কোনো ভাষাতেই ধর্মীয় রূপ থাকতে পারে না, থাকে ধার্মিকভাব। মোমেন স্বেচ্ছায় যে কথা বলবে, যা ভাববে বা করবে, তাতে–এক কথায় তার চলনে-বলনে-করণে ইসলামি ভাব বা আদর্শ থাকবেই। সে যেখানেই থাকুক, যে-ভাষায়ই বলুক আর যে হাতিয়ারেই করুক। এ বিষয়ে তর্কের অবকাশ নেই। কাজেই মাতৃভাষার সঙ্গে ধর্মের ভাষা মিশালেই ভাষা ও সাহিত্যের ধর্মীয় রূপ মেলে না। কে না বোঝে যে আরবি ভাষায়ও আল্লাহর নিন্দা করা যায়, আবার সংস্কৃত ভাষায়ও আল্লাহ্র বন্দনা সম্ভব।
আমাদের দুর্ভাগ্য, একটা অহেতুক মোহবশে আমরা যুক্তি ও বিবেচনা পরিহার করে একপ্রকার আদর্শ-মরীচিৎকার পিছু ধাওয়া করছি। তার ফলে আমরা আমাদের স্থানিক, কালিক ও ব্যক্তিক গরজ ও উপযোগ ভুলে অর্থাৎ বাস্তব জীবনের পরিবেশ ও প্রয়োজন বিস্মৃত হয়ে মনোময় স্বপ্নলোক সৃষ্টির হাওয়াই আদর্শের রূপায়ণে উধ্বমুখে ছুটে চলেছি। এই আকাশচারিতা যে আমাদের শক্তি-সামর্থ্যের কেবল অপচয়ই ঘটাতে পারে, জীবনে কোনো সাফল্য কিংবা স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারে না, তা আমরা ভাবতেও চাই না। সত্যকে অস্বীকার করা যে দায়িত্বকে এড়িয়ে যাওয়া তথা জীবনকেই ফাঁকি দেওয়া–এ বোধ আমাদের যতদিন সহজভাবে না জাগবে ততদিন আমাদের মন-মানসের মুক্তি নেই। ফলে এগিয়ে চলার পথ নির্ণয়ের সমস্যাও থেকে যাবে। অতএব রুদ্ধ থাকবে অগ্রগতিও।
আমাদের কাছে যুক্তি-বুদ্ধি কীভাবে অবহেলিত এবং মোহাবেগ কত বেশি প্রবল তার একটি দৃষ্টান্ত দিলেই হবে।
উপমাদি অলঙ্কার তথা রূপ-প্রতীক ব্যবহৃত হয় বক্তব্যকে পষ্ট, সুষ্ঠু ও ঋদ্ধ করবার জন্যেই শিল্প-সৌন্দর্যও ফুটে ওঠে এভাবেই, কেননা পরিচিত বস্তু বা ভাবের ব্যঞ্জনা ও ঐশ্বর্য বক্তব্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাকে অসামান্য করে তোলে। মাতৃভাষার শব্দ ও স্বদেশের বস্তুই বক্তার বা শ্রোতার মানসলোকে এ গুণ নিয়ে বিরাজ করে। অপরিচিত বিদেশী শব্দ, ভাব বা বস্তু তার ব্যঞ্জনা ও লাবণ্য নিয়ে ভিন্নদেশীর কানে-মনে সহজে এবং স্বাভাবিকভাবে প্রবেশ করতে পারে না। সত্যি কিনা জানিনে, শুনতে পাই কেবল বিদগ্ধ জনের পক্ষেই বিজাতীয় ভাষার রস-রূপ আয়ত্ত করা সম্ভব।
এ যদি সত্যি হয়; সাধারণের জন্যে রচিত সাহিত্য আরবি, ফারসি, ইংরেজি শব্দ বা বস্তুনাম বসালে তার ধ্বনি-সৌন্দর্য ও অর্থব্যঞ্জনা বৃদ্ধি পাবার কথা নয়। কেননা, ওগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অভাব রয়েছে এবং তাই কল্পনার দৃষ্টিও অতদূর না- পৌঁছাই স্বাভাবিক। তেমন অবস্থায় বিয়াবান, কাফেলা, মঞ্জিল, নারঙ্গী, খোর্মা, শব্ব-ই-গুল, কোহ্ কিংবা ইংরেজি বা গ্রীক পৌরাণিক শব্দ প্রভৃতি রচনা-গৌরব বৃদ্ধি করার কথা নয়। আর একটি কথা আগেই বলেছি, আরব-ইরানিরা তাদের কাফের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য-রিথ অবহেলা করেনি, পরম শ্রদ্ধায় বরণ করে নিয়েছে। আমরা কিন্তু আমাদের অমুসলমান পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ভুলবার সাধনা করেছি, আর অবজ্ঞা করেছি আমাদের স্বকীয় ও স্বাদেশিক সম্পদকে।
আমাদের শ্রদ্ধা-ভক্তি-প্রীতি যা-ই হোক না কেন, তা থাকবে (এবং থাকা বাঞ্ছনীয়ও) মুসলিম আরব ও ইরানির প্রতি। তাদের কাফের পূর্বপুরুষের জন্যে আমাদের কোনো শ্রদ্ধা-সমীহের ভাব থাকার কথা নয়, থাকা উচিতও নয়, অথচ এ ব্যাপারে আমাদের মনোভাব অদ্ভুত ও আত্মদ্বেষী। পাক-ভারতের দশ কোটি মুসলমানের কিছুসংখ্যক লোক আরব-ইরানি-তুরানির বংশধর হলেও নিশ্চয়ই আর সব মুসলমান দেশজ, তাহলে দাতার উপমা দিতে হলে বিদেশী বিজাতি কাফের হাতেমতাইর চেয়ে দেশী এবং সম্ভবত জ্ঞাতি কর্ণের উপমা মনে জাগাই স্বাভাবিক ও শোভন। তেমনি কাফের কবি ইমরুল কায়েসের চেয়ে কালিদাসের দাবী কম নয়।
নওসেরওয়া, জানান, শাহরিয়ার হলেন বিদেশী অমুসলমান, আর বিক্রমাদিত্য-ভোজরাজা আমাদের প্রতিবেশী এবং নানা সূত্রে চেনা লোক। বিদেশী কাফের শাহনূরীমান, রোস্তম-সোহরাব আমাদের আপন হলে আমাদের পাশের বাড়ির ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কিংবা ভীমার্জুনকে পর ভাবা কষ্টসাধ্য। এ কতবড় আত্মলাঞ্ছনা ও আত্মপ্রবঞ্চনা, আমরা ভেবে দেখছি কী? আমাদের রূপপ্রতাঁকে যদি বাছবিচার করতেই হয়, তাহলে আমাদের নীতি হবে–আমরা দেশী-বিদেশী মুসলিম ঐতিহ্য ও আদর্শপ্রসূ রূপপ্রতীকই কেবল গ্রহণ করব। দেশী বিদেশী কোনো মুসলমানেরই জ্ঞাতি অমুসলিমের কিছু গ্রহণ করব না। আর যদি সাহিত্য-শিল্পের উৎকর্ষের জন্যে নির্বিচারে রূপপ্রতীক ব্যবহার করতে চাই, তা হলে দেশীগুলোকেও হেলা করব না, কোনো বিরূপতা দেখাব না।
বিদেশী ভাব, বস্তু, শব্দ ও রূপপ্রতীক গ্রহণ ও বরণ অপরিহার্য হয়ে ওঠে তখনি, যখন জাতির ভাষা ও ভাবে তার অভাব থাকে অর্থাৎ নতুন বস্তুর নাম ও ভাবের বাহন হিসেবেই শুধু এক ভাষায় অপর ভাষার শব্দ গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। যেমন এ যুগে বিভিন্ন নতুন বস্তু পরিচায়ক ও ভাব। প্রকাশক ইংরেজি শব্দ এসেছে আমাদের ভাষায়। এ না হলে ঋণ গ্রহণ নিরর্থক ও অসার্থক।
আমরা এভাবে আড়াই থেকে তিন হাজার আরবি-ইরানি ও তুর্কী শব্দ আগেও গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি, প্রয়োজনমতো চিরকালই করব এবং তা শুধু এসব ভাষা থেকেই নয়, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যে-কোনো ভাষা থেকেই করব। কেননা, তাতে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য এবং মন-মানস সমৃদ্ধই হবে। কিন্তু অহেতুক মোহবশে করলেই কেবল আপত্তি উঠবে এবং সে-আপত্তি নিশ্চয়ই কল্যাণ-বুদ্ধিপ্রসূত হবে। বিশেষত, এখন আন্তর্জাতিকতার যুগ; চিত্ত প্রসারের এবং জীবনকে বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে দেবার যুগ। অতএব যেখানে যা-কিছু ভালো, যা-কিছু সুন্দর ও কল্যাণকর, তা-ই কুড়িয়ে নেব, সাদরে গ্রহণ করব, আর আগ্রহে বরণ করব। আমাদের ধর্ম-ভাই আরব-ইরানির অবদান গ্রহণ করতে কোনো কুণ্ঠা থাকার কথা নয়। কিন্তু সংকীর্ণ চিত্তের মোহ ও বিকৃতিবশে জগতের উদার বিস্তারের আলো-হাওয়া থেকে নিজেদের গা-বাঁচিয়ে আদিম গোত্র ও কোটারি প্রীতির বশে পুরোনোকে ও বিশেষকে আঁকড়ে ধরার মনোভাবেই আমাদের আপত্তি। তা জীবন বিমুখিতার লক্ষণ তথা প্রগতির পরিপন্থী।
সাহিত্যে আর্দশবাদ বা অর্ডিন্যান্স
সাহিত্যের রূপ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে সঠিক অভিব্যক্তি দেওয়া আজো সম্ভব হয়নি, যদিও এ পথে সাহিত্য সৃষ্টির সাথে সাথেই চেষ্টা চলে আসছে। তার প্রধান কারণ বোধ হয় এই যে, সাহিত্য মূলত উপভোগের বস্তু; অনুভূতিজাত উপলব্ধিই এর চরম কথা; ব্যাখ্যা করে বুঝে নেয়া বা বুঝিয়ে দেয়ার বস্তুই এ নয়। এমনও অনেক রচনা আছে যার বস্তু আছে–ভাষাও ত্রুটিহীন অথচ তা সাহিত্যই নয়! যেমন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় প্রবন্ধাবলি। সুতরাং সাহিত্য যে কী বস্তু, তার স্বরূপ কী প্রকার, তা ব্যক্ত করা ব্যাখা করা সম্ভব নয়। শুধু বলা চলে, সাহিত্য রস-স্বরূপ। সে-রসের বহু সংজ্ঞা প্রচলিত আছে সত্যি, কিন্তু বুদ্ধিগ্রাহ্য একটিও নয়; শুধু উপলব্ধি এবং উপভোগ-সম্ভাব্যতাই এর একমাত্র পরিচয়। এছাড়া প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ও রসগ্রাহিতামূলক যত সংজ্ঞা আছে সবগুলোই বাহ্য-অন্তরপরিচয়বাহী নয়। এগুলোকে আহা-আহা মরি-মরি ধাচের আবেদনমূলক সংজ্ঞা বললে একটু খটকার কারণ ঘটে বটে–কিন্তু আসলে এগুলো তা-ই।