রাধাকৃষ্ণ রূপকে জীবাত্মা-পরমাত্মার প্রেমবিষয়ক সূফীমতের অধ্যাত্ম সঙ্গীত যারা রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে মীর ফয়জুল্লাহ, মির্জা কাঙালী, সৈয়দ মোর্তুজা, নসির মাহমুদ, সৈয়দ সুলতান, চাঁদ কাজী, আলাউল, ফাজিল নাসির মুহম্মদ, সৈয়দ আইনুদ্দীন, মোহসেন আলী, আবাল ফকির, পীর মুহম্মদ, বকশা আলী, এবাদুল্লাহ, শেখ ভিখন, শেখ ফতন (ফতেহ), আলিমুদ্দিন, মনোহর, আফজল, শমসের আলী, আলি রজা এশাদুল্লাহ, সফতুল্লাহ, আলি মিয়া, মোহাম্মদ হানিফ, কমর আলি, চম্পা গাজী, মোহাম্মদ হাসিম প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।
বাউল গান আমাদের তত্ত্ব-সাহিত্যের অন্যতম শাখা। মুসলিম প্রভাবে তথা সূফী মতবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে ও সংযোগে বাউল মতের আধুনিক রূপান্তর হয়েছে সত্য, কিন্তু এর মূল রয়েছে প্রাচীন ভারতে। আদিকাল থেকেই যে-কোনো ধর্মে দৈহিক শুচিতাকে মানস শুচিতার সহায়ক বলে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মনে হয় এই বোধেরই পরিণতি ঘটেছে দেহাত্মবাদে ও দেহতত্ত্বে। সাংখ্যে, যোগে, বৌদ্ধ দর্শনে ও সূফী সাধনতত্ত্বে দেহের বিশেষ মূল্য রয়েছে। দেহের আধারে যে-চৈতন্য, সে-ই তো আত্মা। এ নিরূপ-নিরাকার আত্মার স্বরূপ মানুষকে করেছে কৌতূহলী। এ থেকে মানুষ বুঝতে চেয়েছে–দেহযন্ত্র নিরপেক্ষ আত্মার অনুভূতি যখন সম্ভব নয়, তখন আত্মার রহস্য ও স্বরূপ জানতে হবে দেহ-যন্ত্র বিশ্লেষণ করেই। এভাবেই সাধনতত্ত্বে যৌগিক প্রক্রিয়া অসামান্য গুরুত্ব পেয়েছে। তাই এদেশের অধ্যাত্ম সাধনায় যোগাভ্যাস একটি আবশ্যিক আচার। সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্র পাক-ভারতের আদিম অনার্য শাস্ত্র। বৌদ্ধযুগে এর বহুল চর্চা দেখা যায়। বাঙলার পাল আমলের তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের একটি শাখাই প্রাচীন যুগে সহজিয়া গানে ও মধ্যযুগে বৈষ্ণব-সহজিয়া পদে আর পরবর্তীকালে বাউলগানে রূপ পেয়েছে।
উনিশ শতকের আগে রচিত বাউলগান দুর্লভ। বাউলগানের প্রধান কবি ফকির লালন সাঁই, শেখ মদন, পাগলা কানাই, তিনু, আতর চাঁদ, শ্রীনাথ, নলিন চাঁদ, হীরালাল, মেছেল চাঁদ, সদাই সাই, খেদমত সাঁই, ইরফান সাঁই, শীতলাং সাঁই, গোপাল প্রভৃতি।
মুরশিদা-মারফতি গানের কবি হচ্ছেন সৈয়দ শাহানুর, মুন্সী হোসেন আলী, রহিমুদ্দিন ফকির, রজবউদ্দিন, মিয়াধন, মোতালেব, নজির হোসেন বুরহানি, ফজলুল শিকদার, সাওয়াল শাহ (রমজান আলী), খতিশাহ (আবদুল মজিদ), উসমান, উমর আলী, হেকিম আবদুল মালেক, সৈয়দ আবদুল বারী, হাসান উদাস, শেখ কিনু প্রভৃতি। এবং চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডার খানকার ভক্তগণের রচিত গানগুলোও এ শ্রেণীর অন্তর্গত। অধিকাংশ মুর্শিদা-মারফতি গানে বাউল প্রভাব লক্ষণীয়।
মুসলিম বিজয়ের পরে হিন্দু ও মুসলমানের বিপরীতমুখী ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘর্ষে প্রথমে দক্ষিণভারতে পরে উত্তরভারতে এবং সবশেষে বাঙলা দেশে হিন্দুসমাজে যে আলোড়ন হয় তার বাহ্যরূপ ছিল ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় প্রয়াস। হিন্দুর মায়াবাদ তজ্জাত ভক্তিবাদ ও ইসলামের সূফীতত্ত্বই এসব আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছে। দক্ষিণ ভারতের ভক্তিধর্ম, উত্তরভারতের সন্তধর্ম, এবং বাঙলার বৈষ্ণবধর্মও বাউল মত সূফীমতের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল।
আত্মা পরমাত্মার অংশ। কাজেই আত্মাকে জানলেই পরমাত্মাকে জানা যায়। তাই দেহাধারস্থিত আত্মাকে জানাই বাউলের ব্রত।
ক. সখীগো জন্ম-মৃত্যু যাহার নাই
তাহার সঙ্গে প্রেম গো চাই।
উপাসনা নাই গো তার
দেহের সাধন সর্ব সার।
তীর্থব্রত যার জন্য
এই দেহে তার সব মিলে।
খ. খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মনোবেড়ী দিতাম তাহার পায়।
গ. এ দেহের মাঝে আছেরে সোনার মানুষ
ডাকলে কথা কয়।
বাউলেরা তাদের ভাষায় অচিন পাখি অলখাই (অলক্ষ্য স্বামী), মনের মানুষ বা মানুষ রতন-রূপ আত্মা তথা পরমাত্মাকে জানবার সাধনা করেন। বৈষ্ণব বা সুফীর মতো এঁরা প্রেমিক নন, যোগীর মতো তাত্ত্বিক। মুর্শিদা-মারফতি ও বাউল গান আমাদের লোকসাহিত্যের অন্তর্গত। বাউলেরা উদার মানবতাবাদী। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি তাদের মধ্যে দুর্লক্ষ্য। বাউল মত ও সত্যপীরকে কেন্দ্র করে বাঙলার নিম্নবিত্তের হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মিলন সম্ভব হয়েছিল।
॥ জীবনী সাহিত্য।
মুসলমান কবিগণ এক বিরাট জীবনীসাহিত্যও সৃষ্টি করেছেন। চৈতন্যদেব ও তাঁর অনুচরদের চরিতকথাগুলো যেমন একাধারে জীবনী, ইতিহাস, দর্শন, ধর্মকথা, ও কাহিনীকাব্য; এসব চরিতাখ্যান তেমন নয়। এখানে বাস্তব-অবাস্তব, লৌকিক-অলৌকিক কিংবা প্রাকৃত-অপ্রাকৃতের সীমারেখা মানা হয়নি। এখানে কল্পনা ইতিহাসাশ্রিত নয়। চরিতাখ্যানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জৈনুদ্দিনের রসুল বিজয় (১৪৭৩ খ্রী.) সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ (১৫৮৬ খ্র.), শাহ বারিদ খানের হানিফার বিজয় ও রসুল বিজয়, শেখ ফয়জুল্লাহর গাজী বিজয়, শেখ চাঁদের রসুলবিজয়, নসরুল্লাহ খোন্দকারের জঙ্গনামা, আবদুল নবীর আমীর হামজা, গরীবুল্লাহ (পশ্চিমবঙ্গ) ইউসুফ-জোলেখা; আমির হামজা; সৈয়দ হামজার (পশ্চিমবঙ্গ) আমীর হামজা, হাতেম তাই; উজীর আলীর নসলে উসমান ইসলামাবাদ (ইতিহাসমূলক) এবং বিভিন্ন কবির কাসাসুল আম্বিয়া, সিফাতুল আম্বিয়া ও অন্যান্য আউলিয়া কাহিনী প্রভৃতি। এগুলো রচিত হয়েছে। মুখ্যত মুসলমানদের মুসলিম ঐতিহ্য-গর্বে উদ্বুদ্ধ করে তাদের মনে স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যেই।