দুটো কারণে শব্দের সৃজন ও ঋণ গ্রহণ চলে : নতুন ভাব-চিন্তার উদ্ভাবনে এবং বস্তুর আবিষ্কারে। স্বদেশে যদি নতুন ভাব-চিন্তার উদ্ভব বা উন্মেষ হয়, কিংবা নতুন বস্তু তৈরি বা আবিষ্কৃত হয়, তা হলে নিজের ভাষাতেই সে-মনন প্রকাশক বা সে-বস্তু নির্দেশক শব্দ তৈরি হয়। আর যদি বিদেশী ভাব বা বস্তু নেয়া হয়, তা হলে প্রাসঙ্গিক বিদেশী শব্দকে নিজের ভাষায় ঠাঁই দিতেই হয়। একে রোধ করতে যাওয়া যেমন নিরর্থক, এ-গরজ ছাড়া বি-ভাষার শব্দ আনার অপচেষ্টাও তেমনি অসার্থক।..
সবলের পরিচয় আত্মপ্রসারে আর দুর্বলের স্বস্তি আত্মগোপনে। সবল পরাক্রান্ত আর দুর্বল সন্ত্রস্ত। সবল জানতে চায়, জানাতে চায়, সে বুঝতে উৎসুক আর বোঝাতে প্রয়াসী। সে দিকে-দিকে নিজেকে ছড়িয়ে দেয়ার অভিলাষী, ব্যাপ্তিতেই তার আনন্দ, তার জীবনোল্লাস, তার আরাম। তাই মানুষের মানসোল্লাস আজ গ্রহে-গ্রহে জীবন ও জীবিকার প্রসার খুঁজছে। দুর্বলের ধর্ম আত্মসংকোচন আর সবলের বিলাস আত্মবিস্তারে। দুর্বল Self-preservation-এ বা আত্মরক্ষায় ব্যস্ত, আর সবল Self-expansion-এ বা আত্মপ্রসারে রত। দুর্বল স্থবির, সবল চঞ্চল। একজন প্রাণহীনতায় অচল, অপরজন প্রাণপ্রাচুর্যে উল্লোল। দুর্বলের নিয়তি আত্মবিলোপে, সবলের তৃপ্তি আত্ম-উল্লাসে–মহিমার উজ্জ্বলতা সাধনে। আত্মার অপমৃত্যুতে দুর্বলের লয়, আর আত্ম-প্রতিষ্ঠায় সবলের জয়। তাই দুর্বলতা সমাজে ঘৃণ্য, আইনে অপরাধ ও ধর্মে পাপ।
আমরা রেনেসাঁ-দীপ্ত জাগ্রত জাতি। আমাদের তো দুর্বলতা থাকার কথা নয়। তাহলে। আমাদের ডর কিসে, আমাদের ভয় কাকে? দ্বন্দ্বে ভীত হয় কারা? আমরা তো দুর্বল নই! আমাদের তো দেবার-নেবার পালা সবে শুরু হল! এ বেনে-যুগে মানস-বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়লে কিংবা তাল ঠুকে চলতে না জানলে আমাদের জান নিয়ে টানাটানি পড়বে, তাতে জান যদি বাঁচে মন নিশ্চিতই হারাব। আর কে না জানে, মন-হারানো জান-হারানোর চাইতেও ক্ষতিকর। উঠতির লক্ষণই হচ্ছে নির্ভীকতা, উদারতা, প্রাণময়তা, মুখরতা, জিজ্ঞাসা, কর্মনিষ্ঠা ও চিন্তা ভাবনার প্রবহমানতা। আমরা নতুন জাতি, আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মব্যাপ্তিই আমাদের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও ব্রত। এতকালের আত্মসংকোচন ও জড়তার গ্লানি মুছে আত্মপ্রসারে ব্রতী হওয়াই তো কাম্য।
যে-প্রসঙ্গে এ আবেগের বন্যা ছুটল, সে-কথাই বলি : বুতপরস্তের আরবি, আগুন-পূজকের ফারসি এবং পৌত্তলিকের উর্দু ভাষা-বিজ্ঞান মতে বাক্যরীতির (Syntax) ধরন দিয়েই ভাষার জাত বিচার হয়, এই দৃষ্টিতে উর্দু ভারতীয় আর্যভাষাভুক্ত] যদি ইসলামি ভাষায় পরিণত হতে পারে, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানের ভাষা অবিকৃতভাবেই ইসলামি হতে বাধা কী? মুসলমানের মাতৃভাষা, মুখের বুলি হিন্দুয়ানি হতে পারে? আমরা না বলি–
চীন ও আরব হামারা
হিন্দুস্তা হামারা
মুসলিম হায় হাম
ওয়াতন হায় সারে জাহাঁ হামারা!
সাময়িকপত্র
পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ও মফস্বল থেকে প্রকাশিত সাময়িকপত্রের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। পাঠকসংখ্যা অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় কম হলেও এদেশের পক্ষে যথেষ্টই বলতে হবে। কিন্তু এসব পত্রিকার বৈচিত্র্যহীনতা রসজ্ঞ সুরুচিসম্পন্ন পাঠকের পক্ষে পীড়াদায়ক–এ-কথা অবশ্য স্বীকার্য।
প্রথমেই ধরা যাক, ধর্মসম্বন্ধীয় পত্র-পত্রিকাগুলোর কথা। আমাদের বাঙলা ভাষায় ধর্মসম্বন্ধীয় যেসব পত্রিকা বের হয়, তার ভেতরকার লেখাগুলোতে কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তিধারার অবতারণা করা হয় না। ভাবপ্রবণতা, একদেশদর্শিতা, মনোমতো সত্য ও অর্ধসত্য শাস্ত্রবচন উদ্ধৃতির কচকচি, যুক্তিহীন বিশ্বাসপ্রবণতা, অলৌকিকতা প্রভৃতির জাল-জঞ্জালে ওসব লেখা প্রায় সুরুচিসম্পন্ন লোকের অপাঠ্য। এ পর্যন্ত ইসলামিক রিভিয়ু ধরনের একটি পত্রিকাও বাঙলার মুসলমান সমাজে বের হয়নি, ফলে ধর্মকথা সম্বলিত যে-কোনো কাগজের প্রতিই ভদ্রলোক মাত্রই বিরূপ।
তারপর সাহিত্য পত্রিকা। সাহিত্য-বিষয়ক পত্রিকাই আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি চলে। কিন্তু নিছক সাহিত্য-আলোচনায় সীমিত থাকে না এসব কাগজের লেখাগুলো। বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম ও ইতিহাস প্রভৃতি হরেক রকমের বিষয়বস্তু এতে সন্নিবেশিত হয়, ফলে এসব পত্রিকা এমন একটা রূপ ধারণ করে যে, বিশেষ সূক্ষ্ম-দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি ছাড়া আর কারো চোখে এগুলোর বিকৃতি ধরা পড়ে না। প্রথমেই হয়তো প্রেম-সম্পর্কিত একটা কবিতা পড়লেন, পরপৃষ্ঠায় দেখলেন কোয়ান্টাম থিওরি সম্বন্ধে এক আলোচনা যেখানে আপনি সম্পূর্ণ অনধিকারী। এর পরেই হয়তো পড়লেন একটি রোমান্টিক গল্প; গল্পের রেশ হয়তো আপনার মনে লেগেই আছে; এমনি সময়েই পরপৃষ্ঠায় দেখলেন শাহজাহানের সিংহাসন লইয়া বিবাদ অথবা ইসলামে পর্দার বিধান গোছের কোনো আলোচনা। তারপর আবার গেলেন কবিতার সাক্ষাৎ যেখানে প্রকাশ পেয়েছে সর্বহারার নিপীড়িত হৃদয়ের মর্মান্তিক বিক্ষোভ। কোনো কোনো পত্রে, শেষের দিকে রাজনীতিচর্চার কসরৎও দেখা যায়। এমনি করে আমাদের মাসিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো এক বিচিত্র বস্তুতে পরিণত হয়!
এমন লোক আছেন, যাঁদের কেউ শুধু গল্প পড়েন, কেউ শুধু কবিতা পড়েন, কেউ বা শুধু প্রবন্ধ পড়েন আর কেউবা রাজনৈতিক আলোচনা পড়েন; অন্যকিছু পসন্দই করেন না। এতে অসুবিধাটা দেখুন। হয়তো আপনি গল্প পড়তে ভালোবাসেন, অথচ কাগজে গল্প আছে মাত্র দুটো। এখন দুটো গল্পের জন্যে আট আনা পয়সা খরচ করা উচিত কি-না, তা-ই আপনাকে পাঁচ মিনিট ভাবিয়ে তুলল। যদি কিনলেন হয়তো পরে পস্তালেন, না কিনেও হয়তো আপনার মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। তেমনি যারা কবিতা পড়তে চান, তারা দেখেন মাত্র চারটে কি পাঁচটা কবিতা আছে, এর জন্যে আটআনা খরচ করলেও পোষায় না, আবার না-পড়েও উপায় নেই। ধরুন, বিজ্ঞান কি ইতিহাসের কোনো একটিমাত্র বিষয় আলোচিত হয়েছে, বিষয়টা আপনার প্রিয়, কিন্তু শুধু ঐ একটা বিষয়ের জন্যে ছা-পোষা গরিব লোক আপনার পক্ষে আট আনা ব্যয় করা সম্ভব হল না, ফিরেই গেলেন–কিন্তু মনে মনে আফসোস রয়ে গেল। সেদিন আট আনা দিলেন না, অথচ আর একদিন তিন-চার আনা বাসভাড়া দিয়ে কোনো Public Library-তে পড়ে এলেন। লাভ-ক্ষতি মিলিয়ে দেখুন। সমস্যাটা কিন্তু হেসে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। প্রকাশক ও পাঠক উভয়পক্ষেরই ক্ষতি, তলিয়ে দেখুন।