সাহিত্য ব্যবহারিক জীবনের চিত্র না হোক, চিরকালই মানস-জীবনের আলেখ্য। এ অর্থেই সাহিত্য জীবন-মুকুর। এক এক দেশ, কাল ও মানুষের বিচিত্র জীবনের রূপ ফুটে উঠে সাহিত্যে। সে সে দেশ, কাল ও মানুষের পটভূমিকায় বিবর্তনশীল জীবনপ্রবাহে সমাজ ও সংস্কৃতি যেখানে যখন যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সাহিত্যের আঙ্গিকে, বিষয় নির্বাচনে, ভাবকল্পে আর ভঙ্গিতে অনুরূপ পরিবর্তন আসছে। আগের যুগের মানুষ ভূত-প্রেত-দেও-দানুতে বিশ্বাস রাখত, ঝাড়-ফুক-তুক তাক-দারু-টোনাতে ভরসা পেত; তাই তাদের রচনায় এ সবের ভয়, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধানিষ্ঠ চিত্র পাই। যেহেতু মানুষের কোনো আচরণ কিংবা মানস-অভিব্যক্তিই স্থানিক, কালিক ও ব্যক্তিক প্রভাবমুক্ত নয়, সেহেতু আগের কালের মানুষের রচনায় তাদের বিশ্বাস-ভরসা-ভয়-ভাবনা-আশা আরজু, ভাব-কল্পনার আন্তরিক প্রকাশ ঘটেছে। সেদিক দিয়ে তাঁদের সাহিত্যও বাস্তব আর জীবনানুগ। বিশ্বাস-সংস্কার ভেদে আজ আমাদের কাছে অলৌকিক ও অস্বাভাবিক। আজ আমরা তাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছি অনেক দূর, অনেক ব্যাপারেই তাদের সঙ্গে হারিয়ে ফেলেছি জ্ঞাতিত্ব, যোগসূত্র হয়ে এসেছে ক্ষীণ ও স্বাজাত্যবোধও হয়ে উঠেছে আবছা; তাই তাঁদের রচনা আজ আমাদের নিকট আজগুবি। মাটির মায়ামুগ্ধ, বস্তুনিষ্ঠ, মনস্তত্ত্ব প্রিয় ও জীবনরসিক আজকের পাঠক তাই সেকালের অলৌকিক-অবাস্তব জগতের বিবরণ পড়তে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে। সেকালের বিস্ময়বোধ আমাদের উপহাসের সামগ্রী, সেকালের রোমান্টিক ভাব-কল্পনা আমাদের চোখে অজ্ঞ অপরিণত শিশুমনের হাস্যকর বিলাসমাত্র। তাঁদের স্থূলতা পীড়াদায়ক এবং তাঁদের আন্তরিকতায় উজ্জ্বল বর্ণনভঙ্গিও বাল-ভাষণের মতো তুচ্ছ মনে হয়। এছাড়াও আজকের পাঠকের কাছে মধ্যযুগের সাহিত্য পরানুকরণ আর পুচ্ছগ্রাহিতা দোষে ক্লান্তিকর। তবু কালিক ব্যবধান মনে রেখে যদি শ্রদ্ধা নিয়ে মধ্যযুগের বৈচিত্র্যহীন সাহিত্য পাঠ করি, তাহলে সেকালের কবি ও কাব্যের প্রতি পুরো না হোক, কিছুটা সুবিচার করা সম্ভব হবে। তখন দেখা যাবে এ পুচ্ছগ্রাহিতার মধ্যেও কোনো কোনো কবি বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এবং আন্তরিকতায় স্নিগ্ধ।
সবচেয়ে বড় কথা–বাঙালি র চরিত্র, মানস ও জীবনধারার অন্তরঙ্গ ঐতিহাসিক ক্ৰম বিধৃত রয়েছে এ সাহিত্যে। কাজেই নিজেদের জানবার-বুঝবার জন্যেই এ সাহিত্যের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় প্রয়োজন।
বাঙালি র জীবনের ও স্বভাবের পটে আমরা মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য পরিক্রমা শেষ করলাম। অবশ্য একই সঙ্গে এ সাহিত্যের মুকুরে বাঙালি কে প্রত্যক্ষ করবার সুযোগও পেলাম। কেননা ফল দিয়ে কর্মের এবং কর্ম দেখে কর্তার ধারণা পাওয়া সম্ভব। পরিচয়ের ক্ষেত্রে কোনো জাতিকে তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মাধ্যমেই জানতে হয়। কেননা মানুষের যথার্থ প্রকাশ ও পরিচয় থাকে তার মানস-অভিব্যক্তির মধ্যেই। দূরের ও অতীতের মানুষকে জানবার এছাড়া অন্য উপায় নেই। আমরা দেখলাম–বাঙালি র চেতনা-চঞ্চল জীবন, বুদ্ধির চমক, অনুভবের বৈচিত্র্য, মননের দ্যুতি, তরঙ্গিত জীবন-ভাবনার অভিনবত্ব, সৃজনশীলতা ও গীতোচ্ছাস এ সাহিত্যের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু তা কখনো সার্থক ফলপ্রসূ হয়ে তাদের জীবনে ও সমাজে সুষ্ঠু অগ্রগতির সহায়ক হয়নি। তার কারণ, যারা দেশের নেতা ও সমাজের প্রতিভূ, তাদের জাত্যভিমান তাদের দেশাত্মবোধকে ছাপিয়ে উঠেছিল। বৰ্ণহিন্দু ছিল উত্তর ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুধ্যানে নিরত, আর বিত্তবান মুসলমান ছিল আরব-ইরানির জ্ঞাতিত্ব স্বপ্নে বিভোর আর হয়তো তুর্কী-মুঘল গৌরবগর্বেও স্ফীত। দেশগত জীবন ও পরিবেষ্টনীগত প্রয়োজন সম্পর্কে কেউ তেমন সচেতন ছিল না। ফলে স্বাদেশিকবোধ ও স্বাধীনতার স্পৃহা কখনো জাগেনি তাদের মনে। কাজেই আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠা তথা দেশ-নির্ভর স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্যে তাদের আকাক্ষা ও কর্ম কখনো নিয়ন্ত্রিত হয়নি। তারা সুস্থ ছিল না, কাজেই সুস্থ চিন্তা সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। এর ফলে পরিণামে পূর্ববঙ্গ হয়েছে পাকিস্তান আর পশ্চিমবঙ্গ হয়েছে উত্তর-ভারতের কাছে বিক্রিত।
তবু বাঙলাদেশে ইসলামী সংস্কৃতির বিস্তারই যে বাঙালি র মনোরাজ্যে নবচেতনা এনে দিয়েছিল এবং এতে যে তাদের মানস-জগৎ বিপ্লবমুখী ও সৃজনশীল হয়ে উঠেছিল অর্থাৎ ইসলাম ও তুর্কী মুসলমানের সান্নিধ্য যে এ চেতনার ও প্রেরণার উৎস তা অস্বীকার করা যাবে না। এ ছিল অনেকটা এ যুগের প্রতীচ্য প্রভাবের মতো।
প্রতীচ্য প্রভাবে ও প্রতিভার পরিচর্যায় মাত্র চৌত্রিশ বছরে–১৮৪৭ সনে বিদ্যাসাগরের হাতে শুরু হয়ে ১৮৮০ সনে রবীন্দ্রনাথে উত্তরণে–আধুনিক বাঙলাভাষা ও সাহিত্যের যে-বিস্ময়কর বিকাশ সম্ভব হয়েছে, সেরূপ প্রতিভার স্পর্শ পায়নি বলে আটশ বছরেও মধ্যযুগের বাঙলাভাষা ও সাহিত্যের তেমন দ্রুত ও বিচিত্র বিকাশ হতে পারেনি। তবু এ ভাষা ও সাহিত্যকে হিন্দু মুসলমানের মানস-ফসলরূপে গ্রহণ করব।
মধ্যযুগের বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য বাঙালি মুসলমানের বিশেষ গর্বের অবলম্বন হতে পারে। কেননা, এ ভাষা ও সাহিত্যের চর্যায় বাঙালি কে প্রবর্তনা দেন সুলতান-সুবাদার। এর অন্যতম আদিকবি ও প্রণয়োপখ্যানের আদি-লেখক শাহ মুহম্মদ সগীর (১৩৮৯-১৪০৯ খ্রী.)। রোমান্সের সর্বশ্রেষ্ট রচক ও মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী দৌলত। বাঙলার প্রথম মৌলিক ও রূপক কাব্য সত্যকলি বিবাদ সম্বাদ-এর (১৬৩৫ খ্রী.) রচয়িতা মুহম্মদ খান। বাস্তব প্রতিবেশে মাটির মানুষের জীবনচিত্র ও প্রণয় কাহিনী রচনা করেছেন লায়লীমজনুর কবি দৌলত উজির বাহরাম খান ও পূর্ব-বাঙলার গাথাকারগণ। বাঙলাকাব্যের ভাষাকে পরিশ্রুত ও নাগরিক লাবণ্যদান করেন। শাবারিদ খান ও আলাউল। মুসলমান কবিও সংখ্যায় হয়তো অমুসলমান কবির চেয়ে কম ছিলেন না। এভাবে বাঙলা সাহিত্যের সৃষ্টি, পুষ্টি ও বৈচিত্র্যের মূলে রয়েছে মুসলমানের বিশেষ সাধনা ও দান।
বুর্জোয়া সাহিত্য বনাম গণসাহিত্য
অত্যাধুনিক যুগে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রাদর্শের পরিবর্তন সাধনার্থ বিশেষ মত প্রচারের জন্যে এক ধারার সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে, তাকে বলা হচ্ছে প্রচার সাহিত্য, বিপ্লবী সাহিত্য বা গণসাহিত্য। অধুনা দুনিয়াব্যাপী এই ধারার সাহিত্য-সৃষ্টিরই সাধনা চলছে। আধুনিক যুগে মানুষ ব্যবহারিক জীবনে শোষণ, অত্যাচার, পীড়ন ও অভাব-অনটন-জর্জরিত হয়ে নিছক বস্তুতান্ত্রিক হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছে। অধিকাংশ লোকের ডাল-ভাতের সংস্থান না থাকায় যেন তারা বুনিয়াদী শিল্প-কলা, স্থাপত্য-ভাস্কর্য প্রভৃতির উপর মনের উত্তেজনায় মারমুখী হয়ে উঠেছে। বস্তুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কলকারখানা স্থাপিত হওয়ার ফলে ধনবৈষম্য মানুষের ব্যবহারিক জীবনে এনেছে ক্ষোভ আর গ্লানি, মনন-জীবন করেছে পঙ্গু। বেঁচে থাকাই যখন দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে, তখন মনুষ্যত্ব-বিকাশক বৃহৎ ও মহতের সাধনায় আত্মনিয়োগ করা বা শিল্পকলা ও রুচি-সৌন্দর্যে অনুরাগ প্রদর্শন সম্ভব নয়।