.
১০.
॥ তত্ত্বসাহিত্য।
মানুষের মনে জগৎ ও জীবন সৃষ্টির রহস্য এবং জগৎ ও জীবনের মহিমা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে যে চিরন্তন ও সর্বজনীন জিজ্ঞাসা রয়েছে তারই মনোময় জবাব খোঁজা হয়েছে আমাদের ধর্ম ও অধ্যাত্মজীবন সম্পর্কিত রচনায়। বাস্তবধর্মী শক্তিমানের জিজ্ঞাসা মানুষকে করেছে বিজ্ঞানী; ভাববাদী দুর্বলকে তা-ই করেছে তাত্ত্বিক ও দার্শনিক। একই জিজ্ঞাসা আপাতবিরোধী দু-কোটির চিন্তা ও কর্মের প্রেরণা ও জন্ম দিয়েছে। এই একই জিজ্ঞাসা কাউকে দিয়েছে বহিষ্টি, কাউকে দিয়েছে অন্তদৃষ্টি। বহিদৃষ্টি মানুষকে করেছে বিষয়ী ও বিজ্ঞানী। অন্তদৃষ্টি মানুষকে করেছে রহস্যবাদী; গড়ে তুলেছে আধ্যাত্মবাদ, দিয়েছে বৈরাগ্য বা ইহবিমুখতা, জাগিয়েছে জীবনের জীবনের পিপাসা। বৈরাগ্য প্রাচ্যের মানস-সম্পদ আর বিজ্ঞান পাশ্চাত্যের ঐশ্বর্য। দু-টোরই মূল প্রেরণা জিগীষা। একটার লক্ষ্য আত্মজ্ঞান, অপরটার কাম্য দুনিয়ার জয়। একটা সম্বল হৃদয় ও মনোবল, অপরটার হাতিয়ার বুদ্ধি ও বাহুবল। একটি হৃদয়বৃত্তিক লীলা, অপরটি প্রাণধর্মের অভিব্যক্তি।
তত্ত্বচিন্তা মানুষকে তিন মার্গের সন্ধান দিয়েছে–জ্ঞানের, কর্মের ও ভক্তির। জ্ঞানবাদ আস্তিক্য, নাস্তিক্য ও সংশয়প্রবণ দর্শনের জন্ম দিয়েছে। কর্মবাদ সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রবিধি গড়ে তুলেছে। আর ভক্তিবাদ হয়েছে নিষ্ঠা ও বৈরাগ্যের উৎস এবং ভক্তিবাদের উপজাত (by product)-কারুর কারুর মতে পরিণতি হচ্ছে প্রেমবাদ।
বাঙলা ভাষারও এই তত্ত্বজিজ্ঞাসা তিন ধারার সাহিত্য সৃষ্টির উৎস হয়েছে, এগুলো: ধর্মসাহিত্য, তত্ত্বসাহিত্য ও অধ্যাত্ম প্রেমগীতি।
ক. ধর্মসাহিত্যে উল্লেখ্য হচ্ছে : নেয়াজ ও পরানের (১৬ শতক) কায়দানী কেতাব; খোন্দকার নসরুল্লাহর (১৭ শতক), হেদায়তুল ইসলাম, শরীয়তনামা; শেখ মুতালিবের (১৬৩৯ খ্রী.) কিফায়তুল মুসল্লিন, আলাউলের তোহফা, খোন্দকার আবদুল করিমের (১৮ শতক) হাজার মোসায়েল, দুল্লামজলিস; আশরাফের (১৭ শতক) কিফায়তুল মুসল্লিন, আবদুল্লাহর (১৮ শতক), নসিয়ত নামা, আলী রজার (১৮ শতক) সিরাজকুলুব, কাজী বদিউদ্দীনের (১৮ শতক), সিফৎ-ই ইমান, সৈয়দ নাসিরউদ্দীনের (১৮ শতক) সিরাজ সবিল, বালক ফকির ও মুহম্মদ মুকিমের (১৮ শতক) ফায়দুল মুকতদী, সৈয়দ নূরুদ্দিনের (১৮ শতক) দাকায়েতুল হাকায়েক, রুহুনামা, রাহাতুল কুলুব; মুহম্মদ আলীর (১৮ শতক) হায়রাতুল ফেকাহ্, হায়াৎ মাহমুদের হিতজ্ঞানবাণী, সর্বভেদ বাণী প্রভৃতি।
খ. তত্ত্ব সাহিত্যে সাধারণত যোগ ও সূফী সাধন-তত্ত্বের মিশ্রণ ঘটেছে। সমাজ ও ধর্মের আচারগত প্রভেদ সত্ত্বেও শাসক-শাসিত সম্পর্কের অন্তরালে দুটো ভিন্নাদর্শ জাতির মধ্যে কী নিবিড় প্রাণের যোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে এ ধরনের রচনায়। জীবনের যে চিরন্তন প্রশ্নে আত্মার আকুলতা, উদার পটভূমিকায় ও বিস্তৃত পরিসরে তার সমাধান খুঁজতে চাইলে জাত, ধর্ম ও সমাজচেতনার ঊর্ধ্বে উঠতেই হয়। মানস-সংস্কৃতির এরূপ লেনদেন, এমনি আত্মিক যোগাযোগ চিরকালই মানুষের চিত্ত-প্রসারের ও আত্মবিকাশের সহায়ক হয়েছে।
ইরানি সূফী সাধনাও যৌগিক প্রক্রিয়া-নির্ভর। পাক-ভারতের যোগসাধনার সঙ্গে পরিচয়ের পরে সূফীদের দেহতত্ত্বের সঙ্গে যোগশাস্ত্রের সার্থক মিশ্রণ ঘটিয়ে উভয় প্রক্রিয়ার সমন্বয় সাধন করে যিনি পাক-ভারতে মুসলিম সমাজে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন, তাঁর নাম শেখ শরফুদ্দীন বু আলী কলন্দর শাহ (মৃত্যু ১৩২৪ খ্র.)। তাঁর প্রবর্তিত সাধনপদ্ধতির বাঙলা নাম যোগ কলন্দর। পানিপথে তার সমাধি আছে। উত্তরভারতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আর তাঁর খ্যাতি আজো ম্লান হয়নি। একসময়ে বাঙলায় কলন্দরপন্থী বৈরাগীর সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, কলন্দর বলতে মুসলিম বৈরাগীই বোঝাত। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে আছে :
কলন্দর হৈয়া কেহ ফিরে দিবারাতি।
ঋণ কড়ি নাহি দাও, নহ কলন্দর।
এই তত্ত্ব বা সূফী সাহিত্যে পাই ষোলো শতকের শেখ ফয়জুল্লাহার গোরক্ষ বিজয়, সৈয়দ সুলতানের জ্ঞানপ্রদীপ, অজানা কবির যোগকলন্দর, কবি হাজী মুহম্মদের সুরতনামা বা নুরজামাল; সতেরো শতকের কবি শেখচান্দের হর-গৌরীসম্বাদ, শাহদৌলপীর বা তালিবনামা, আবদুল হাকিমের শিহাবুদ্দীননামা ও চারিমোকামভেদ, মীর মুহম্মদ সফীর নুরনামা; আর আঠারো শতকের কবি আলি রজার আগমজ্ঞানসাগর, কাজী মনসুরের শিনামা, শেখ জেবুর আগম, শেখ জাহেদের আদ্য পরিচয়, রমজান আলীর আদ্য ব্যক্ত, মোহসীন আলীর মোকাম মঞ্জিলের কথা প্রভৃতি।
গ. সওয়াল সাহিত্য : এ ধরনের গ্রন্থে জগৎ ও জীবনের নানা রহস্য-চিন্তা, হেঁয়ালি ও সাধারণ ইতিহাস, ভূগোল, জীবতত্ত্ব, বস্তুতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি সম্বন্ধে প্রশ্নোত্তর রয়েছে। শেখ সাদীর গদামল্লিকা, সেরবাজ চৌধুরীর ফক্করনামা বা মল্লিকার সওয়াল, এতিম আলমের আবদুল্লাহর হাজার সওয়াল, আবদুল হাকিমের নুরনামা, আকিলের নুরনামা, মুসানামা, সৈয়দ নূরুদ্দীন ও নসরুল্লাহ খোন্দকারের মুসার সওয়াল প্রভৃতি এ জাতীয় গ্রন্থ।
ঘ. সাধন ও ভজনসঙ্গীতরূপে পাচ্ছি : রাধাকৃষ্ণরূপক গীতি, বাউল গান ও অন্যান্য আধ্যাত্ম সঙ্গীত।