রবীন্দ্রনাথ বলেছেনঃ
জীবনে যে সাধ হয়েছে বিফল
সে সাধ ফুটিছে (এবং মিটেছেও) গানে।
বরং এ আদর্শ জীবনীশক্তি বর্ধক ও সগ্রাম-শক্তি (resisting power) প্রদায়ক। যারা আজ ক্ষোভে-উত্তেজনায় নিতান্ত বস্তুতান্ত্রিকতার উপাসক হয়ে উঠেছেন, সে-ই অধিকারবাদের সংগ্রামীদলও উপলব্ধি করেন–জৈবক্ষুধার চেয়ে মনের ক্ষুধা অনেক তীব্র এবং স্কুল দৈহিক জীবনের যে-মনোজীবন রয়েছে, সেই অনুভূতির জীবনই সত্যিকার জীবন এবং সে-জীবন রসলোক-বিহারী–ডাল-ভাতের কাতর নয়। জগতের রূপ-রস সে-জীবনেরই সাধ-আহ্লাদের উৎস এবং ডাল-ভাত সে-জীবনে পুষ্টির সহায়ক মাত্র।
এ-কথা স্বীকার করার উপায় নেই যে, জীবনে শত অভাব-দুঃখের মধ্যেও এমন মুহূর্ত আসে, যখন —
আকাশ আমারে আকুলিয়া ধরে
ফুল মোরে ঘিরে বসে; কে
মনে না জানি জ্যোৎস্না প্রবাহ
সর্বশরীরে পশে।
ভুবন হইতে বাহিরিয়া আসে
ভুবনমোহিনী মায়া,
যৌবনভরা বাহু পাশে তার
বেষ্টনন করে কায়া।
জীবনকুঞ্জে–মনের বনে যে-বসন্ত আসে, তাকে ঠেকায় কে! বস্তুত গণ-সাহিত্যবাদী আর রস-সাহিত্যপন্থীদের উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন–তা হচ্ছে জীবনকে নির্বিঘ্নে উপভোগ করা। অতএব গণসাহিত্যবাদীদের ডাল-ভাতের সংগ্রাম সেই মনো-জীবন বা মনন-জীবনকে স্বচ্ছন্দে-নির্বিঘ্নে উপলব্ধি ও উপভোগ করবার জন্যেই। তারা আজ means (উপায় বা উপলক্ষ)-এর জন্যেই সংগ্রামরত, এই means (উপায় বা উপলক্ষ) যে end-এ (সিদ্ধিতে) পৌঁছাবে, তা অনুভূতির জীবন বা মনন-জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তুলবে। সুতরাং তাদের গণসাহিত্য অস্থায়ী সংগ্রামী সাহিত্য মাত্র–স্থায়ী রস-সাহিত্য নয়। যেদিন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন হবে–তাঁদের দাবীদাওয়া মিটবে, সেদিন তাদের হাতে যে-সাহিত্য পাব, তা হবে উপেক্ষিত বিগত যুগের সাহিত্যেরই পুনরাবর্তন। সেদিন আবার শিউলি, বকুল, যূথী, গোলাপ, নার্গিস, হাসুহানার গন্ধে এবং দ্রাক্ষাবনের বুলবুল ও বসন্তের কোকিলের ধ্বনিতে সাহিত্যকুঞ্জ মুখরিত হয়ে উঠবে! তাও হবে নতুন-পুরাতনের অনুবর্তন নয়। কেননা নতুন মানুষের মনে পুরোনো কখনো ফিরে আসে না স্বরূপে।
ভাষার কথা
কাছের মানুষকে আভাসে-ইঙ্গিতে মনের কথা–কাজের কথা হয়তো বুঝিয়ে দেয়া যায়, কিন্তু দূরের মানুষকে–ভবিষ্যতের মানুষকে–কাজের কিংবা মনের কথা কীভাবে বলা যায়? এ সমস্যা একদিন মানুষকে বিব্রত করেছে। এর সমাধান পেয়েছে মানুষ মুখ-নিঃসৃত ধ্বনি সৃষ্টি করে।
সেই আদিকালে এক জায়গার বা এক গোত্রের মানুষ মিলে চুক্তি করেছে, অতঃপর বিশেষ বিশেষ ধ্বনি দ্বারা বিভিন্ন বস্তু বা ভাব কিংবা আচরণ নির্দেশিত হবে। যেমন গরু বললে এক বিশেষ জীবকে বুঝব, ঘাস ধ্বনিতে বিশেষ বস্তুকে নির্দেশ করব, সুন্দর ধ্বনি দিয়ে এক বিশেষ ভাব ব্যক্ত করব, খাব বলে এক বিশেষ উদ্দেশ্য জানিয়ে দেব। এভাবে মানুষের ভাষা সৃষ্টি হল।
তাহলে ধ্বনি আসলে বোবা। মানুষের অভিপ্রায়ই তাকে অর্থ দান করে। ধ্বনিগুলোর অর্থবহতা একান্তভাবে স্থানিক বা গোত্রিক চুক্তি-নির্ভর। এইজন্যেই দুনিয়াতে এত ভাষা এবং একের ভাষা অপরের অবোধ্য। যে-লোক যে-ভাষাতে জন্ম থেকেই চুক্তিবদ্ধ হয়, সে-ভাষাই তার মাতৃভাষা। সে-ভাষা তার দেহের রক্তমাংসের মতোই একান্ত নিজের। আমরা যা কিছু অনুভব করি, যা কিছু ভাবি, তা এই ভাষার মাধ্যমেই হয়। কাজেই ভাষা হচ্ছে জীবনানুভূতির বাহন, বেশি করে বললে বলতে হয়, ভাষাই জীবন। তাহলে মাতৃভাষা থেকে বিচ্যুত হওয়া মানে অনেকাংশে জীবনকেই খণ্ডিত করা, ক্ষুদ্র করা, হয়তোবা ব্যর্থ করা। কচ্ছপকে উল্টিয়ে দিলে যেমন সে না চলতে পেরে আর না-খেতে পেয়ে মারা যাবে, তেমনি মানুষের মুখের ভাষা-ভাব-ভাবনার ভাষা কোনো কৌশলে ভুলিয়ে দিলে মানুষ হিসেবে তার অপমৃত্যু অনিবার্য।
এ-যুগে নয় শুধু, চিরকাল মানুষ অবচেতন মনে এ-কথা উপলব্ধি করেছে। তাই প্রত্যেকের স্ব স্ব ভাষা এত প্রিয়। তিনটে ধর্ম দুনিয়াময় পরিব্যাপ্ত হয়েছে : বৌদ্ধধর্ম, খ্রীস্টধর্ম এবং ইসলাম। বিজাতির ও বিদেশীর এসব ধর্ম মানুষ সাগ্রহে বরণ করে নিয়েছে; কিছু ধর্মের ভাষা কেউ নেয়নি, এসব ধর্মভাষা মন্দির, মসজিদ ও গীর্জার প্রাচীর পার হয়ে কারুর মুখের বুলি কিংবা মনের ভাষা হয়ে ওঠেনি এতকাল পরেও।
আগেই বলতে চেয়েছি, একটি বা একাধিক ধ্বনি-সমষ্টিতে হয় শব্দ, এবং শব্দের সঙ্গে শব্দের সুযোজনায় পাই ভাষা। ধ্বনি, শব্দ বা বাক্য বক্তার অভিপ্রায় অনুসারেই অর্থবহতা লাভ করে, নইলে ওগুলো বোবা। যেমন : খা, যা, ধূ, কৃ, হ প্রভৃতি প্রকৃতি বা ধাতুমূল বক্তার কোনো অভিপ্রায় নির্দেশ করে না, এগুলোর সঙ্গে বক্তার পরিচায়ক ও তার অভিপ্রায়-সূচক পুরুষ (Person), কাল ও ভাব (Mood) জ্ঞাপক চিহ্ন যুক্ত হলেই তা অর্থবহ শব্দ বা পদ হয়। তেমনি মানুষ শব্দের সঙ্গে বচন, লিঙ্গ, পুরুষ ও কারক চিহ্ন যোগ করলেই তা বক্তার অভিপ্রায় ব্যক্ত করবার যোগ্য হয়। এতেও হয় না, বক্তার অভিপ্রায়-অনুগ কণ্ঠস্বরও উচ্চারিত ধ্বনির সঙ্গে যুক্ত হওয়া চাই, তা হলেই শব্দ বা বাক্য অর্থগ্রাহ্য হয়। লিখিত ভাষায় বিভিন্ন চিহ্ন যোগে এবং পৌর্বাপর্য সূত্রে এ অভিধা পাওয়া যায়, তাই আমরা বর্ণ-নির্ভর ভাষার অর্থ গ্রহণে সমর্থ হই। অর্থাৎ বক্তার উদ্দিষ্ট অভিপ্রায় বুঝে নিই। যেমন বিভিন্ন চিহ্ন যোগে একই শব্দের–আদেশ, নির্দেশ, অনুনয়, প্রশ্ন, বিস্ময় প্রভৃতি সূচক অর্থ পাই। একটি দৃষ্টান্ত দিই : যাও। যাও! যাও? যাও, ইত্যাদি চিহ্নযুক্ত যাও পদটি বিভিন্ন অর্থ-ব্যঞ্জনা দান করছে।