আমাদের এ-কথা ভুললে চলবে না যে শ্ৰমিক-নেতা যেমন শ্রমিক নন, কৃষক-নেতা যেমন চাষী নন, জননেতা যেমন জনগণের নাগালের বাইরে, তেমনি লেখকগণও সাধারণত অনভিজাত নন। কাজেই যে-সমাজ থেকে লেখকের আবির্ভাব সে-সমাজই এখন ধ্যান করছে গাড়ি-বাড়ির। কাজেই গণ-সমাজের প্রতি তাদের সে-নজর কোথায়–যে দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করলে দুদবোধ ও সহানুভূতির ছোঁয়ায় গণহৃদয়-মন ও আশা-আরজু লেখকের নিজ হৃদয়-মনে মুকুরের মতো প্রতিফলিত হয়? উনিশ শতকের কোলকাতার মধ্যবিত্তদের মতোই আত্মসর্বস্ব হয়ে উঠেছে এই বিত্তশালীরা।
আমাদের সামাজিক জীবনের আর এক মস্ত বিড়ম্বনা–মিথ্যা আত্মসম্মান-বোধ ও আভিজাত্যচেতনা। যে-কেউ একটু লেখাপড়া করে, সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বলে আত্মপরিচয় দেয়। আসলে আমাদের সমাজে সাম্প্ৰত-পূর্ব যুগে শ্ৰেণী হিসেবে কোনো মধ্যবিত্ত ছিল না। আসলে সবাই বিত্তহীন। চাকুরি না করে যে খেতে-পরতে পারে না, সে বিত্তবান হয় কী করে! একজন দিনমজুর বা রিকশাওয়ালা ও আমাদের তথাকথিত মধ্যবিত্তের মধ্যে বিত্তের দিক দিয়ে তফাৎ কোথায়! কাজ না পেলে ওরও ভাত জুটে না, এরও আহার মেলে না। এ আত্মপ্রবঞ্চনা-আর্তনাদকে আস্ফালন দিয়ে ঢাকবার এ চেষ্টা আমাদের নিজেদেরও স্বরূপ উপলব্ধির পথে প্রবল বাধা। তাই আজো আমরা অকপটে আত্মকথাও শিল্পায়ত করতে পারিনি। মধ্যবিত্ত নামে পরিচিত এই বিত্তহীন বা স্বল্পবিত্ত শ্রেণীর মতো অসহায় দুঃখী মানুষ এদেশে সত্যিই আর নেই। এদের বিত্তের সঙ্গে বৃত্তি বেসাত যুক্ত না হলে দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোটানো মুস্কিল, বৃত্তি যা জোটে তা সামান্য কেরানিগিরি, নয় মাস্টারি। আজকের দুর্মূল্যের দুর্দিনে যে জীবন-যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তাতে দাঁড়াবার ঠাই পাচ্ছে না, এরা কুলি-মজুরের চাইতেও অসহায়। কেননা এরা দুঃখের কথা কইতেও পারে না, সইতেও পারে; ভিক্ষাবুলিও নেয়া চলে না, গাছতলায় বাস করতে পারে না। এবং এদের জীবনবোধ অশিক্ষিতদের চেয়েও বেশি বলে বেদনাও তীব্রতর।
আবার বিক্ষুব্ধচিত্তেও সার্থক সৃষ্টি সম্ভব নয়। তাতে চিত্ত বিক্ষোভজাত উচ্ছ্বাস শিল্পীর সংযমবোধ ও রসদৃষ্টি ব্যাহত করে। এ ধরনের সৃষ্টি সাধারণত হয় গীতাত্মক বা বিবৃতিমূলক। সার্থক সৃষ্টির জন্যে শান্ত, সমাহিত অথচ সহানুভূতি ও সংবেদনশীল মনোভঙ্গির প্রয়োজন, পরিমিত দূর থেকে বা উপর থেকে দেখলে যে-কোনো বস্তু বা ঘটনার সামগ্রিক স্বরূপ যেভাবে দৃষ্টিগোচর হয়, ভেতর থেকে তা কখনো সম্ভব নয়, সে-অবস্থায় শুধু বিচ্ছিন্ন ও খণ্ডিত রূপই চোখে পড়ে। তা ই চিত্রিত করতে গেলে খাপছাড়া হয়ে ওঠে।
আর একটি ক্রটি প্রায়ই চোখে পড়ে। আমাদের অনেক গল্প-লেখক মনে করেন, গীতিকবিতার সঙ্গে ছোটগল্পের বিশেষ পার্থক্য নেই। অনুভূতি ও ভাবের দিক দিয়ে হয়তো এ ধারণা আংশিক সত্য, কিন্তু আঙ্গিকের দিক দিয়ে এদের আসমান-জমিন তফাৎ। কিন্তু তাঁরা তাঁদের অনুভূত তত্ত্বটি সংলাপের ও বিবৃতির মাধ্যমে কোনোরকমে প্রকাশ করেই ছুটি নিতে চান। ফলে অনেক গল্পই রূপে ও রসে তথা আঙ্গিকে ও চিত্রণে গল্প হয়ে ওঠে না। সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখাতে চাইলে যেমন শুধু দিগন্তে একটা সূর্য এঁকে দিলেই হয় না; আকাশ, নদী, গাছপালা, কুটির প্রভৃতির উপর অস্তায়মান সূর্যের রশ্মি ছড়িয়ে সূর্যাস্তকালীন দৃশ্য পরিস্ফুট করতে হয়, তেমনি গল্পের বক্তব্যের অনুকূল প্রতিবেশ বা পটভূমিকা সৃষ্টি করে বক্তব্যকে শিল্পায়ত করতে হয়। এ-না হলে গল্প অচল।
আর একটা বিষয় যথাযযাগ্য গুরুত্ব সহকারে আমাদের বুঝে দিতে হবে। যন্ত্র- বিজ্ঞানের প্রভাবের ফলে এ যুগে জনজীবনে বিপর্যয় এসেছে। সে-বিপর্যয় আর্থিক ও মানসিক। আমাদের আনন্দের পিপাসা আছে, অথচ আনন্দ নেই। আনন্দের সামগ্রী যতই বাড়ছে ততই আনন্দ যেন আলেয়ার মতো ফাঁকি দিচ্ছে, মরীচিৎকার মতো শুধু মানসিক পীড়নই বাড়াচ্ছে। য়ুরোপ তাই বিক্ষুব্ধ, চঞ্চল আর ব্যাকুল শান্তি ও আনন্দের সন্ধানে কেমন যেন ছটফট করছে। আমাদের দেশেও সে অবস্থা এল বলে!
আগের দিনে আনন্দ-উৎসব ছিল পার্বণিক ব্যাপার, নিত্য ঘটত না। তাই যাত্রা, পাঁচালি, খেলা প্রভৃতির আয়োজনের উত্তেজনায় ও স্বপ্নে কাটত কয়দিন, আর স্মৃতিতে মাধুর্যে কাটত বহুদিন। এভাবে কেটে যেত স্বপ্ন ও স্মৃতিঘেরা বছর। অবরুদ্ধ বধূ বাপের বাড়ি নাইরে যাবার স্বপ্নে, নাইহরের সুখ-উত্তেজনায় আর নাইহর অন্তে তার মধুর স্মৃতি মন্থন করে সহজেই বছর ফুরিয়ে দিতে পারত। আর আজ সিনেমা, খেলাধূলা, ভ্রমণ, কিছুই যেন চোখে নতুন ঠেকে না, মনে লাগায় দোলা। শহুরে মেয়েরা নাইরে প্রিয়-পরিজনের সান্নিধ্যের মাধুর্য আর কল্পনাও করতে পারে, অবাধে চলাফেরার সুবিধে সেই সুখ-স্বপ্ন ও উল্লাস থেকে বঞ্চিত করেছে তাদের। তার উপর পৃথিবী একখানি ছোট মানচিত্রের মতো ঝুলে রয়েছে চোখের সামনে। বিদ্যার প্রসারে, আর বইপত্রের বদৌলত আগ্রহ ও কৌতূহল জাগাবার কোনো অজানা-অচেনা বস্তুই রইল না, সবকিছু পড়া-পাঠেরে মতো মনে হয় পুরোনো, নীরস ও একঘেয়ে। তাই আজকের দিনে উচ্চবিত্তের মানুষের মনেও স্বপ্ন বা স্মৃতি কোনোটাই ঠাই পায় না। মানবের মনোজীবনের এই শ্রান্তিও মনুষ্যজাতির একটা বড় সঙ্কট। এই বিড়ম্বনাও আজকের রাষ্ট্রিক ও অর্থনীতিক দ্বন্দ্ব-হানাহানির জন্যে কতকটা দায়ী। তৃপ্তি নেই, আনন্দ নেই। তাই স্বস্তি আর শান্তিও দুর্লভ। এতে একটা নৈরাশ্যবাদ আমাদের পেয়ে বসেছে, আশাবাদ জাগাতে হবে আমাদের মনে।