কেবল ধর্মের ক্ষেত্রে নয়, ব্যবহারিক জীবনেও নানাভাবে নানাদিকে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা সেদিন নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি-সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিল প্রচুর। সাহিত্যে-শিল্পে-স্থাপত্যে সঙ্গীতে সর্বত্র এর সাক্ষ্য মেলে। এ ধারায় চললে আজ বাঙলার সংস্কৃতি কী রূপ নিত কল্পনা করা সম্ভব কিন্তু নিরর্থক। কারণ ইংরেজ আমলে অভিজাত ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চেষ্টায় রামায়ণ-মহাভারত ও বেদান্তের বহুল চর্চা হিন্দু-মানসকে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যবাদমুখী করে দিল, আর ওহাবী-ফারায়েজী আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানেরাও শরীয়ত-অনুগ জীবনাদর্শ গ্রহণে প্রয়াসী হল এবং আরব-ইরানি তমদুনের প্রতি অনুরাগ তাদের রক্ষণশীল করে তুলল। অথচ এখানেই একদা মানবতার মহত্তম বাণী উচ্চারিত হয়েছিল :
নানাবরণ গাভীরে ভাই
একই বরণ দুধ
জগৎ ভরমিয়া দেখিলাম
একই মায়ের পুত।
নিম্নবিত্তের এ মিলনমুখী প্রাকৃত মননধারা প্রবল হলেও অভিজাতদের মধ্যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র এবং স্বধর্ম রক্ষার একটি সদা সচেতন প্রয়াস ছিল। উনিশ শতকে খ্রীস্টধর্ম প্রচার প্রতিরোধে ব্রাহ্মমতের যে ভূমিকা ছিল, পনেরো শতকে স্মার্ত রঘুনন্দনাদি প্রবর্তিত নবস্মৃতি তজ্জাত নবশাখ ব্রাহ্মণ্যমতও ইসলামের মোকাবেলায় সে-ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। মুসলমান বিতাড়নও নাকি তাদের লক্ষ্য ছিল, যথাসময়ে গৌড়-সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তা টের পেয়ে তাঁদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দিলেন। এ ব্যর্থতা থেকেই হিন্দুর ধর্ম ও সমাজ রক্ষার নতুন উপায় উদ্ভাবন করলেন শ্রীচৈতন্য। যদিও হিন্দুসমাজে বাহ্যত বিরোধ ও বিভেদ সৃষ্টি হবে বলে সুলতান খুশি হয়ে শ্রীচৈতন্যকে প্রশ্রয় ও সর্বপ্রকার সহায়তা দিতে প্রস্তুত ছিলেন, তবু ইসলামের প্রসার-প্রতিরোধই লক্ষ্য ছিল বলে চৈতন্যদেব মুসলিম অধিকারে থেকে তার মত প্রচারে সাহসী হননি। তাই উড়িষ্যার হিন্দুরাজ্যে (নীলাচলে) বসেই তিনি তাঁর মত প্রচার করেন। এজন্যে বাঙলাদেশে বৈষ্ণব সাহিত্য যত প্রসার লাভ করেছে, বৈষ্ণব মত তত গৃহীত হয়নি। তবু চৈতন্যদেবের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল; ইসলাম সত্য সত্যই আর প্রসার লাভ করেনি বরং কিছুসংখ্যক মুসলমান বৈষ্ণবমত গ্রহণ করে। বৈষ্ণবমত মুসলমান সমাজ-মানসকেও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছিল। আগেই বলেছি সূফীমতের অনুকরণেই বৈষ্ণব মতের উদ্ভব; সে সাদৃশ্যের ছিদ্রপথেই মুসলিম-মানসে রাধাকৃষ্ণ সূফীতত্ত্বের দেশী রূপক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
এদিকে শিক্ষিত মুসলমানেরা ইসলামের প্রতি মুসলমানের আনুগত্য দৃঢ়মূল করবার উদ্দেশ্যে, ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে পরিচয় নিবিড় করবার প্রয়াস পায়। তাই নবী বংশ, রসুল চরিত, ও নানা মসলা-মসায়েল গ্রন্থ রচিত ও প্রচারিত হয়েছে। এ সঙ্গে তাদের ধর্মের ও সংস্কৃতির উৎসভূমি আরব-ইরানপ্রীতি জাগানোর চেষ্টাও ছিল। হয়তো এভাবে মুসলমানদেরকে বহির্মুখী করে রেখে তাদের ধর্মানুরাগ ও আরব-ইরান প্রীতির সুযোগে শাসকরা নির্বিঘ্ন শাসন কায়েম রাখার প্রয়াসী ছিল। এর আভাস মেলে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষার প্রতি বিরূপতায় এবং সগীর, সৈয়দ সুলতান, আবদুল হাকিম প্রভৃতির মাতৃভাষার প্রতি প্রীতিজাত বিদ্রোহে এবং মাতৃভাষা ও উর্দু নিয়ে উনিশ-বিশ শতকের শিক্ষিত মুসলমানের মানসদ্বন্দ্বে ও বাহ্যাচরণে°২। পুরুষানুক্রমে তাদের মুখের বুলি বাঙলা। তারা উর্দু জানত না, দু-চারজন উর্দুভাষী বিত্তবানের নেতৃত্বে তারা স্বপ্ন দেখত উর্দুর। এবং সভা ডেকে এই বাঙালি রাই বাঙলা বক্তৃতার মাধ্যমে ঘোষণা করত–উর্দুই তাদের মাতৃভাষা ও জাতীয় জবান। কেবল বিজাতির ষড়যন্ত্রেই তাদের এ সাময়িক বিস্মৃতি ঘটেছে। শেষ অবধি এই অভিজাত দলেরই জয় হল। কেননা আজো হিন্দু ও মুসলমান স্ব স্ব স্বাতন্ত্রে সমুন্নত রয়েছে।
কিন্তু উচ্চবিত্তের মুসলমানের এ প্রয়াস বাঙালি মুসলমানের মানস ও সাংস্কৃতিক জীবন আটশ বছর ধরে পঙ্গু করে রেখেছে। তারা আজো স্বদেশে প্রায় প্রবাসী হয়েই আছে। অজ্ঞতা-অশিক্ষার জন্যে আরব-ইরানি সংস্কৃতিও তারা আয়ত্ত করতে পারেনি, মানস-বিরূপতা বশত দেশী সংস্কৃতিও স্বাভাবিক বিকাশ পায়নি তাদের জীবনে। তাই কোনো মৌলিক চিন্তা, মননের কোনো ঐশ্বর্য তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। তাদের ভাব-ভাবনা কোথাও কোনো স্পষ্টরেখায় ফুটে উঠেনি। এজন্যে তারা আজো না ঘরকা, না ঘাটকা অবস্থায় রয়েছে, আজাদী-উত্তর এ বিশ বছরেও তাদের মনের দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঘোচেনি এবং যদিবা মাতৃভাষা সম্পর্কে দ্বিধামুক্ত হয়েছে, তবু তার রূপ সম্পর্কে নির্ঘ হয়নি। তাই রব উঠেছে : হরফ বদলাও, শব্দ বদলাও, নাম বদলাও, বদলাও ভাব, বদলাও ভঙ্গি, বদলাও বিষয়। তারা বাঙলার মানুষ, কিন্তু দৃষ্টি তাদের আরব-ইরানে। অস্বীকৃত বাস্তব ও অসফল স্বপ্নের টানাপড়েনে তারা আজো দিশেহারা। এ বিশ বছরেও তারা দেশ ও ধর্মের সমন্বয় ঘটিয়ে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মননের ক্ষেত্রে পথ ও পাথেয় খুঁজে পেল না। এমন মানস-বিপর্যয় পৃথিবীর আর কোনো দেশের মুসলমানের জীবনে দেখা যায়নি।
কেউ কেউ মুসলমানের রচনায় সংস্কৃত সাহিত্য ও হিন্দু পুরাণের প্রভাব লক্ষ্য করে থাকেন। এ-কথা মোটামুটি স্বীকার্য যে হিন্দু-মুসলমানের রচনায় আঙ্গিক ও ভাষাগত প্রভেদ ছিল না। এর কারণ, অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত হিন্দু-মুসলমান বাঙালি অবিশেষের জন্যে বাঙলায় সাহিত্য সৃষ্টি করতে যেয়ে মুসলমান লেখকেরা ভারতের classic ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতেরই দ্বারস্থ হয়েছেন। জনগণের অপরিচিত আরবি-ফারসি শব্দ, অলঙ্কার ও প্রতাঁকের শরণাপন্ন হয়নি। যাদের জন্যে। লেখা, তাদের অজ্ঞাত অলঙ্কার ও রূপ-প্রতীক প্রয়োগে রচনা ব্যর্থ হত। এজন্যেই আমরা আজো পারত পক্ষে ইংরেজি সাহিত্যের রূপ-প্রতীক বাঙলায় ব্যবহার করিনে। এক কথায় খ্রীস্টান য়ুরোপ যে-গরজে ও যে-মনোভাব নিয়ে সাহিত্যে Pagan Greek ও Latin উপাদান গ্রহণ করেছে, মুসলমান লেখকগণও অনুরূপ কারণে অতিপরিচিত সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের উপাদান নিয়ে বাঙলায় সাহিত্য-সৌধ গড়ে তুলেছেন। একে হিন্দুয়ানী প্রভাব বলা অসমীচীন। এ হিন্দু-সংস্কৃতির প্রভাব নয়, দেশী উপাদান গ্রহণ–যাতে এঁদেরও উত্তরাধিকার ছিল। বাঙলা ভাষা তার পুষ্টির জন্যে জ্ঞাতি সংস্কৃতের থেকে ঋণ নেবে, এ-ই তো স্বাভাবিক। তা চর্যাপদের কাল থেকে চলেও আসছে। আজকের দিনে পরিভাষা নির্মাণের কাজেও লাগছে সংস্কৃতই।