এমনি বিপর্যয়ের মুখে দেশজ মুসলমানেরা ও হিন্দুরা রাজশক্তির উপর আস্থা হারিয়ে অগত্যা জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্যে উপদেবতা সৃষ্টি করে পূজা-শিরনী, দিতে থাকে। এরূপে ষোলো শতকের শেষপাদ থেকে সত্যনারায়ণ-সত্যপীর, বনদেবী-বনবিবি, কালুরায়-কালুগাজী, দক্ষিণরায় বড় খ.গাজী, শীতলা-ওলা, ষষ্ঠী-উদ্ধার-বাস্তুদেবী হিন্দু-মুসলমানের পূজা পেতে থাকে। অন্যদিকে নিম্ন ও উত্তর-পশ্চিম বাঙলার কিছুসংখ্যক বাঞ্ছত লোক বাউল-বৈরাগী জীবনে আত্মপ্রসাদ খুঁজতে থাকে। অবশ্য রাজধানী থেকে দূরে এবং সুফলা বলে পূর্ববাঙলায় এসব উপদেবতার প্রভাব কমই পড়েছে এবং চট্টগ্রামে শরীয়ত-অনুগ ধর্মসাহিত্য ষোলো শতকের শেষপাদ থেকেই রচিত হতে থাকে। অবশ্য ১৬৬৬ সন অবধি উত্তর চট্টগ্রাম এবং ১৭৫৬ সন অবধি দক্ষিণ চট্টগ্রাম রোসাঙ্গ রাজ্যভুক্তই ছিল, কাজেই সেদিক দিয়ে চট্টগ্রাম বাঙলার বাইরে এবং সে কারণে উপদ্রুত অঞ্চলও নয়।
ষোলো শতক থেকে বাঙালি র প্রধান দেবতা সত্যনারায়ণ বা সত্যপীর। হিন্দু যে-কিছুকে নারায়ণ ভাবতে পারে, কিন্তু একেশ্বরবাদী মুসলমানের পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাই মুসলমান নারায়ণকে পীরের মর্যাদা দিয়েছে। একে অবলম্বন করেই মুঘল আমলে দুঃখী ও বিমূঢ় হিন্দু মুসলমান জীবনের ও জীবিকার দুর্দিনে এক মিলন-ময়দানে এসে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। তাদের এ। মিলন-রাখী হল সত্য (Truth) এবং প্রমূর্ত সত্যই যুগপৎ সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর নামে পূজা শিরনী পেতে থাকেন দুঃখীর দেবতারূপে। ষোলো শতক থেকে আজ অবধি ষাট-সত্তর জন সত্যনারায়ণ পাঁচালিকারই এঁর অপ্রতিহত প্রভাবের সাক্ষ্যদান করছেন। অল্লোপনিষদের মতো। সত্যপীরও হিন্দুর মানস-প্রসূত। শাসক-শাসিতের মধ্যেকার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ঘোচানোর উদ্দেশ্যেই শাসিত হিন্দু কর্তৃক এ মুসলিম-দেবতা পরিকল্পিত। এমনি সমন্বয় প্রয়াস বৈষ্ণব সহজিয়া ও বাউলদের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করি। চৈতন্যাবতার মুসলিম ফকির আউলচাঁদ ও মদিনার মাধব বিবিই তাদের সাধন-পন্থার প্রবর্তক ও প্রচারক বলে পরিকীর্তিত। নিত্যানন্দ তাঁর পুত্র। বীরদ্রকে বলেছেন :
শীঘ্র করি যাহ তুমি মদিনা সহরে……
তথা যাই শিক্ষা লহ মাধব বিবির সনে,
তাহার শরীরে প্রভু আছেন বর্তমানে।
মাধব বিবি বিনে তোর শিক্ষা দিতে নাই
তাঁহার শরীরে আছেন চৈতন্য গোঁসাই।
—(বীরভদ্রের শিক্ষামূলক কড়চা)
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আপোস ও ঐক্যের এ প্রয়াস নিম্নবর্ণের ও নিম্নবিত্তের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অনেকাংশে সফল হয়েছিল। দেশজ মুসলমানেরাও ইসলামের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সহজপন্থা হিসেবে হিন্দুর দেবতার গুণসম্পন্ন কিন্তু প্রবলতর প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে দাঁড় করাল কয়েকজন কাল্পনিক পীর ও কয়েকজন ঐতিহাসিক বীরযোদ্ধাকে, যারা দেবকল্প পীরের মর্যাদায় তাদের জাতীয় বীর ও ধর্মীয় নেতারূপে পরিকল্পিত। জাফর খা গাজী (দরাফ খা), মোবারক গাজী, ইসমাইল গাজী, খানজাহাঁ খাঁ গাজী, সফীউদ্দিন গাজী প্রভৃতি সেননী-শাসক এবং গোরাচাঁদ, বাবা আদম, পীর বদর প্রমুখ দরবেশ আর বড়খা গাজী, কালুগাজী, মানিক পীর, মছলন্দ পীর, বনবিবি, প্রভৃতি কাল্পনিক পীরের সঙ্গে হিন্দু রাজার ও দেবতার দ্বন্দ্ব-মিলনের উপাখ্যান মাধ্যমে হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমঝোতা ও মিলন সম্ভব হয়েছিল। দরাফ খার মহাত্মকথা, মানিকপীরের কেচ্ছা, গাজীকালু চম্পাবতী উপাখ্যান কিংবা দক্ষিণ রায়, বনবিবি, সত্যপীর প্রভৃতির কাহিনী তার সাক্ষ্য।
কিন্তু স্বার্থসচেতন, জাত্যভিমানী, বিত্তবানেরা স্বাতন্ত্রের মধ্যেই খুঁজেছেন স্বস্তি ও প্রতিষ্ঠা। যেহেতু এঁরাই দেশের ধন-জনের মালিক, জয় হল তাদেরই। সত্যনারায়ণ মুসলমান পীর, তাই শিরনীই তাঁর ভোগ। বাঙলার বাইরেও এঁর প্রতিষ্ঠা ছিল। লালমনের কিসসায় গৌড় সুলতান হোসেন শাহর (১৪৯৩-১৫১৯) উল্লেখ রয়েছে। কেউ কেউ সত্যপীরকে হোসেন শাহর রক্ষিতা গর্ভজাত বাস্তবপুরুষ বলে বিশ্বাস করে। সতেরো শতকের কবি রূপরাম চক্রবর্তী ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে ধর্মকে করেছেন আদর্শপীর আর নিজে হয়েছেন ফকির। হিন্দুদের ফকির চাঁদ, ফকির দাস, ফকির রায় প্রভৃতি নাম থেকেও হিন্দুসমাজে মুসলমান ফকিরের প্রভাব অনুমান করা যায়। সত্যপীর রচয়িতা উত্তরবঙ্গের কবি কৃষ্ণ হরিদাসের গুরু ছিলেন মুসলমান কবি তাহের মুহম্মদ। ইনিও সত্যপীর পাঁচালির রচয়িতা :
তাহের মামুদ গুরু শমস নন্দন
তাহার সেবক হয়ে কৃষ্ণ হরি গান।
এভাবে দক্ষিণ রায়, কালুরায়, সত্যপীর, বড় খা গাজী প্রভৃতি হিন্দু-মুসলিম দেবতা-পীরের বিরোধ-মিলনের মধ্যদিয়ে বাঙলার হিন্দু ও মুসলমান সামাজিক ও ধর্মীয় মতাদর্শের রফা খুঁজেছে–বিষ্ণু আর বিসমিল্লাহ কিছু ভিন্ন নয়। কর্মকুণ্ঠ, পরনির্ভরশীল, ভীরু ও ভোগবাদী বাঙালি চিরকালই শক্তির উপাসক। যেখানে ইষ্ট বা অরি শক্তির প্রকাশ দেখেছে সেখানেই সে পূজায় তৎপর রয়েছে। অপ্রত্যক্ষ দেবতার সঙ্গে তাই অসামান্য শক্তিধর মানুষকেও সে পূজা করেছে। ঐতিহাসিক যুগে এর আরম্ভ জৈন-বৌদ্ধ ভিক্ষু-সাধু সেবায় এবং সমাপ্তি বীর-পূজায়। এদেশে ইসমাইল গাজী, খানজাহান খান, জাফরখান প্রভৃতি সেনানী-শাসক পর্যন্ত দেবকল্প হয়ে পূজা শিরনী পাচ্ছেন।