চতুর্থত, ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা জাতিক জীবনে উঠতির ও পড়তির কতগুলো সাধারণ লক্ষণ দেখা যায়। উঠতির লক্ষণ প্রাণময়তা, আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মপ্রত্যয় ও আত্মপ্রসারের অবিরাম প্রয়াস। পুরোনোর পুচ্ছগ্রাহিতা নয়; নতুনের উদ্ভাবনে ও উদঘাটনে, ক্ষয়-ক্ষতির ঝুঁকি নিয়ে চিন্তার ও কর্মের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন ও বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার নির্ভীক উদ্যমেই এর প্রকাশ ও বিকাশ। আর পড়তির লক্ষণ হচ্ছে পুচ্ছগ্রাহিতা, যোগ্যজ্ঞাতি প্রীতি, কুটুমের গৌরব বশ্যতা, আত্মবিস্মৃতি, দেহে-মনে পরপোষ্যতা, অতীতমুখিতা, নিষ্প্রাণতা, আর চিন্তায় ও কর্মে উদ্যমহীনতা।
দুটো দৃষ্টান্ত নিলেই আমাদের বক্তব্য পষ্ট হবে। ইহুদির জাত আছে, ধর্ম আছে, ছিল না কেবল দেশ; তাই বলে তারা আত্মবিস্মৃত ছিল না। এ কারণেই জনসংখ্যায় নগণ্য হওয়া সত্ত্বেও আজকের য়ুরোপীয় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে তাদের দান গুরুত্বে বিশিষ্ট। আর পাক-ভারতে প্রায় আড়াইশ বছর আগে দেশী ও ইঙ্গ-ভারতীয় খ্রীস্টান সমাজ গড়ে উঠলেও আত্মসচেতনতার অভাবে তাদের অস্তিত্বের ছাপ জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই ফুটে ওঠেনি। তারা শাসকজাতির জ্ঞাতিত্বের গর্বে, স্বধর্মীর স্বদেশ য়ুরোপ-মুখিতায় এবং য়ুরোপীয় সংস্কৃতিতে স্বকীয়তার স্বপ্নে নির্বোধ আত্মপ্রসাদ লাভ করে যে-আত্মপ্রবঞ্চনা করেছে, তাতে তাদের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যহীন তথা সাধনাহীন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে কেবলই Snobbery প্রকট হয়ে উঠেছিল জাতি বা সম্প্রদায় হিসেবে সুস্থ। হয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠ হতে পায়নি। শিক্ষায়-সাহিত্যে-দর্শনে-বিজ্ঞানে কিংবা চারিত্রিক মহত্ত্ব-মাহাত্ম্যে তাদের কেউ গণ্য হয়ে ওঠেনি। স্বাধীন পাক-ভারতে তাদের মোহ-মুক্তির অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠছে, এখন হয়তো তাদের সত্যকার জীবন-সাধন শুরু হবে।
হাজার বছর ধরে উচ্চবিত্তের বাঙালি মুসলমান এরূপ বহির্মুখী মনের পরিচয় দিয়েছে। তাই বিগত হাজার বছরে বাঙালি মুসলিম উচ্চবিত্তের দ্বারা আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতিতে শ্লাঘ্য, কোনো কীর্তি গড়ে ওঠেনি। নিম্নবিত্তের অজ্ঞ অশিক্ষিত লোকের মাটির মায়া ছিল, কিন্তু অজ্ঞতা-অশিক্ষার দরুণ তাদের স্বকীয় আদর্শ ও লক্ষ্য চেতনা ছিল না, তাই তারাও পর-প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বস্থ হতে পারেনি। আর তাই তারা গড়ে তুলেছিল লৌকিক ইসলাম–যার কল্পছায়ায় তারা জগৎ ও জীবনের মনোময় ব্যাখ্যা খুঁজেছে এবং পেয়েছে। তাদের ভক্তিবাদ, বৈরাগ্য ধর্ম ও মানবতাবোধ এক : অভিনব মরমীয়া তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে, যাতে দেহাত্মবাদ, মুরশিদ পন্থ, অলখ সই (অলক্ষ্য স্বামী) জীবন- জিজ্ঞাসার নিবৃত্তি ও জৈবধর্মের বিকৃতি ঘটিয়েছে। তবু এ কারুর কাছে গর্বের, আবার কারুর কাছে লজ্জাকর।
যারা বসুধৈব কুটুম্বকম-পন্থী তাদের কাছে মানুষের প্রাকৃত-মানসের এই সহজ ও অকৃত্রিম প্রকাশ গর্বের ও আনন্দের সামগ্রী। আর যারা স্বধর্মনিষ্ঠ আদর্শবাদী তাদের কাছে এ স্বধর্মভ্রষ্টতা– আদর্শচ্যুতি লজ্জার ও ক্ষোভের বিষয়। এ প্রাকৃতজনেরা জীবন-ভাবনার প্রয়োজনে উচ্চারণ করেছে। মানবতা ও মানব মহিমার চরম বাণী : নানা বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ :
জগৎ ভরমিয়া দেখিলাম একই মায়ের পুত।
আর– লামে আলিফ লুকায় যেমন
মানুষে সাঁই আছে তেমন
তা-না হলে কী সব নূর-ই-তন
আদম তনকে সেজদা জানায়!
কিংবা, আহাদ আহমদ মাঝে
কেবল মিমে ফরক রয়।
আবার এরাই বাঁচবার গরজে করেছে নানা উপদেবতা ও অপদেবতার পূজা।
অতএব যারা ইসলাম-অনুগ জীবন, আদর্শ ও সংস্কৃতির পক্ষপাতী, তারা বিগত হাজার বছরের বাঙলার ইতিহাসে নিছক ইসলামি সংস্কৃতির কোনো নিদর্শন পাবে না। অবশ্য সুফীতত্ত্ব প্রভাবিত এই সংস্কৃতিকে দেশী মুসলিম সংস্কৃতি বলে স্বীকৃতি দিয়ে সহজেই গৌরব করা যায়।
সংস্কৃতি মাত্রেই স্বস্থ জীবনবোধের প্রকাশ এবং প্রাণময়তার অভিব্যক্তি। আর চিন্তায় ও কর্মে সুন্দরের সাধারণ নাম সংস্কৃতি। এর চর্চা এবং স্বরূপে এর প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের নাম সাংস্কৃতিক চর্চা। কাজেই তা বহু বিচিত্র ও নতুন হয়েই ফুটে ওঠে। নিতান্ত আদর্শানুগত্য কোনো সংস্কৃতির জন্ম দিতে পারে না, এমনকি সুষ্ঠু লালনেও অক্ষম। এইজন্যেই সাধারণত আমরা ইসলামি সংস্কৃতি বলতে যা বুঝি ও বুঝাই তাও আরব-ইরান-তুরানের দেশজ ও গোত্রজ সংস্কৃতির পাঁচমিশেলী রূপ মাত্র। তাই এর পরিচায়ক নাম হওয়া উচিত মুসলিম সংস্কৃতি এবং যেহেতু এ সংস্কৃতির উদ্ভব মুসলিম মানসে এবং এর প্রতিফলন হয়েছে মুসলমানেরই আচরণে ও কর্মে, সেজন্যে রূপকল্পে ও ভাবরসে তা ইসলামি জীবনবোধের দ্বারা প্রভাবিত। তাই বলে একে ইসলামি বলার যৌক্তিকতা নেই।
আগেও বলেছি, আবার বলছি; ধর্ম এক জিনিস, আর স্বাদেশিকতা, স্বাভাবিকতা ও স্বাজাতিকতা অন্য বস্তু। মানুষ চিরকাল বিদেশের ও বিজাতির ধর্ম গ্রহণ করেছে, কিন্তু স্বদেশ, স্বভাষা ও স্বাজাত্য ছাড়েনি। তাই পৃথিবীর তিনটে বহুল প্রচারিত ধর্মের ভাষা হিব্রু, পালি এবং আরবি–মসজিদ, মন্দির ও গীর্জার প্রাচীর ডিঙিয়ে বিদেশে কারো মুখের বুলি হতে পারেনি। হৃদয়বৃত্তির প্রাবল্য-বশে ধর্মের উদ্ভবভূমি, ধর্মীয় ভাষা এবং ধর্মপ্রবর্তকের গোত্র শ্রদ্ধেয় হতে পারে, তাই বলে নির্বিকার ও নির্বিচার আত্মসমর্পণ তথা আত্মবিলয় দাবী করতে পারে না। প্রত্যেক মানুষের যেমন ব্যক্তিক দাবী আর পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে, অর্থাৎ ব্যক্তি যেভাবে। নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও পরিবারের ও সমাজের সদস্য, তেমনি মানুষ বা জাতিবিশেষ তার স্বাদেশিকতা এবং স্বাভাষিক আর স্বাজাতিক স্বার্থ ও স্বাতন্ত্র্য অটুট রেখেই ধার্মিক ভ্রাতৃত্বে আস্থাবান থাকবে ও এর অনুসারী হবে; আমরা যেমন একাধারে নিজের কাজও করি, দেশের কথাও ভাবি এ দুটোতে কোনো অসঙ্গতি বা বিরোধ নেই। ইসলামি ভ্রাতৃত্বের রূপ কার্যত এভাবেই ফুটে উঠেছে–মুসলিম জগতের ইতিহাস সর্বত্র এ সাক্ষ্যই বহন করছে। Pan Islamism বা বিশ্বমুসলিম ঐক্যবাদের যদি কোনো সদর্থ ও ব্যঞ্জনা থাকে, তবে তা এখানেই এবং এরূপই। . এজন্যেই দেখতে পাই বুতপরস্ত আরব ইসলাম বরণ করল, আগুন-পূজক ইরানি ইসলামে দীক্ষা। নিল; কিন্তু স্বদেশের ও স্বজাতির কুফরী ঐতিহ্য ত্যাগ করেনি, কিংবা স্বাদেশিকতা, স্বাভাবিকতা ও স্বাজাতিকতা ভোলেনি, অথবা আত্মস্বাতন্ত্র্য বিলোপ করে বিশ্বমানবতায় বা আন্তর্জাতিকতায় লীন হয়ে যায়নি। আত্মরতিতে নয়, আত্মপ্রেমেই অবশ্য বিশ্বপ্রেমের বীজ নিহিত থাকে। তাই দেখতে পাই, আদর্শ মুসলিম সুলতান মাহমুদ গজনবী মোমেন কবি ফিরদোসীকে দিয়ে লেখালেন শাহ্নামা যাতে রয়েছে অমুসলিম ইরানি বাদশাহ্ ও বীরের কাহিনী। কাজেই ইসলামানুগ আত্মজীবন চর্যার মাধ্যমেই বিশ্বমানব পরিচর্যার পাঠ গ্রহণ করতে হবে।