অতএব আমাদের পুরোনো কথায় ফিরে যেতে হয় : ভাষা হচ্ছে ভাবের বাহন। ভাবই আসল, ভাষা হচ্ছে আনুষঙ্গিক। ভাব থাকলে ভাষা আপনিতেই আসে। ভাব ও ভাষায় আধেয় আধার সম্পর্ক। আধারের পরিবর্তনে আধেয় আকৃতি বদলায়, প্রকৃতি হারায় না। অতএব ভাষা, গৌণ, ভাবই মুখ্য।
এই উক্তির সার্থকতা ইসলামের ইতিহাসেও পাই। নবলব্ধ ইসলামি ধ্যান-ধারণার প্রভাবে, আরবি ভাষা পুরোনো কলেবরে নতুন অভিধা লাভ করে। এভাবেই আগুন-পূজক ইরানির ভাষা হয় ইসলামি। তারা আরবের ধর্ম নিল, কিন্তু নিজের ভাষা রাখল। তাই ইসলামের মৌল শব্দগুলোরও নিজেদের ভাষায় তর্জমা হল, তাতেই আরবের আল্লাহ, সালাৎ, সিয়াম, মক ও জান্নাত শব্দগুলো। ইরানে হল খোদা, নামায, রোযা, ফেরেস্তা আর বেহেস্ত।
এমনিই হয়। মাতৃভাষায় তর্জমা না হলে কোনো কথাই,–কোনো ভাব-ভাবনাই মনের কথা–প্রাণের কথা হয়ে ওঠে না। তাই তর্জমার প্রয়োজন ও আয়োজন। তাই ইসলামি ভাষা বলে। স্বীকৃত আরবি, ইরানি ও উর্দু ভাষায় লিখিত কেতাব তথাকথিত হিন্দুর ভাষা বাংলায় অনুবাদের প্রয়াস। আমরা তর্জমা করি, কেননা আমরা জানতে চাই, বুঝতে চাই। আমরা রচনা করি, কারণ আমরা নিজেদের জানাতে চাই, বোঝাতে চাই। অতএব, আমাদের শ্রদ্ধেয় ইসলামি ভাষাতে– আমাদের অভিপ্রায় পূর্ণ হয় না, উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না। তাই বিজাতির ও বিধর্মীর ভাষা বলে মেনে নিয়েও পবিত্র ইসলামের বাণী, মুসলিম-মনীষার ফসল নাপাক মাতৃভাষার মাধ্যতে পেতে চাই। নইলে হৃদয়ঙ্গম হয় না যে! তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য ইসলামের বাণী ও বুলিকে পবিত্র রাখা নয়, মাতৃভাষার মাধ্যমে পরিপাক করা। কাজেই ভাষার ইসলামিরূপের কথা এক্ষেত্রে উঠানই। নিরর্থক।
আর একটি কথা বলেছি, আমরা কথা রচনা করি; কেননা আমরা যা ভাবি, যা জানি তা অপরকে জানাতে চাই, অপরের হৃদয়-মনে সঞ্চারিত করে দিতে চাই। সে কী শুধু মুসলমানকে? সে কী কেবল স্বদেশবাসীকে? যদি বিশ্ববাসীকেও তা জানাতে চাই, তা হলে আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের আচারিক ও আনুষ্ঠানিক ইসলামের কথা আর কেউ শুনতে চাইবে না, তার বিশ্বজনীন মর্মবাণীই কেবল অপরকে আকৃষ্ট করবে। এর তাজা প্রত্যক্ষ প্রমাণ য়ুরোপ। সচেতন বা অচেতনভাবে আমরা প্রতিমুহূর্তে য়ুরোপ থেকে মানস-খাদ্য গ্রহণ করছি, কিন্তু কিরিস্তানীকে সযত্নে পরিহার করি–এড়িয়ে চলি। অথচ ভাব-জগতে যা কিছু য়ুরোপের দান–তার কতকাংশ নাস্তিক্যজাত হলেও অধিকাংশ আস্তিক্য বুদ্ধির ফল। সে-আস্তিক্য বুদ্ধি নিশ্চয়ই খ্রীস্ট-মত ভিত্তিক। তাদের আচারিক ও আনুষ্ঠানিক ধর্মবোধ ছাপিয়ে যা বিশ্বজনীন রূপ নিয়েছে, অর্থাৎ যা সর্ব-মানবিক হয়ে উঠেছে, তা-ই আমাদের গ্রহণযোগ্য হয়েছে, তাতেই আমাদের অধিকার বর্তেছে। অতএব, বিশ্বজনীন মানবিক আবেদন সৃষ্টি করতে হলে আমাদের ইসলামি ভাব ও বাণীকে অপরূপ করে তুলতে হবে, কেননা আগেই বলেছি স্কুলস্বরূপে তা অমুসলিমের শ্রদ্ধা পাবে না। এজন্যে আমাদের লক্ষ্য হবে-Form-এর পরিচর্যা নয়, Spirit-এর প্রতিষ্ঠা।
আবার বলছি, শব্দ হল ভাষা-সৌধের–বাক্য-দেহের বোবা উপাদান। বক্তা বা লেখকের অভিপ্রায় অনুযায়ী তা অভিধা পায়। এজন্যে প্রয়োগভেদে শব্দ অর্থান্তর লাভ করে। যেমন, গৌরব স্নেহ–pride, শ্রদ্ধা–ইচ্ছা, আকর্ষণ–respect, গঙ্গা–গঙ্গানদী, গাঙ–যে-কোনো নদী, যবন—Ionian-মুসলমান, পাষণ্ড-ধর্মসম্প্রদায়-দুবৃত্ত। এরূপ পঙ্কজ, গোপাল, করী। এছাড়া শব্দের একাধিক অর্থ তো রয়েইছে। যে-কোনো ভাষা সম্বন্ধে একথা সত্যি! আবার ভাব-বিবর্তনে অর্থাৎ নতুন ভাব-চিন্তার অনুপ্রবেশের সাথে সাথে বাক্-ভঙ্গিও বদলায়। ভাষা ও ভঙ্গি যে একান্তভাবে বক্তা বা লেখকের মনোভঙ্গির অনুগ, তার বিশিষ্ট প্রমাণ রবীন্দ্রনাথের রচনা। রবীন্দ্রনাথও পয়ার-ত্রিপদীতে কবিতা লিখেছেন, কিন্তু রূপে-রসে আগের ও তার সমকালের অনুরূপ কবিতার সঙ্গে এদের পার্থক্য কত! কথায় বলে Style is the man. তাই ব্যক্তিক-ভঙ্গিই সাহিত্যে বৈচিত্র্য আনে। আর ব্যক্তিক ভঙ্গি বিশিষ্ট হয় কেবল তখনই, নতুন ভাব-চিন্তার বীজ উপ্ত হয় যখন বক্তার মনোভূমে।
মানুষের মনন-চিন্তন নিত্য বিকাশমান। কাজেই তার নতুন ভাব-চিন্তা ধারণে সমর্থ পুরোনো শব্দগুলো স্ব-অর্থে টিকে থাকে, অন্যগুলো হয় বাদ পড়ে, নয়তো পুরোনো দেহে নব অভিধা নিয়ে বেঁচে থাকে। এতেও কুলোয় না, তাই অর্থগর্ভ ও ব্যঞ্জনাবহ নতুন নতুন শব্দ তৈরি হয়। সৃষ্টি প্রতিভা-সাপেক্ষ, তাই প্রয়োজনে উদ্দিষ্ট ভাব-বাহী শব্দ অপর ভাষা থেকে ধার নিতে হয়। এভাবে সৃজনে এবং ঋণে-ঋথে ভাষা পুষ্টি ও সমৃদ্ধি পায়। সভা করে এ গ্রহণ, বর্জন ও সৃজন চলতে পারে না। সৃষ্টির মুহূর্তে স্রষ্টার মন্ময় গরজেই তা সম্ভব হয়। শব্দের এই অভিধা, বিবর্তন ও শব্দ সৃষ্টির জগৎ এক বিচিত্রলোক। ব্যক্তির ভাব-চিন্তার ও অনুভূতি-উপলব্ধির মানস-সত্তার সংস্পর্শে শব্দ প্রাণময় ও বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। এ অনুভূত সত্য, কিন্তু অনির্বচনীয়। এ রহস্য একদা ভারতীয় ঋষিদের চমকে দিয়েছিল, তাই বিস্ময়-বিমুগ্ধ ঋষি-মুখে উচ্চারিত হয়: বাক্ ব্ৰহ্ম–শব্দই ব্রহ্ম। শব্দের অবয়বে মানুষের ভাব-সত্তা যে জীবন্ত মূর্তি পায়, এবং সুবিন্যস্ত শব্দ যে অসামান্য শক্তির আধার হয়ে ওঠে, আর এজন্যেই বাক যে জীবন-নিয়ন্তা ব্রহ্মস্বরূপ, তা ঋষিদের মন্ত্রদ্রষ্টা খ্যাতি থেকেই বোঝা যায়। গুঞ্জন ও মুখরতাতেই বাক্য-বদ্ধ শব্দের পরিচয়–বাক্যই মানসকে মূর্তি দেয়, ভাবকে দেয় মুক্তি–এভাবে বাথুদ্ধ হয় মানুষের আন্তসত্তা, ফুটে ওঠে জীবনের প্রতিচ্ছবি। ফলে। ভাষা অনুভূত-জীবনকে দেয় মূর্তি আর জীবনানুভূতিকে দেয় মুক্তি। এবং জীবন হচ্ছে জাগ্রত মুহূর্তের কতগুলো অনুভূতির সমষ্টি। তাই বলেছিলাম যেহেতু ভাষাই বোধের বাহন, ভাষাই জীবন।