অতএব, সাহিত্য বিচারে সার্বজনিক কোনো নিরিখ নেই। পাঠকের রুচি, বিদ্যাবুদ্ধি, জ্ঞান প্রজ্ঞা ও প্রকৃতি-প্রবৃত্তি অনুসারে সাহিত্যের রসরূপ উপলব্ধ হয়। এখানে ভালো লাগাটাই বড় কথা। ইংরেজি গানের সুর-তাল যতই উৎকৃষ্ট হোক, সাধারণ বাঙালির কাছে তার কোনোই আবেদন নেই। তার কাছে–বাঙলা গান জগতের সর্বসঙ্গীতের বাড়া। তেমনি শেলির কবিতার বা শর নাটকের তীক্ষ্ণ মনীষাদীপ্ত সংলাপের মূল্য ইংরেজি ভাষার ব্যুৎপত্তিহীন পাঠকের কাছে কানাকড়িও নয়। এমন পাঠকের কাছে নজরুল কী দ্বিজেন রায়েরই কদর। শেলি বা শ অপাঠ্য, অন্তত দুম্পাঠ্য তো বটেই। সুতরাং পাঠকসাধারণের মতামতের উপর নির্ভর করে সাহিত্যের উত্তৰ্ষ-অপকর্ষ সম্বন্ধে ডিগ্রি-ডিসমিস দেয়া চলে না। এমন দেখা গেছে, সবেচেয়ে ভালো বইয়ের কদর সবশেষে হয়েছে। তবে সাহিত্য ব্যাপারে প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে–যেসব পাঠকের বিদ্যা-বুদ্ধি, রুচি-প্রকৃতি ও রস-জ্ঞানে বিশ্বাস ও ভরসা আছে, তাদের মতামতকে চরম এবং যথার্থ মনে করে সাহিত্যের সাধারণ পাঠকগোষ্ঠী বুঝে বা না-বুঝে রচনা-বিশেষের সমাদর করে। কিন্তু এমন বিজ্ঞ সমালোচক ও রসবেত্তারাও শুধু ভালো লাগা বা মন্দ লাগার বড় জোর কারণ দর্শাতে পারেন, কিন্তু নির্দেশ দিয়ে সৃষ্টি করাতে পারেন না–যেমন যেসব উপাদানে বৃক্ষের জীবন ও দেহ গঠিত, সে-সব বিশ্লেষণ করা সম্ভব, কিন্তু বৃক্ষ তৈরি করা অসম্ভব।
এ পর্যন্ত গেল রসের কথা। তারপর আসে আদর্শবাদের বিষয়।
স্রষ্টা নিজের ভাব-চিন্তা এবং বুদ্ধি ও বোধি দিয়ে সৃষ্টি করেন। তাঁর স্বকীয় অনুভূতি-উপলব্ধি বাণীরূপ লাভ করে হয় সাহিত্য। বস্তুত মানুষের অনুভূতি ও উপলব্ধি বাহ্যবস্তু-নিরপেক্ষ নয়। লেখক তাঁর রুচি, প্রকৃতি-প্রবৃত্তি ও বুদ্ধি-বোধিজাত আত্মদৃষ্টি দিয়ে জগৎ ও জীবনকে প্রত্যক্ষ করেন এবং এভাবে সর্বসমন্বয়ে মনের মধ্যে জগৎ ও জীবনের যে একটি সংহতরূপ গড়ে উঠে, তা-ই প্রকাশিত হয় তাঁর রচনায়। তার মতামতও একান্তভাবে তাঁরই। অপরের সাথে সে মতামতের মিল ঘটে নিতান্ত আকস্মিকভাবে। অতএব ব্যক্তি-বিশেষের মনের উপর বাহ্য প্রভাব যতই গভীর ও ব্যাপক হোক না কেন, তা যদি স্বাঙ্গীকরণ ব্যতীত প্রকাশিত হয়, তবে একে অজীর্ণরোগের সাথেই তুলনা করা উচিত। তা রচনা হবে–রসায়ত্ত সাহিত্য হবে না। সুতরাং তার জন্যে কারো ভাবনার প্রয়োজনই নেই। অতএব দেখা যাচ্ছে–লেখক-বিশেষের স্বকীয় ভাব-চিন্তা-জ্ঞান ও প্রজ্ঞালব্ধ যে মতামত রচনায় প্রকাশিত হয়, তা-ই লেখকের আদর্শ। এদিক দিয়ে বিচার করলে আমরা দেখতে পাব–প্রত্যেক লেখকেরই এক একটি আদর্শ রয়েছে। কারো রয়েছে সমাজাদর্শ, কারো রাষ্ট্রাদর্শ, কারো বা ধর্মাদর্শ। তবে এ-কথায় বোধ হয় দ্বিমত নেই যে, হোমার থেকে শ অবধি কেউ সভা ডেকে পরামর্শ করে তাদের সাহিত্যাদর্শ স্থির করেননি। তাঁদের যিনি যেভাবে জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন-বুঝেছেন, সেভাবেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
এ যুগে যে-কোনো আদর্শ সম্বন্ধে কিছু বলা মানেই বিপদ ঘাড়ে করা। সুতরাং আমি সে-চেষ্টা করব না। আমি অন্য উপায়ে আমার বক্তব্য পেশ করব। এতে অবশ্য কথাগুলো কিছুটা অবৈজ্ঞানিক হবে, তবু হয়তো বুঝতে কষ্ট হবে না।
পূর্বেই বলেছি, সমাজে-ধর্মে-রাষ্ট্রে বা সাহিত্যে যখন যিনি যা প্রচার করেন তাতে বাহ্য প্রভাব যতই থাক না কেন, তাকে প্রচারকের নিজের অনুভূতি-উপলব্ধি বা বিশ্বাসের ফল বলেই ধরে নিতে হবে। বহু পুরাতন পরিত্যক্ত আদর্শ কেউ যদি নতুন করে প্রচার করে, তবে বুঝতে হবে তা পুরাতনের পুচ্ছগ্রাহিতা নয়, স্বকীয় নতুন উপলব্ধির প্রকাশ মাত্র। এখানে আমাদের আরো একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, তা হচ্ছে মানুষের রুচি-প্রকৃতির যতই বৈচিত্র্য থাক না কেন, মানুষের বুদ্ধি-প্রজ্ঞা অপরিসীম নয়। ফলে মানুষ এ-পর্যন্ত জগৎ ও জীবন ব্যাপারে যে-কয়টি মৌল-শক্তির উৎসের ধারণা করতে সমর্থ হয়েছেন, আমার অবৈজ্ঞানিক অভিধায় সেগুলোর নাম দেওয়া যাক সমাজসত্তা, ব্যক্তিসত্তা, রাষ্ট্রসত্তা, ধর্মসত্তা, নাস্তিক্যসত্তা, নীতিসত্তা, নৈর্ব্যক্তিক রসসত্তা (মানে দার্শনিকতা), নীতিলেশহীন বিচিত্রসত্তা ইত্যাদি। স্ব স্ব জ্ঞান-মনীষা দিয়ে কেউ ব্যক্তি-মহিমা, কেউ ধর্ম-মহিমা, কেউ রাষ্ট্র-মহিমা, কেউ সমাজ-মহিমা, কেউবা নাস্তিক্য-মহিমা, আবার কেউ বা ব্যষ্টির বিচিত্র অনুভূতিরস-মহিমা প্রচার করেছেন। এ-কথা যথার্থ যে, প্রত্যেকেই স্ব স্ব উপলব্ধিরই অভিব্যক্তি দিয়েছেন, কেউ কারো আদেশ-নির্দেশ বা উপদেশ-পরামর্শ গ্রহণ করেননি। কেননা নিজের বুদ্ধিগ্রাহ্য বা হৃদয়গ্রাহ্য না হলে কেউ কারো অনুকরণও করতে পারে না। অন্ধের হস্তীদর্শনের মতো হয় আমরা সবাই ভুল ধারণা পোষণ করছি অথবা আমরা সবাই সত্য কথাই বলছি। এ-নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু মীমাংসা পাওয়া যাবে না, সুতরাং সিদ্ধান্তে পৌঁছা অসম্ভব। কাজেই ধরে নেয়া যাক মানব-বুদ্ধি ও প্রকৃতি যেমন বিচিত্র, সত্যও তেমনি একক নয়–বহু ও বিচিত্র এবং সত্য অরূপ অর্থাৎ তার বিশিষ্ট কোনো রূপ নেই। কেননা জগৎ, জীবন, বস্তু ও অনুভূতি নিছক বাস্তব নয়, বাস্তব সম্পর্কে ব্যক্তিক ধারণার প্রসূনমাত্র। তাই কোনো দুইজনের দুনিয়া এক রকম নয়।