কোনো কোনো সাহিত্য-পত্রিকার প্রথমে একটা চিত্রও সন্নিবেশিত হয়। চিত্রকলার এমন কী সার্থকতা, বুঝা দুঃসাধ্য। যদি চিত্রটি ব্যাখ্যা করে দেবার ব্যবস্থা থাকত, তবু নাহয় চিত্রকলায় হাতেখড়ি দেবার প্রয়াস বলে ধরে নেয়া যেত।
শুধু বৈজ্ঞানিক আলোচনার জন্যে এদেশে কোনো কাগজ আগে বের হত না, এখন হয়, কিন্তু চলে না। দর্শন বা ইতিহাস সম্বন্ধেও তাই। ভাস্কর্য, স্থাপত্য, চিত্রকলা প্রভৃতি বিষয়ে পত্রিকা বের করার কথা চিন্তাও করা যায় না। তবে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার মতো প্রত্নতত্ত্বমূলক আলোচনার বিশেষ পত্রিকা আছে; কিন্তু দু-একটি মাত্র।
সম্প্রতি চলচ্চিত্র ও যৌনবিষয়ক বিশেষ পত্র বের হচ্ছে। রুচি ও আদর্শ সম্বন্ধে আমরা কিছু বলতে চাইনে, তবে বিশেষ বিশেষ বিষয়ের আলোচনার জন্যে বিশেষ বিশেষ পত্রিকার প্রকাশ-রুচি ও রসবোধের পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই শুভ লক্ষণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু গল্প বা শুধু কবিতার জন্যেও কাগজ বের হতে দেখা যায়, এ অবিমিশ্র একাগ্র সাধনা মার্জিত মনের পরিচায়ক।
তারপর আমাদের দেশে শিশু-সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াসও দুর্লক্ষ্য নয়; এজন্যে কয়েকখানা মাসিক বের হয়েছে, দৈনিক পত্রে সাপ্তাহিক আসরও রয়েছে। কিন্তু এদেশে শিশু-সাহিত্যের লেখক ও সম্পাদকের এত অভাব যে, শিশু-সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা কোনো নির্দিষ্ট পথ করে নিতে পারেনি। দুই বঙ্গে মাত্র জনকয়েক লেখক অবশ্য কিছুটা সফলতা অর্জন করেছেন, কিন্তু বাঙলাভাষী বিশাল শিশুসমাজের পক্ষে তাঁদের দান নিতান্ত সামান্য। যে-প্রতিভা ও সাধনা এ ব্যাপারে প্রয়োজন, এ পর্যন্ত তা আমাদের দেশে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সবচেয়ে যে-অভাবটা বেশি চোখে পড়ে, তা হচ্ছে কাগজগুলো আকর্ষণীয় করে বের করার অসামর্থ্য। শিশু পত্রিকায় রঙ বেরঙ-এর কার্টুন, খবরের ছবি, প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রভৃতি না থাকলে গল্প (যা প্রায় চির–পুরাতন), কবিতা, ব্যঙ্গ কবিতা, জ্ঞানের কথা বা উপদেশের মুরুব্বিয়ানা শিশুচিত্তে প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হবে না। য়ুরোপ-আমেরিকার। কাগজগুলোতে চিত্র, কার্টুন ছাড়া একটা পৃষ্ঠাও নেই। আমাদের মনোভাবও এর অভাবের জন্যে দায়ী। আমরা বিজ্ঞতা দেখাতেই ব্যস্ত, বোকা সাজতে জানিনে। ফলে হালকা কথা, হালকা হাসি আমাদের মুখে ফোটেই না। জ্ঞানগর্ভ কথা ছাড়া অন্য কথা আমাদের মনোমতো হয় না। আমরা যা পসন্দ করি, তাই শিশুকে পরিবেশন করতে চাই। এজন্যে আমাদের দেশে উৎসাহী শিশুপাঠকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। অনেকেই অভিভাবকের উপদেশ রক্ষার জন্যেই শিশু-পত্রিকাগুলো নাড়াচাড়া করে।
ছোটদের কথা গেল, বড়দেরও চিত্র, কার্টুন ও ফটোর প্রতি আকর্ষণ কম নয়। আমাদের দেশে ইংলন্ড-আমেরিকা থেকে যে-সব কাগজ আসে, তাদের অধিকাংশই চিত্র, কার্টুন ও ফটোতে পূর্ণ। এজন্যে আমাদের দেশে Illustrated weekly-র এত কদর। অথচ আজ পর্যন্ত বাঙলাভাষায় এরূপ একটা কাগজের কথা কল্পনাও করতে পারি না। দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে!
আমরা আগেই বলেছি, রুচি আদর্শের কথা বলব না; কেননা সম্পাদকের যোগ্যতা, রুচি ও আদর্শ পাঠকের রুচি ও আদর্শকে মার্জিত, সুস্পষ্ট ও বিকশিত করে তুলবে। স্বদেশী-বিদেশীর অনুকরণ-স্বীকরণ প্রভৃতি সম্পাদকের প্রতিভা ও যোগ্যতার উপরই নির্ভরশীল এবং পাঠকগোষ্ঠীর রুচি ও আদর্শ গঠনও সম্পূর্ণ নির্ভর করে সম্পাদকের উপর।
আমাদের শেষ বক্তব্য হচ্ছে; আমাদের দেশেও বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, সাহিত্য, ইতিহাস প্রভৃতির জন্যে বাঙলাভাষায় পৃথক পৃথক সাময়িকপত্র বের হোক। সিনেমা, চিত্রশিল্প, যৌনবিজ্ঞান, দেহতত্ত্ব প্রভৃতি সবকিছুরই আলোচনা হোক পাঠকের রুচি গরজ ও ঝোঁক অনুসারে। পাঠক এতে একান্তভাবে তার নিজের জ্ঞাতব্য নিয়ে বিশেষভাবে অধ্যয়নের সুযোগ পাবে। সাহিত্য-পত্রিকাগুলোর পরিবেশিত খিচুড়ি গেলার দায় থেকে পাঠকসাধারণ মুক্ত হোক–আমরা এ-ই চাই।
সাহিত্য রূপপ্রতীক
কিছুকাল আগে মুসলমান লিখিয়েদের বে-ইসলামি রূপপ্রতীক ব্যবহারের অনৌচিত্য সম্বন্ধে লেখা একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম। ওটি পড়ে আমাদের মনে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন জেগেছে :
প্রথমত, আমাদের ধারণায় ইসলাম হচ্ছে একটি ভাব বা আদর্শ কিংবা জীবন-বিধান বা জীবন-সংস্থা, যার সাধারণ নাম ধর্ম। কাজেই বিশ্বাস ও আচরণের ব্যাপারেই কেবল ইসলামি কিংবা বে-ইসলামি শব্দ বা সংজ্ঞার প্রয়োগ চলতে পারে। অন্যত্র ইসলাম শব্দের ব্যবহার অপপ্রয়োগ বই কিছুই নয়। নারঙ্গী কিংবা খোরমা বললে ইসলামি হবে, আর কমলা বা খেজুর বললে বুতপরস্তী হবে–এমন হাস্যকর যুক্তি শিক্ষিত মনে কী করে জাগে, ভেবে পাইনে।
দ্বিতীয়ত, ইসলাম পৃথিবীময় পরিব্যাপ্ত হয়েছে। তাই বলে মুসলমানের দেশ বা ব্যবহৃত সামগ্রীর সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক কী? আরবি মুসলমান গেঁও খায়, বাঙালি মুসলমান খায় ভাত। তাই বলে কী গেঁও আর ভাত ইসলামি হল? আরবের কোরআন আর রসুলই কেবল মুসলমানমাত্রেরই সাধারণ ঐতিহ্য, আর সে-সূত্রে এবাদতের ভাষা আরবিও। এ ছাড়া আরবের সঙ্গে মুসলমানদের অন্য কোনো সম্বন্ধ থাকার তো কথা নয়।
তৃতীয়ত, আরবেরা কোরআন গ্রহণ করল আর রসুলকে বরণ করল বটে কিন্তু তারা স্বদেশের ও স্বজাতির কুফরী ঐতিহ্যের গর্ব ছাড়েনি। ইরানেও দেখি তাই। য়ুরোপের খ্রীস্টানরাও গ্রীস রোমের pagan ঐতিহ্য ভোলেনি। আমরা যে ইসলাম ও ইসলামের উদ্ভব-ভূমির দোহাই দিয়ে স্বাদেশিক ও স্বাজাতিক ঐতিহ্য ভুলে আরবের বিয়াবান ও বসোরাই গোলাবের দিকে তাকিয়ে থাকবার নসিহত জারি করতে চাই–এরূপ চিন্তা দুনিয়ার কোনো জাগ্রত জাতি করে কী?