দোভাষী পুথিতে যে ইসলামি আবহ সৃষ্টির তথাকথিত প্রয়াস আছে, তাও লজ্জাকর। নিন্দা বা প্রশংসা করবার জন্যেও যোগ্যতা চাই। অযোগ্য মুখে নিন্দা বা প্রশংসা দু-ই ব্যাজস্তুতি হয়ে পড়ে। ফকির গরীবুল্লাহ ছিলেন পীর-পূজারী, তাও লোক-শ্রুতির কাল্পনিক পীর দেবকল্প বড় খাঁ গাজী। তাঁর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব স্বীকৃত নয়। সত্যপীরও তাঁর অন্যতর জীবন-নিয়ন্তা। দোভাষী শায়েরেরা ইসলামের উন্মেষ যুগের নানা বীরের ও দেবকল্প নানা পীরের কাহিনী নিয়েই প্রধানত পুথিগুলি রচনা করেছেন। যে-কথা বিজাতিরা বললে মুসলমানেরা রুষ্ট হয়, সেই একহাতে কোরআন আর হাতে তরবারি নিয়ে রসুল, হযরত আলী, হামজা, হানিফা প্রমুখ দিগ্বিজয়ীরা পরাজিত রাজা ও অধিকৃত রাজ্যের মানুষকে বলপ্রয়োগে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করে মুমিনের কর্তব্য করলেন বলে উল্লাস ও কৃতার্থ বোধ করেছেন, তাঁদের পুরনারীরা পরপুরুষের সঙ্গে দ্বন্দ্বে ও মল্লযুদ্ধে নেমেছেন। হিন্দুর দেব-কাহিনীর অনুকরণে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পটভূমিকায় আল্লাহ, রসুল ও ফেরেস্তার সমবায়ে দেবকল্প মুসলিম বীরের ও পীরের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এ যেন বাস্তবজীবনে গ্লানি ভুলবার জন্যে ইসলামের গৌরবদিনের স্বপ্নলোক সৃষ্টি করে পর-পীড়িত জাতির আত্মপ্রবোধ লাভের অপপ্রয়াস।
সূফীভাবের নানা কাহিনী রচনায়ও আদর্শচেতনা সর্বত্র দেখা যায় না। আবার শঙ্কা ও অনিশ্চয়তাবোধ থেকে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার সহায় হিসেবে উপদেবতার উদ্ভব হয়েছে। কেবল সত্যপীর নয়; বনবিবি, ওলাবিবি, কালুগাজী, বড় খা গাজী, উদ্ধার বিবি, বাস্তুবিবি প্রভৃতির পূজা শিরনীও চালু হল একেশ্বরবাদী মুসলমান সমাজে। এঁদের সম্বন্ধে কাহিনী গড়ে উঠে ষোলো শতকে, কিন্তু এঁদের মাহাত্মকথা তথা পীর-পাঁচালি রচিত হয়েছে মুখ্যত উনিশ-বিশ শতকে। কাজেই এ সাহিত্য আমাদের জাতীয় জীবনে দুর্যোগ-দুর্দিনের ঐতিহাসিক দলিল–গৌরবের কিংবা গর্বের সামগ্রী নয়। এ Predawn darkness নয়–অমাবস্যার তমিস্রা। রেনেসাঁসের নয়–পতনের ও গ্লানির প্রতিচ্ছবি। অতএব, এ আত্মবিকাশকল্পে আত্মবিস্তার-প্রয়াস নয়। এমনি দুর্দিনের সাক্ষ্য বাঙলার ইতিহাসে আরো রয়েছে, এমনি দুর্যোগের ঘনঘটা আগেও বাঙালি র ভাগ্যাকাশে দেখা দিয়েছে, তখনো অসহায় বিমূঢ় বাঙালি অনুরূপ দিশেহারা ভাব দেখিয়েছে।
॥ বাঙালি র জীবন ও মননধারা ॥
যখনই সামাজিক ও আর্থিক জীবনে নিরাপত্তা ও স্বস্তির অভাব ঘটেছে, তখনই বাঙালি অধ্যাত্মজীবনের বৃহৎ ও মহৎ আদর্শ ত্যাগ করে জীবন-জীবিকার সহায় শক্তিদেবতার সন্ধান করেছে; আর দেবতার কৃপাজীবী হয়ে বাঁচতে চেয়েছে। তাই আমরা পালরাজাদের পতন যুগে নৈরাত্ম-নিরীশ্বরবাদী নির্বাণকামী বৌদ্ধসমাজকে অসংখ্য দেব-দেবীর স্তব-স্তুতিতে মুখর দেখতে পাই। মাটির মায়ামুগ্ধ জীবনবাদী বৌদ্ধেরা অমরত্বের ও চিরসুখের প্রত্যাশায় যোগতান্ত্রিক সাধনার মাধ্যমে দৈবশক্তিধর হয়ে নিশ্চিন্তে ও নির্বিঘ্নে জীবনোপভোগের প্রয়াসী হয়ে উঠল। তুকতাক দারু-টোনার শক্তি আয়ত্ত করে বৌদ্ধ ডাকিনী-যোগিনীরা কামাচার-সর্ব যে বীভৎস জীবনলীলা শুরু করল, তা রূপকথার আকারে আজো ভয়ঙ্কর, চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর হয়ে চালু আছে। রাঢ় অঞ্চলের সাধারণ বৌদ্ধের জীবন-জীবিকার সহায়ক দেবতা হিসেবে এক আদিম সূর্যদেবতা ধর্মঠাকুর নামে পূজিত হতে থাকেন।
শঙ্করের প্রচারিত অদ্বৈতবাদ ও জ্ঞানবাদের প্রভাবে বাঙলাদেশেও ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন-শাসনকালে তাদের প্রতিপোষকতায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম বাঙলার লোকধর্মে পরিণত হল, আর তাদের বিরূপতায় বৌদ্ধমত লোপ পেল। এই সেনদের মন্দার দিনে তুর্কী বিজয়ের কিছু আগে থেকেই সুমহৎ বেদান্ত দর্শনে আস্থা হারিয়ে বাঙালি জনসাধারণ আবার তাদের অনার্য সংস্কারানুসারী পার্থিব জীবন-জীবিকার ইষ্ট ও অরি দেবতার পূজায় ব্রতী হয় আত্মরক্ষার ও আত্মপ্রসারের গরজে। মনসা ও চণ্ডীই এঁদের মধ্যে প্রধান। অপরদিকে গীতগোবিন্দে ও শেখ শুভোদয়ায় বাঙালি র চারিত্রিক শৈথিল্য ও কাঙাল মনের পরিচয় পাচ্ছি।
তুর্কী পরাজয়ে পেলাম সত্যপীর, দক্ষিণরায়-বড় খা গাজী, কালুরায়-কালু গাজী, বনদেবী বনবিবি, শীতলা-ওলা-ষষ্ঠী-বাস্তুদেবী প্রভৃতি; আর মুঘলশক্তির পতনে পেলাম বিদ্যাসুন্দর ও পীর পাঁচালি আর কবিওয়ালা ও শায়ের।
বাঙলা দেশে তথা পাক-ভারতে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে প্রথমত ও প্রধানত সূফী সাধকদের মাধ্যমে। দেশী প্রাকৃতজন ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নয়, দরবেশ প্রচারকদের কেরামতির আকর্ষণে ও প্রভাবেই ইসলাম বরণ করেছিল। কাজেই শরিয়তি ইসলামের সঙ্গে তাদের নিবিড় পরিচয় হয়নি। তবু গৌড় সুলতানদের আমলে ইসলাম জনমনে কিছুটা জাগ্রত ছিল। কিন্তু ১৫৭৫ খ্রীস্টাব্দে বাঙলাদেশে নামত মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুঘলে-পাঠানে তথা রাজশক্তি ও সামন্তশক্তির মধ্যে বহুবর্ষব্যাপী যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছিল এবং তার ফলে যে শাসনতান্ত্রিক বিপর্যয় ও রাষ্ট্রিক অনিশ্চয়তা দেখা দিল আসলে শেরশাহর বঙ্গবিজয় (১৫৩৯ খ্রী) থেকেই এর শুরু। তাতে প্রাকৃতজনের ধন-প্রাণ নিরাপদ ছিল না। আকবর-জাহাঙ্গীরের আমল এভাবে কেটে যাওয়ার পর যদিও শাহজাহান-আওরঙ্গজীবের আমলে দেশে শক্তির দ্বন্দ্ব ছিল না, তবু সাত সমুদ্র না হোক, তেরো নদীর ওপারের দিল্লী শাসনে জনগণের আর্থিক দৈন্য ঘোচেনি। কেননা আর সব সাম্রাজ্যবাদীর মতো মুঘলেরাও ছিল কেবল শাসনে তৎপর ও শোষণে উৎসুক, প্রজার হিতসাধনের দায়িত্ব নেয়নি তারা। শাহজাহানের আমলে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল এবং মগ-হার্মাদ দৌরাত্ম্যে মানুষ ত্রাসের মধ্যে বাস করত আর আওরঙ্গজীবের আমলে বেনে স্বেচ্ছাচার বেড়ে গিয়ে নতুন উপসর্গ হয়ে চেপেছিল, এসবের সঙ্গে ক্রমে যুক্ত হল বিদ্রোহ-বিগ্রহ, বগী বর্বরতা, সুবাদারের স্বেচ্ছাচার, সামন্ত স্বৈরাচার ও বেনে দৌরাত্ম। তারপর পলাশী-উত্তর অর্ধ-শতাব্দীর শাসনতান্ত্রিক অব্যবস্থা ও আর্থিক দুর্গতি মারাত্মক হয়ে দেখা দিল।