশি সাহিত্য সৃষ্টি করতে চান, তাঁরা জাতির-বৃহত্তর অর্থে মানুষের রসের ও উপলব্ধির ক্ষেত্রকে সংকীর্ণতর করে মনুষ্যসাধারণের সাংস্কৃতিক তথা মানবিক অধিকারই হরণ করছেন। লেখক-পাঠকের প্রতি এরচেয়ে বড় অবিচার, সাধারণভাবে মানুষের কাছে এরচেয়ে বড় বিপত্তি আর কিছুই নেই।
মানুষ প্রতিমুহূর্তে নিজেকে এবং জগৎকে নতুনভাবে উপলব্ধি করছে। তার সেই অপূর্ব বিচিত্র উপলব্ধির প্রকাশে জগৎ ও জীবন বৈচিত্র্যে সুন্দরতর ও বিস্তৃততর হচ্ছে। এভাবে মনোজগতে যে বিপ্লব অহরহ ঘটছে তাকে রোধ করা মানেই জীবনের অপমৃত্যু ঘটানো। জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তন আজকের নতুন ব্যাপার নয়। চিরকাল এমনিই হয়ে আসছে। যারা বিবর্তনকে বাধা দিয়েছে, সহজভাবে অভিনন্দিত করতে পারেনি, তারাই হতভাগ্য। কারণ পরিণামে তারাই ঠকেছে। যা আসবার তা আসবেই, যা ঘটবার তা না ঘটে যাবে না–তা বাধা যত বড়ই হোক, আর সাবধানতা যতই নিখুঁত থাক! সেজন্যেই সাহিত্যে যে-কোনো মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকাই বাঞ্ছনীয় এবং বিশেষ আবশ্যকতা ঈশ্বরবাদ হোক, অথবা ব্যক্তিবাদ, সমাজবাদ, রাষ্ট্রবাদ বা ধর্মবাদ হোক! এর মধ্যে যা রসায়ত্ত, যা সাহিত্য তা টিকে থাকবে, অন্য দশজনকে প্রভাবিতও করবে; যা নিঃসার তা যাবে–আবর্জনার মতোই লোকচক্ষুর আড়ালে ঢাকা পড়বে, তার জন্যে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কারো নিজের বিশ্বাস ও খেয়ালখুশিমতো বিশ্বজগৎ ও বিশ্বমানবকে কোনো বিশেষ নিয়ম-নিগড়ে বাঁধতে যাওয়া শুধু বাতুলতা নয়, অদূরদর্শিতা এবং মুখতাও বটে।
তবু যদি কারো মন বুঝ না মানে, তবে বাধা দেয়া উচিত নিজের কণ্ঠ আরো চড়িয়ে–অন্যের কণ্ঠরোধ করে নয়। আগাছা যদি নষ্ট করতে হয়, তবে নিজেকে বটগাছ হতে হবে, অন্যথায় আস্ফালন ব্যর্থ ও দুঃখবহ হতে বাধ্য।
সাহিত্যের রূপকল্পে ও রসকল্পে বিবর্তনের ধারা
বর্বরতম যুগে মানুষে আর পশুতে কোনো ভেদ ছিল না। পশুর মতো তারও সেদিন একমাত্র কাম্য ছিল ক্ষুন্নিবৃত্তি; তবু তার মন বলে পশুর থেকে উন্নততর একটি বৃত্তি ছিল; ফলে, তার শুধু পেটে ক্ষুধা নয়, মনেও ছিল পিপাসা। সেটাও ভোগে। সেদিন সে শুধু ক্ষুন্নিবৃত্তির প্রয়াসী ছিল, বাস্তব ব্যবহারিক জীবনে আর কোনো ভোগ্যবস্তুর প্রত্যাশী ছিল না। সে-বোধই জাগেনি তখনো; কাজেই বঞ্চিত জীবনের হতবাঞ্ছার কোনো বিক্ষোভ ছিল না তার মনে। সেজন্যে ব্যবহারিক প্রয়েজনে কোনো চিন্তাই তাকে বিচলিত করতে পারেনি। তাই বাস্তব জীবনোপলব্ধির কোনো গরজ, জীবনকে যাচাই করবার কোনো প্রেরণাই সে বোধ করেনি সেদিন। সে তাকিয়েছিল তার চারদিককার অজানা ও রহস্যাবৃত চিরবিস্ময়কর সৃষ্টি-বৈচিত্র্যের দিকে। তা-ই তাকে করেছিল চকিত, বিস্মিত, ভীত, এস্ত ও উল্লসিত। সেজন্যেই সে–চাটাইয়ে নয়, ঘাস বা পাতায় শুয়ে স্বপ্ন দেখত পাখির মতো দূর-দূরান্তরে উড়ে যেতে; খুঁজত আকাশের কিনারা দুনিয়ার শেষ। সে কল্পনা করত, মানুষের অগম্য হিমালয়-সাহারা-অলিম্পাসে না-জানি কী আছে, কারা আছে! নিশ্চয়ই সেখানে এমন কিছু আছে, এমন কেউ থাকে, যা কাম্য, যা শ্রেয়, বা সুন্দরতর ও মহত্তর এবং আকৃতি-প্রকৃতিতে, রূপে-গুণে, বলে-ছলে যে বা যারা বিচিত্রতর।